আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

গুলশান ট্রাজেডি-উত্তর বাংলাদেশ ও তারুণ্যের উপর আস্থাহীনতা

মুনীর উদ্দীন শামীম  

তরুণদের উপর আস্থা হারানো সম্ভবত সবচেয়ে বড় সামাজিক-রাজনৈতিক পাপ। বাংলাদেশের জন্য তো বটেই, তাবৎ দুনিয়ার জন্যও। কারণ সর্বকালে, সবদেশে তরুণরাই বিবেচিত হয়েছে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় মানবসম্পদ হিসেবে। তরুণরাই হাল ধরেছে রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির। তরুণরাই এগিয়ে এসেছে সংকটে-সংগ্রামে, যেকোনো অস্পষ্ট অন্ধকারে তরুণরাই অকুতোভয়ে পথ দেখিয়েছে, পথ চলেছে আলোর মশাল হাতে। অতএব তরুণদের উপর আস্থাহীন পড়লে, তরুণদের নিয়ে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকলে একটি জাতির সমুদয় সম্ভাবনাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

৭/১ এর গুলশান ট্রাজেডি তারুণ্যনির্ভর বাংলাদেশকে তরুণদের প্রতি ক্রমাগত আস্থাহীন হয়ে পড়ার মতো এক মহা-পাপের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর নারকীয় ঘটনা-উত্তর নানা প্রচার-অপপ্রচার, কথা-অতিকথায়, সংবাদ ও গল্পে বিস্তৃত ভয়-শঙ্কার সরাসরি অভিঘাত পড়ছে তরুণদের উপর। আমরা যেন সম্মিলিতভাবে তরুণদের উপর আস্থাহীনতার এক অনিবার্য পাপে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছি। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, অভিভাবক- এ ক্রমবিকশমান আস্থাহীনতার সামাজিক-সাংস্কৃতিক রোগ থেকে যেন কেউ বাদ নেই।

এদিক থেকে বলা যায়-বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য এত বড় সামাজিক-রাজনৈতিক সংকট, আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাসের বৃহত্তর জনপরিসর এর আগে কখনও তৈরি হয়নি। একটি অভাবিত বিয়োগান্তক ঘটনাই সবকিছু পাল্টে দিল? পাল্টে দিল আমাদের বিশ্বাস, আমাদের মন? মুছে দিল আমাদের তারুণ্যের ঐতিহ্য, আমাদের তারুণ্যের ইতিহাস ও অবদান? গোটা তরুণসমাজের উপর অবিশ্বাস ও সন্দেহের চোখদিয়ে দৃষ্টি ফেলার এ রোগটি সম্ভবত এখন মহামারি আকারে আত্মপ্রকাশের পথে!

প্রতিদিন-প্রতিনিয়ত শুনছি-তরুণদের গতিবিধি বিশেষ নজরে রাখতে হবে। পরিবার, সমাজ, শিক্ষাঙ্গন, টিভি টকশো- সর্বত্রই, একই কথা পুনপৌণিকভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, পথচারি সবাই প্রায় একই সুরেও কথা বলছেন। হাটেবাজারে, পথেঘাটে, শিক্ষালয়, উপাসনালয়, বিনোদনকেন্দ্র, খেলারমাঠ, রেস্তোরাঁ-প্রায় সবখানে সন্দেহ-সংশয়ের দৃষ্টিপাত তরুণদের উপর। তরুণদের নিয়ে এমন আলোচনা-সমালোচনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ফলাফলও আমরা ইতোমধ্যে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেছি।

আমরা দেখছি শিক্ষার্থী, অবিবাহিত তরুণ বেকার কিংবা চাকরিজীবীদের বাসাভাড়া দিতে আপত্তি করছেন বাড়িওয়ালারা। অনেক বাড়ির মালিক কাউকে কাউকে বাসা ছাড়ারও নোটিশ দিয়েছেন বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। যেন বা তরুণরা আমাদের কেউ নন, তারা অন্যকেউ, অন্য গ্রহের। রাস্তার মোড়েমোড়ে যৌক্তিকভাবেই যেসব চেকপোস্ট বসানো হয়েছে, সেখানেও তরুণরাই প্রধান ও বাড়তি জিজ্ঞাসাবাদের শিকার হচ্ছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংরেজি মাধ্যমে পড়া তরুণরা গড়পড়তা সন্দেহের চোখে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতোমধ্যে অনেক তরুণ তাদের কষ্ট ও ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। কেউ কেউ মূলধারার গণমাধ্যমের কাছে জানিয়েছেন তাদের দিনযাপনের নানা অনিশ্চয়তা ও ঝামেলার কথা।

