আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ভাষা নিয়ে ভাসা ভাসা সাতকাহন

জাহিদ নেওয়াজ খান  

মোটামুটি লম্বা সময়ের জন্য দিল্লী যাওয়ার আগে নিয়মিত ভারত আসা-যাওয়া করা এক বড়ভাই টুকটাক হিন্দি শিখে যেতে বলেছিলেন। তবে, তিনি এও বলেছিলেন, বডি ল্যাঙ্গুয়েজের উপর কোন ভাষা নেই। দরকারে ইশারাতেই অনেক যোগাযোগ সম্ভব। হিন্দি নিয়ে আমার তেমন কোন আগ্রহ বা অ্যালার্জি কোনটাই না থাকলেও বাইরে গেলে ইন্সটিটিউটে ফেরার জন্য অটোঅলাকে কী বলতে হবে সেটা মুখস্থ করে নিয়েছিলাম। যেটা শিখেছিলাম সেটা মোটামুটি এরকম: মাসকম, অরুণা আসফ আলী মার্গ, লাল বাত্তিকা পর, জেএনইউকা পাস (ঠিক আছেতো!) আমার কাছ থেকে কয়েকজন ইউরোপীয় কোর্সমেটও শিখে নিয়েছিল।

মাসকম মানে ম্যাস-কমিউনিকেশন ইন্সটিটিউট, রোডের নাম অরুণা আসফ আলী আর জেএনইউকা পাস মানে জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির পাশে; এটা তারা বুঝেছিল। সমস্যা ছিল লাল বাত্তিকা পর নিয়ে। আসলে সেটা ছিল একটা তিনরাস্তার মোড়, সিগন্যালে থামতে হয় বলে বোধহয় তারা লালবাত্তি বলতো। তো, ইউরোপীয় বন্ধুদের লালবাত্তির ইংরেজি শিখিয়েছিলাম। তাদের একজন একরাতে ওল্ড দিল্লী থেকে ফেরার সময় সব ভুলে গিয়ে শুধু লালবাত্তির ইংরেজিটা মনে করতে পারলো। অটোঅলা যথারীতি তাকে নিয়ে গেলো রেডলাইট এলাকায়। ফেরার পর সে হাসতে হাসতে মরে। যখন জিজ্ঞেস করলাম, হাউ ওয়াজ ইট? তার উত্তর ছিল: নট ব্যাড।

২.
দিল্লীবাসে বন্ধু/বান্ধবী কম ছিল না। তবে, হিন্দি তেমন শেখা হয়নি। বরং কয়েকজনকে আমিই একটু-আধটু বাংলা শিখিয়েছিলাম। সেই শেখাতে গিয়ে শিখেছিলাম, আমি যেটা কুচ কুচ জানতাম সেটা আসলে থোড়া থোড়া। অমিতাভ বচ্চনের কল্যাণে সেই হিন্দিভাষী বান্ধবীদের কেউ কেউ ভালবাসা মানে জানতো। তবে, তাদের কারো কাছে আমার পেয়ার শেখা হয়নি। বরং দিল্লীতে শেখা হয়েছিল লুবলু, প্রিভিয়েত; এইসব। দেশ থেকে বন্ধু শিবলী অবশ্য বলতো, কথার ভাষা খুব গুরুত্বপূর্ণ না; মুখের ভাষাই সব।

৩.
দিল্লীতে হিন্দির সঙ্গে উর্দুরও একটা উৎপাত দেখেছি। সব সড়কেই নাম থাকতো তিন ভাষায়: হিন্দি, ইংলিশ এবং উর্দু। উর্দু নিয়ে আমার কিছুটা অ্যালার্জিতে হিন্দিভাষী বন্ধুরা খুব বিস্মিত হতো। এক মেয়ের বরং দাবি ছিল, এমন কাব্যিক ভাষা নাকি আর নেই। বলেই সে কয়েকটা শায়েরি (তাইতো!) শুনিয়ে দিতো।

