আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সাংস্কৃতিক আন্দোলন; ভাবনা কোন পথে?

কাজল দাস  

বাংলাদেশে এখন জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করার জন্য একটা কঠিন সময় পার করছে। খোদ পুলিশ মানুষের হাতে লাঠি তুলে দিচ্ছে। নিজেরা মানববন্ধন করছে। এর থেকে ভয়াবহ পরিস্থিতি আর কিছুই হতে পারে না। জঙ্গিবাদ মোকাবেলার জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন মিজারের এ্যাকশন নিচ্ছে। কাউন্টার এ্যাটাকে গিয়ে তাঁদের হত্যা করছে, বন্ধুক যুদ্ধের নামে হত্যা করছে। যৌথ বাহিনী, বিশেষ বাহিনী, র্যা ব, পুলিশ মিলে খাবি খাচ্ছে রীতিমত। বিশ্বব্যাপী ও তাই হচ্ছে।

আসলে আত্মঘাতী স্কোয়াড থামানো যে কোন আইনি সুরক্ষার জন্যই বিরাট চ্যালেঞ্জ তবুও আমাদের সরকারের এখন টনক নড়েছে প্রবলভাবে। এটা আশাবাদের বিষয়। আগে আমাদের সহযোদ্ধা-বন্ধু ব্লগারদের হত্যাকে অস্বীকার করা গেলে ও গুলশান এ্যাটাক অস্বীকার করা যাচ্ছে না। তবে এই ঘটনা সরকারকে অনেক বেশি নাজুক করলে ও সিমপেথিসাইজার করে তুলেছে। সারাদেশে বিভিন্ন লেভেলে এর উপায় খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানীরা, সাংবাদিক, ধর্মীয় নেতা, রাজনীতিবিদ, উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, সংস্কৃতকর্মীরা মিলে চেষ্টা করছেন। ল এ্যান্ড অর্ডারের পাশাপাশি বেশি জোর দেয়া হচ্ছে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উপর। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে এই আন্দোলন শুধু জরুরী না, এটা একটা সময়ের আবেদন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যদি বর্তমান বাংলাদেশ এটাকে দাঁড় করাতে না পারে, এই দেশে সেক্যুলারিজমের জায়গায় বিপদ আছে, দেশ একটা ধর্মবাদী রাষ্ট্রের কাঠামোতে রূপ নেবে। প্রবলভাবে বিরাজমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের এই দেশে বিপথগামী হওয়ার যে ট্রেন্ড  নিয়েছে তা অচিরেই আরব ভূখণ্ডের দেশ গুলোর মত, জাতিগত, সম্প্রদায়গত, গোষ্ঠীগত দ্বন্দে  পড়ে বাঙ্গালী সংস্কৃতির পথ থেকে রূপান্তরিত হবে। যেমন-আজকের ইরান বা আফগানিস্তান একটি রূপান্তরিত রাষ্ট্র। এই রূপান্তর নেতিবাচক। প্রগতির জন্য অন্তরায়।

সাংস্কৃতিক আন্দোলন একটি ব্যাপৃত বিষয়। তার বড় উদাহরণ গণচীনের ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’। মহান চীন বিপ্লবের পরে মাং সে তুঙের নেতৃত্বে, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬ সময়কালে সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে এটি হয়েছিল। যে কালচারাল রেভ্যালুশন করা হয়েছিল, সেটা একটি ব্যাপৃত সাংস্কৃতিক আন্দোলন। দেশের জনগণকে একটি ভাবমানসের দিকে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে তাঁর চেতনার মান নির্মাণের একটি বিষয় হিসেবে এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়েছিল। অবিভক্ত  ভারতবর্ষ, বিভক্ত পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশ পর্বের সময়ে এই ভূখণ্ড অনেক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। এই প্রতিটি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন এই সমাজের প্রগতিশীল চিন্তাকর্মীরা। প্রতিটি বিপ্লবী রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে ও সাংস্কৃতিক মান নির্মাণের লক্ষ্যে এই ধরণের আয়োজন থাকে ।