এ সময়, এ সংকটে তরুণদের বেশি করে আস্থায় নেয়ার কথা। আবেগ ও সহানুভূতির সাথে তাদের পাশে দাঁড়াবার কথা। তাদের বিচ্ছিন্নতা বোধগুলিকে বিবেচনায় নেয়ার কথা। তাদের বিপথগামী হওয়ার কার্যকারণ অনুসন্ধান করে মুক্তির উপায় খোঁজার কথা। তার বদলে গোটা তারুণ্যকে সম্ভাব্য অপরাধী হিসেবে দলভুক্ত করে ক্রমাগত নজরদারির কথা বলে, তাদের নজরদারিতে রেখে তারুণ্যের প্রতি যে আস্থাহীনতার সংকট তৈরি করা হচ্ছে সমাজজুড়ে, ভুলে, জেনে বা না জেনে অথবা  স্রেফ উদ্ভূত ভয়ের কারণে, সেটির পরিণতি নিশ্চয়ই ভালো হবার নয়। ভালো হতে পারে না। আর এ কারণেই তারুণ্যের প্রতি আমাদের এ সম্মিলিত আচরণের সম্ভাব্য অভিঘাতগুলি এখনই বিবেচনায় নেয়া জরুরি।

এটা ঠিক যে, বয়স বিবেচনায় হলি আর্টিজানের জঙ্গিরা সবাই তরুণ। কল্যাণপুরের জঙ্গিরাও তরুণ। শোলাকিয়ার জঙ্গিরাও তরুণ। ইতোমধ্যে যারা দীর্ঘদিন ধরে পরিবার থেকে নিখোঁজ রয়েছেন, যাদের সম্ভাব্য জঙ্গি হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে, কিংবা যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিশ্চিত ও সন্দেহভাজন তালিকায় রয়েছেন, তাদেরও বেশিরভাগ তরুণ। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, এসব বিপথগামী তরুণরা বাংলাদেশের তারুণ্যকে প্রতিনিধিত্ব করে না। কোনভাবেই না। আর জনমিতির সংখ্যাতাত্ত্বিক কাঠামোয় জঙ্গি হয়ে যাওয়া তরুণদের সংখ্যাটি একেবারেই নগণ্য।

এ নগণ্য সংখ্যক জঙ্গির পৈশাচিক উদাহরণের বিপরীতে নিকট ইতিহাসে বাংলাদেশের তারুণ্যের গৌরবময় উদাহরণ হচ্ছে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ। ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৩ তারিখে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে অনলাইনে কয়েকজন তরুণের ডাকেই প্রথমে শাহবাগ, তারপর গোটা বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব জাগরণ ঘটেছিল তারুণ্য ও দেশপ্রেমের, যে কঠোর কিন্তু শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে জেগে উঠেছিল গোটা তরুণসমাজ, যারা দিনরাত সেটি বজায় রেখেছিল, যার ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্র আইন সংশোধনে বাধ্য হয়েছিল-তারাই বাংলাদেশের প্রকৃত তরুণ, সেটিই আমাদের প্রকৃত তারুণ্য। ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের সকল গৌরবময় -উৎকৃষ্টতম অর্জনগুলি এসেছিল প্রধানত তরুণদের মাধ্যমে, তরুণদের আত্মত্যাগ ও তরুণদের নেতৃত্বে।