৪.
শুধু ভারত নয়, যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েও ভারতীয়দের কাছ থেকে উর্দুর এই উৎপাতের শিকার হতে হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলিম মেয়েটি প্রথম দেখাতেই আমার সঙ্গে উর্দুতে কথা শুরু করেছিল। কিন্তু আমিতো কিছুই জানি না। কেনো আমি উর্দু পারি না এটা তাকে বোঝাতে বেশ গলদঘর্ম হতে হয়েছিল। বরং পাকিস্তানের যে মেয়েটা ছিল সেই প্রথম ইংরেজিতে একথা বলে কথা শুরু করেছিল: জাহিদ, প্লিজ ডোন্ট হেইট মি ফর আওয়ার প্রিভিয়াস মিসডিডস।

৫.
তারপরও যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোন কোন ভারতীয় বন্ধু উর্দুর ভুতটা ভারত পর্যন্ত নিয়ে গেছে। সেটার প্রমাণ পেলাম গত ১ জুলাই। ওই রাতে যখন হলি আর্টিজানের ঘটনায় আমরা বিভীষিকাময় রাত পার করছি, তখন যুক্তরাষ্ট্রে বন্ধুত্ব হওয়া এনডিটিভি হিন্দির চিফ রিপোর্টারের ফোন। সে আমাকে তাদের সঙ্গে লাইভে আসতে বললো। আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু সে যখন বললো, হিন্দি না জানলেও চলবে, উর্দুতে বললেই হবে তখনতো আমার আক্কেল গুড়ুম। আমি উর্দু জানি না শুনে সেও বিস্মিত। তার ধারণা ছিল, এ অঞ্চলের মুসলিম মানেই উর্দু জানে। আমি জানি না শুনে সে ভয়ে ভয়ে হিন্দি জানি কিনা জানতে চাইলো। এও বললো, তাদের দর্শকদের বড় অংশই ইংলিশ জানে না, তাই উর্দু বা হিন্দি দরকার। তবে উর্দু জানি না জেনে সে যতোটা বিস্মিত হয়েছিল, হিন্দি না জানার কারণে মোটেই সেটা না। ওইরাতে তাকে অন্যভাবে হেল্প করেছিলাম। এমন একজনের নম্বর দিয়েছিলাম যিনি বাংলার মতো উর্দু বলতে পারেন, হিন্দিও খুব ভালো।

৬.
এতোসব কথা বলার কারণ, ভাষা নিয়ে সাম্প্রতিক কিছু বিতর্ক। এটা ঠিক যে নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক যখন বিদেশে গিয়ে উর্দুতে কথা বলেন, কিংবা তথ্যমন্ত্রী হিন্দিতে; তখন সেটা আমাদের খুব পছন্দ হওয়ার কারণ নেই; কারণ এর সঙ্গে জাতীয়তার বিষয়টি সম্পৃক্ত। কিন্তু, সাধারণ কেউ যদি অন্য একটা ভাষা জানে এবং সেই ভাষার কোন চ্যানেলে ওই ভাষায় কথা বলে তাহলে জাতপাত যাওয়ার কিছু নেই। বিদেশী কেউ যখন আমাদের কোন চ্যানেলে বাংলায় কথা বলে তখন যেমন তাদের রক্ত দুষিত হয়ে যায় না, তেমনি আমাদের কেউ অন্য ভাষায় কথা বললেও সেটা হওয়ার কথা না।

৭.
ভাষা আসলে এ যুগে একটা প্রযুক্তি। নিজের ভাষার পাশাপাশি অন্য ভাষা জানা মানে জব মার্কেট আরো বড় হয়ে যাওয়া। এটা যেমন ইংলিশের জন্য, তেমনি আরবির জন্য; এমনকি হিন্দির জন্যও তাই। আমরা যদি শুধু আরবি পড়ার জন্য না শিখে ভাষা হিসেবে শিখতাম তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের শ্রমবাজারটা আরো বড় হতো, আরো শক্তিশালী। একইরকম সেটা কোরিয়ান বা জাপানি ভাষার জন্যও।

বিশ্বায়নের যুগে শতকোটি মানুষের ভাষা হিন্দি জানাটাও দোষের কিছু না, বলাটাও না। আমাদের ভাষা বা দেশ এতো ঠুনকো না যে ভিনদেশী কোন চ্যানেলে ওই ভাষায় কথা বললে আমাদের সবকিছু হারিয়ে যাবে। বাঙালি, বাংলাদেশ এবং বাংলার কারো এমন হীনমন্যতায় ভোগা উচিত না।

জাহিদ নেওয়াজ খান, সম্পাদক, চ্যানেল আই অনলাইন ও বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