৫২’র ভাষা আন্দোলনের পরে ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ও তাঁর পরে আমাদের দেশে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়েছে। পুরো যুদ্ধ প্রক্রিয়ার ভেতরে হয়েছে। তাঁর পরে ও হয়েছে। গড়ে উঠেছে অনেক মুক্তিকামী পরিপূরক গণসংগঠন। বিপ্লবী ধারার রাজনীতি থেকে ও যেমন হয়েছে তেমনি উদারপন্থী ধারার রাজনৈতিক দল থেকেও হয়েছে। কিন্তু সমাজে বর্তমানে এই স্পিরিট পুরোপুরি না হলে ও অধিকাংশটা বিদ্যমান নাই। সেটা ক্ষয়ে গেছে। এই ক্ষয়ে যাওয়া জায়গাটা দিয়ে যে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে তাঁর ফলাফল বাংলাদেশ এখন বহন করছে। দেশে এই প্রেক্ষাপটে সাংস্কৃতিক আন্দোলন খুব জরুরী। এখানে বলে রাখা ভাল, দুই দিনের সাংস্কৃতিক কর্মসূচির বিষয়কে মাথায় রেখে সাংস্কৃতিক আন্দোলন করা যায় না।

বর্তমান সময়ে জঙ্গিবাদ মোকাবেলার জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন ভাবার আগে দরকার এই পরিণতির  উপর গভীরভাবে পর্যালোচনা করা। গবেষণা করা। গত কয়েকদশকে এই দেশের তরুণদের মধ্যে যে কেন্দ্র বিচ্যুত চেতনা নির্মাণ হয়েছে তাঁর স্বরূপ উদঘাটন করা। বর্তমান আলোচনায় সাংস্কৃতিক আন্দোলন বিষয়টাকে দাঁড় করানোর জন্য চলমান সন্ত্রাসবাদী বিপদের কারণ ও তাঁর প্রবণতা গভীর অনুসন্ধান করে দেখে নেয়া জরুরী। কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ নিচে তুলে ধরা হল:

১)  স্বাধীন একটা রাষ্ট্রে যার চারটি মৌলিক স্তম্ভ-গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালী জাতীয়তাবাদ ছিল, সেখানে সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহ  যুক্ত করা এবং তৎপরবর্তীতে একটি সামরিক সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে কার্যত এই দেশের ঐক্য সংস্কৃতি নির্মাণের জায়গাটা ধ্বংস করা হয়েছে এবং এই জায়গা থেকে ফেরা যাবে না আর যার ফলে সমাজ যত এগিয়ে যাবে ততই যত ধরণের বৈচিত্র্য তৈরি হবে-চিন্তায়, ধর্মে, বর্ণে, গোত্রে এইসব বিষয়ের দ্বন্দ  কার্যত এই রাষ্ট্র কোনদিন নির্মূল করতে পারবে না। রাষ্ট্র হিসেবে সামগ্রিক জনগণের ধারণা থেকে সে অনৈতিক হয়ে পড়েছে। একটি অনৈতিক রাষ্ট্র সেটা ইতিহাসে কোথাও পারেনি। তবে এটাকে বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে হবে।

২) সর্বত্র ইসলামীকরণ করা। রাষ্ট্র একদিকে ধর্মকে পেট্রোনাইজ করার ফলে সমাজের সর্বত্র ইসলামীকরণ ঘটেছে। এটা ঘটেছে গত চারদশকে। ’৮০ এবং ’৯০ এর দশক এর উন্মেষকাল ছিল কিন্তু শূন্য ও চলমান দশক এর মহামারী বিস্তার লাভ করেছে। এই ইসলামাইজেশনের জায়গা খুব খুব গভীরে গিয়ে বুঝার বিষয় । কোন সংক্ষিপ্ত লেখায় এটা আলোচনা অসম্ভব। তবুও কিছু উল্লেখযোগ্য কিছু উদাহরণ দেয়া যায়-

-অর্থনীতিতে ইসলামী ব্যাংকিং চালু, যদি ও ব্যাংক মূলত কাজ করে পুঁজি নিয়ে এবং কার্যত পুঁজির কোন ধর্ম নেই, তাঁর ধর্ম কেবল মুনাফা। এই মুনাফা সন্ত্রাসীদের শক্তি যুগিয়েছে।

-যারা ইসলামী ভাবমানসে অর্থনীতিকে লেবাস পড়িয়েছেন সংঘাত কারণে তাঁরা নিজদের অফিসে ইসলামী সংস্কৃতি চালু করেছেন, ড্রেস কোড দিয়েছেন, এরাবিক সংস্কৃতিকে প্রাধান্য করেছেন। অনেক ব্যাংক তাঁদের অফিসের দেয়ালে, ক্যালেন্ডারে দেশি সংস্কৃতির কোন ম্যুরাল , পথিকৃতি, চিত্রকলা রাখতে চান না, এমনকি এও দেখা গেছে স্থাপত্য হিসেবে তাঁরা দিনাজপুরের বিখ্যাত কান্তজীর মন্দিরকে ও তাঁদের ক্যালেন্ডারে রাখেন নি।  

-দেশের মানুষ আগে শিক্ষিত কম ছিলেন কিন্তু এখন অনেক বেশি শিক্ষিত হবার কারণে তাঁরা কোরআনের খুব লিটারেটিক অনুবাদ পড়ছেন এবং তা কাজে লাগাচ্ছেন নিজেদের ব্যক্তিজীবনে। সেজন্য তাঁরা হিন্দু বা অনন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে কম যাচ্ছেন, পহেলা বৈশাখ বা অন্য কোন অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন না, ছেলেমেয়েদের নাম আরবীতে রাখছেন। এবং এই নামের আরবীকরণ খুব সুগভীর প্রভাব ফেলছে শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক নির্মাণে। দেশের যে কোন স্কুলে এখন গেলে দেখবেন, ছেলেমেয়েদের বাংলা নাম কেউ রাখছেন না। খুব কঠিন আরবী বানানে সয়লাব। এগুলো কোরানিক ইন্ট্রাপ্রিটিশনের ফলাফল।

- দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জায়গাটা ধর্মীয় বিষয় দিয়ে রিপ্লেসড হওয়াটা ও দেশকে ইসলামীকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় একটি সেক্যুলার প্লেস। সে রাষ্ট্রের ভেতরে একটি রাষ্ট্র। এখানে মিলাদ মাহফিল করা, ওয়াজ করা, মসজিদ নির্মাণের দাবিতে আন্দোলন করা, ইফতার পার্টি করা, তাবলীগের দাওয়াতি কার্যক্রম করা, এইসব বিষয় খুব প্রভাব ফেলে একটি ছাত্রকে জঙ্গিবাদের দিকে নিয়ে যেতে। এর প্রভাবে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ভাস্কর্য নির্মাণ করা যায় না। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গত দু বছর আগে তেমনি আটকে যায় ‘জননী’ নামের ভাস্কর্যের কাজ।

- রাজনীতিতে চরম মাত্রার ধর্মের ব্যবহার। দেশে এখন ঈদ আসলেই দেখা যায় পোস্টারে চেয়ে গেছে। এটা আগে ছিল না। এর কারণ ধর্মকে দিয়ে একজন নেতা তাঁর কর্মীদের উজ্জীবিত করছেন। পুলিং করছেন। আমাদের প্রধান সারির নেতারা ঘণ ঘণ হজ্জ্ব করছেন। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হল নেতাদের হাজি হওয়াটা এখানে এখন একটা ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। লুটপাটের টাকা দিয়ে অচিরেই ক্যাডাররা হজ্জ্ব করে পোস্টার ছাপাচ্ছেন। এটা দেশে ধর্মীয় প্রবণতা বৃদ্ধির একটা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।

- হিজাবী সংস্কৃতির প্রসার। এই হিজাবের প্রসার নিয়ে ও গভীর ভাবা দরকার। এটা নিয়ে অন্যত্র বিশদ আলোচনা হতে পারে। সংক্ষেপে যা বলা যায় সেটা হল-মনস্তাত্ত্বিক কারণেই হিজাব বেশি  পড়ছেন সবাই। একজন বাংলাদেশি মুসলিম মেয়ে যখন জিন্স পড়ে ভাবছেন নিচটা ঠিক শরিয়তি হল না, আবার এটা পড়া ও চলার দুইই আনন্দ আছে, তখন তিনি শরিয়তি অপশন হিসেবে মাথায় হিজাব নিচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যের এই ট্রেন্ড বেশি। এখন তা বাংলাদেশে চালু হয়েছে। যেহেতু একই সাথে শরীরটাও আকর্ষণীয় হচ্ছে আবার ধর্মকে ও রাখা যাচ্ছে ফলে এই মানসিক জায়গা দিয়েই হিসাব নিকাশ করে হিজাব আগাচ্ছে। আবার যেহেতু তাঁর একটা ভ্যালু অফ বিউটিফিকেশন আছে, তাঁকে সুন্দরী লাগছে ফলে ফ্যাশনের কারণেই এর আধিক্য বেশি ঘটেছে।

- নামকরণ একটা বিশাল ব্যাপার। আপনি দেখেন গত জামায়াতি সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গার নাম, হোটেলের নাম পরিবর্তিত হয়েছে। হোটেলের নাম আল-মদিনা, রেস্টুরেন্টের নাম আল-বাত্তানি, শপিংমলের নাম আল-হামরা, পরিবহন বাসের নাম আল-মোবারাকা, ব্যাংকের নাম আল-আরাফাহ, বিমানবন্দরের নাম শাহ-জালাল, এখানে গলির নাম দুরুদনগর।হিন্দুয়ানী বা বাঙালী নামকরণ মুছে ফেলা হচ্ছে। সকল ক্ষেত্রে ইসলামীকরনের নগ্ন প্রচেষ্টা যার সাথে কৃষ্টি-সংস্কৃতির কোন মিল নাই। যে হোটেলে দিনরাত পতিতাবৃতি চলে তার নাম আল-মদিনা রাখে কিভাবে? যে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা সর্বনিম্ন দামে বিক্রি করলেও সত্তর পার্সেন্ট লাভে চলে সেখানে আল-বাত্তানির কি সম্পর্ক? এমনি এমনি এগুলো এদেশে আসে নাই এগুলো আসছে সালাফিজমের , ওয়াহাবিজমের চিন্তা-দ্বারার মানুষের মাথা থেকে , যারা দিনদিন দেশকে এরাবিক রূপান্তরিত সংস্কৃতির দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।

- ইসলামী চিন্তাজগতের বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা । মুসলিম বিশ্বে এখন যে সংকট সেটা হল তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সংকট,আদর্শিক সংকট,তাদের সামনে কোন বড় মাপের চিন্তাবিদ বা তাত্ত্বিকরা নাই,যারা তাদেরকে ঠিক মতো গাইড করতে পারে। তাদের আছে বড়জোড় ধর্মীয় নেতা। এই নেতারা মূলত: এইসব দ্বন্দ্ব সংঘাত জিইয়ে রাখার কারিগর।  বর্তমান ইসলামী বিশ্ব তাঁদের জন্য সহানুভূতিশীল তাত্ত্বিকদের গ্রহণের বিপরীতে ইসলামী রক্ষণশীল ভাবধারার তাত্ত্বিকদের গ্রহণ করছেন । তাঁরা এডওয়ার্ড সাঈদকে গ্রহণ করছেন না, নাগিব মাহফুজকে গ্রহণ করছেন না কিন্তু নিচ্ছেন আয়াতুল্লাহ খোমেনি বা জাকির নায়ককে। সব জায়গায় একই রূপের ইসলামীকরণের দ্বন্দ  নিজেরা বিভক্ত হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন। আমাদের দেশে ও দেখা গেল, গুলশান এটাকের তরুণেরা জাকির নায়কের ভাবমানসে উদ্ধুব্ধ ছিলেন।

৩) বর্তমান সময়ের প্রযুক্তিকে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছেনা। এই সব হামলা থেকে দেখা যাচ্ছে, যারা এই হামলা করছেন, তাঁদের অনেকের বয়স ২০-২৫ এর ভেতরে, খুব কম আছেন ২৫-৩০ এর ভেতরে। এমনকি এদের যারা গাইড করছেন তাঁরা ও তেমন বয়সী না। তাহলে যে ছেলের বয়স ২০ বছর সে গত ৫-৭ বছর যদি নেটে সময় কাটায়, গেইমে সময় কাটায় তাহলে তাঁর বিচ্যুতি হবার জায়গাটা অনেক বেশি। এবং দেখা যাচ্ছে এরা সবাই নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে যুক্ত। প্রযুক্তির যে অসীম ক্ষমতা সেটা ব্যক্তিকে নেয়ার মত উপযুক্ত না করে তুলে যদি তাঁর হাতে এই সব প্রযুক্তি তুলে দেওয়া হয় তাহলে এখানে খুব সাংস্কৃতিক শূন্যতা বাড়বে। তাঁর ফলাফল বেশি আসবে উঠতি প্রজন্মের মধ্যে। সামাজিক মিডিয়া তাদেরকে এইসব ঘটনার জন্য খুব বেশি চিয়ার আপ করবে। এটা নজর দেয়া জরুরী।

৪) আদর্শিক জায়গা থেকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার চূড়ান্ত পতন আরো একটি বড় কারণ । যদি দেশের মৌলিক চেতনাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও ধরি তাহলে দেখা যাবে, শিক্ষাব্যবস্থা চূড়ান্ত রকমের মুনাফামুখী হতে গিয়ে খেই হারিয়েছে, বিজ্ঞানের জায়গায় প্রযুক্তির প্রসার বিজ্ঞানের দার্শনিক ভাবনাকে নষ্ট করেছে। এর দায় বাংলাদেশকে দীর্ঘকাল নিতে হবে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মান নিচে নেমে গেছে। দেশটা একটা দার্শনিক জায়গা থেকে সরে যাওয়ার পেছনে দায়ী আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো।

৫) দেশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য মানুষকে মানুষকে নানাভাবে ধর্মীয় প্রেষণায় রাখছে। জীবনযুদ্ধে পরাজিত মানুষ ধর্মের কাছে সমর্পিত হচ্ছে।

৬) আন্তঃগোষ্ঠীয়, আন্তঃধর্মীয় ও আন্তঃসাংস্কৃতিক চেতনার জায়গা নষ্ট হয়েছে। হিন্দুকে মালাউন বলা, ভারতীয়কে ডান্ডি বা ড়্যান্ডিয়া বলা, আদিবাসী মেয়েদের ভোগ করার বাসনা, বাউলদের উপর অত্যাচার, নাস্তিকদের হত্যা করা, মন্দিরে হামলা করা এই সব ক্ষেত্রে হারমনি নষ্ট হয়েছে।

৭) সন্ত্রাসবাদের বৈশ্বিক পরিস্থিতি। আমাদের দেশে শাহবাগ মুভমেন্টের প্রতিক্রিয়ায় যে মৌলবাদী রিএ্যাকশন তৈরি হয়েছিল, তাঁর জের ধরে কিছু ব্লগার কিলিং হত এবং এটা কিছুটা সময় ধরেই চলত, কিন্তু গুলশান এটাক হতো কিনা এটা বলা যায় না। গুলশান এটাকের কেন্দ্র বৈশ্বিক ইসলামী সন্ত্রাসবাদ। তাঁর সাথে যুক্ত দেশীয় নেটওয়ার্ক। কিন্তু এন্টি শাহবাগের কেন্দ্র ছিল পুরোপুরিই দেশীয় এবং এদের হিংস্রতা ও সহিংসতার প্রবণতা ও ভিন্ন। শাহবাগে ছিল রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রশ্ন। আর এখনকার বিষয় হল- খেলাফতের প্রশ্ন। যদিও চিন্তার দিক থেকে দুটোই ধর্ম থেকে বেশি মাত্রায় উৎসারিত ও কেন্দ্রীভূত।  

আরো বিস্তর আলোচনা করার জায়গা আছে দেশের এই গভীর ক্ষত তৈরি হবার প্রেক্ষাপট নিয়ে। সংক্ষেপে যে সকল বিষয় আলোচনা হল সেটাকে মাথায় রেখেই আজকের সাংস্কৃতিক আন্দোলন করা দরকার। কেবল দলীয় ব্যানারে টাকা খরছ করে, নিজেরা জঙ্গিদের মত চিৎকার চেঁচামেচি করে এই সন্ত্রাসবাদ আটকানো যাবে না। আমাদেরকে মাথায় রাখতে হবে যে, একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে ধর্মীয় সন্ত্রাস ঠেকানো কোনভাবেই যায় না। কিন্তু তাঁর ব্যাপারে আপনাকে যে সকল পদক্ষেপ নিতে হবে, তাঁর মধ্যে সাংস্কৃতিকভাবে স্থিতিশীলতা নির্মাণ জরুরী। সমন্বিত সংস্কৃতি নির্মাণ জরুরী। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে গ্রহণ ও বর্জনের ক্ষেত্রে খুব প্রগতিবাদী চিন্তা জরুরী।

এখন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বাস্তবতা আমাদের কতটুকু সেটা নিয়েই ভাবা দরকার। সরকারের নির্বাচনকে নিয়ে যেহেতু এখনো একটি অসন্তোষজনক পরিস্থিতি জনমনে বিরাজমান ফলে সার্বিক আন্দোলন সম্ভব নয়। এঞ্জিওদের মত ফান্ড করে এই সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা করা যাবে না। দলীয় কর্মীদের দিয়ে ও হবে না। যেখানে খোদ দলীয় সেন্ট্রাল পর্যায়ের নেতার ছেলে সরাসরি হামলায় যুক্ত,সেখানে থেকে বুঝা যাচ্ছে, রাজনৈতিক চেতনার ছাপ নিজের সন্তানদের উপরেই তাঁদের নাই। তবুও এর মধ্যেই পথ খুঁজতে হবে আমাদের। আসমান থেকে কোন উপায় আসবে না। এটাই বাস্তব।

এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে দুই ধাপে ভাবতে হবে আমাদের। কিছু আশু কর্মসূচী আবার কিছুটা দীর্ঘমেয়াদী। প্রথমেই দীর্ঘমেয়াদীর বিষয়টা বলি, এটাই জরুরী। শাহবাগ আন্দোলনের পর আমরা বলেছিলাম যে, এই যুদ্ধাপরাধের বিচারের আন্দোলন আমাদের কম হলে ও এক যুগ চালিয়ে যেতে হবে। আমরা একটা জেনারেশন পাহারা দিয়ে বিচার করব। এবং আরেকটা জেনারেশন এর মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠবে।  কারণ ক্ষতটা ৪৫ বছরের, এখানে দুই যুগ ও লাগতে পারে। বর্তমানে ও তাই ভাবতে হবে।

ইতিমধ্যে আপনার একটা জেনারেশন কিন্তু তৈরি হয়ে গিয়েছে। তাঁকে ফেরানো যাবে না। এরা শুধুমাত্র আইনি ভয়ের কারণে সন্ত্রাসবাদে ঝুঁকবে না কিন্তু ভেতরে একটা “ বিশ্বাসের ভাইরাস” বহণ করে চলবে। যদি এটাকে এখনই ব্রেক না করা যায় তাহলে  গত দুই দশকের সন্ত্রাসী ভাবমানসের নেতা ও ইসলামীকরণের সংস্কৃতি ও বর্তমানে গড়ে উঠা প্রজন্ম এই তিনে মিলে, দেশকে পাকিস্তান বা আফঘানিস্থান বানাতে না পারুক। তুরস্কের মত আংকারা আর ইস্তাম্বুল কেন্দ্রিক দ্বিমুখী সংস্কৃতিতে ভাগ করে দেবে নিশ্চিত একটা সময় গিয়ে । এই প্রবণতা এই দেশে আছে। এই জায়গায় সব কিছু ঢেলে সাজাতে হবে। উপরের যতগুলো প্রবণতার কথা বললাম সেটাকে জোর জবরদস্তি না করে সাংস্কৃতিকভাবে আত্তীকরণের দিকে হাঁটতে হবে, সহিষ্ণুভাবে ফেরাতে হবে।  মৌলবাদী অর্থায়ন, রাষ্ট্রীয় ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকতা, শিক্ষা ক্ষেত্রের ইসলামীকরণ, প্রচার মাধ্যম ব্যবহার করে ধর্মীয় উস্কানি দেয়া, সংখ্যালঘুদেরকে নির্যাতিত করা এইসব ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও জোড়ালোভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

আর আশু কর্মসূচির মধ্যে প্রধানতম বিষয় হচ্ছে-প্রথমত সমস্যাকে স্বীকার করে নিতে হবে। যদি ২০১৩ সালের দিকে প্রথম যে ব্লগারদের হত্যা করা হয়েছে, এটা যদি স্বীকার করা হত তাহলে আজকে এই পরিস্থিতি তৈরি না ও হতে পারতো। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যে ভয়ের সংস্কৃতি নির্মাণ করেছেন, সন্দেহ আর ধূম্রজালের সংস্কৃতি নির্মাণ করেছেন, তাঁর ফাঁকফোকর দিয়েই এই সন্ত্রাসবাদের নেটওয়ার্ক গজিয়ে উঠেছে। এই জায়গায় একদম উপর্যুপুরী ব্যবস্থা প্রণয়ন না করা গেলে এটা থামানো যাবে না।  সন্ত্রাসবাদী মনস্তত্ব নির্মাণের জায়গা ধীরেধীরে বন্ধ করা ও আইনি পর্যায়ে একদম জিরো টলারেন্সি দেখানো এবং সব ক্ষেত্রে দেশের জনগণকে তথ্য উন্মুক্ত রেখে হাঁটতে পারলে ফলাফল আসতে  পারে। তা না হলে বিপদ আবার ও হবার জন্য এক যুগের কম সময়েই যথেষ্ট হবে বলে মনে হয় ।

কাজল দাস, অনলাইন এক্টিভিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