৫২, ৬৯, ৭১, ৯০-আমাদের অধিকার, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র অর্জন ও পুনরুদ্ধারের রক্তঝরা দিনগুলিতে তরুণরাই নেতৃত্ব দিয়েছে, জীবনবাজি রেখেছে, চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত হাতেহাতে রেখে সহযোগিতা-সহমর্মিতা আর ভালোবাসার বন্ধনে অটল থেকেছে। কখনও পিছপা হয়নি, পিছপা না হওয়াই আমাদের তারুণ্যের ইতিহাস। এমনকি আজকের বিশ্বায়নের যুগে, বিচ্ছিন্নতাযাপনের কালেও যখন আমাদের, পৃথিবীর একমাত্র সুন্দরবন নিয়ে কর্পোরেট ষড়যন্ত্র হচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে সুন্দরবনকে বিপদগ্রস্ত করে তোলার আয়োজন করছে, আমলা-রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মিলে, তখনও এ তরুণরাই প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। নিকট ইতিহাসের বন্যা, ঝড়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপদগ্রস্ত-অসহায় মানুষের পাশে সবার আগে গিয়ে এ তরুণরাই দাঁড়াবার সাহস রাখেন এবং রেখেছেন। আমরা নিশ্চই সাভারের রানাপ্লাজা ট্রাজেডির কথা ভুলে যাইনি। স্মরণকালের এ ভয়াবহ শিল্পদুর্ঘটনায় সবার আগে তরুণরাই ছুটে গিয়েছিলেন, সরকারি উদ্ধারকারী বাহিনীর সাথে দিনের পর দিন তরুণরাই কাজ করেছেন।

যে দেশের তরুণদের এ রকম গৌরবময় অতীত, তাদের কোনভাবেই ঢালাওভাবে সন্দেহের নজরদারিতে এনে তাদের বিকাশমান জীবনকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলা শুভবুদ্ধির লক্ষণ নয়। বরং তার আগে জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড়ানো উচিত-পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের। কাঠগড়ায় দাঁড়ানো উচিত আমাদের সবার। কারণ কতিপয় তরুণের জঙ্গি হয়ে উঠার এবং জঙ্গি হামলার পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। তার জন্য একটা সহায়ক আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির দরকার হয়েছে। সে সহায়ক পরিস্থিতি তৈরির সক্রিয়-নিষ্ক্রিয় ভূমিকার দায় পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি কোনভাবে এড়াতে পারে না। বরং সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা অগ্রজ, যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন তাঁদের কেউ এ দায় নিতে হবে।

দু:খজনক হচ্ছে- সমাজ ও রাষ্ট্র এখন পর্যন্ত বিপথগামী তরুণদের উপর এবং তাদের পরিবারের উপর দায় চাপিয়ে দায়মুক্তির উপায় খুঁজছে। বারবার বলছে পরিবারকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। এটা ঠিক যে, হলি আর্টিজান হামলার আগ পর্যন্ত এ দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে কখনও উপরতলার, উচ্চবিত্ত, অভিজনশ্রেণির বিষয় হিসেবে ভাবা হয়নি। মনে করা হয়েছে এর কারণ ও প্রভাব কোনটাই উপরতলা পর্যন্ত স্পর্শ করবে না। উপরতলার মানুষদের ক্রমবিকশমান ভোগবিলাস আর বিচ্ছিন্নতাযাপনে প্রথম ছেদ ঘটিয়েছে গুলশান ট্রাজেডি। উচ্চবিত্তের পারিবারিক-সামাজিক জীবনে ক্রমাগত ভোগবিলাসিতা ও বিচ্ছিন্নতা যাপনের সাথে তাদের সন্তানদের জঙ্গি হয়ে উঠার সহ-সম্পর্ক নিশ্চয়ই ভবিষ্যতের সমাজবিজ্ঞান অনুসন্ধান চালাবে, এর অনুসন্ধান চালানো জরুরিও,  কেননা এর উত্তর খুঁজে পাওয়া শুধু বিদ্যাজাগতিক কারণে নয়; প্রায়োগিক কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু রাষ্ট্র ও রাজনীতি কি তার দায় এড়াতে পারে?

যে ত্রুটিপূর্ণ পরিবেশ, প্রক্রিয়া আর কাঠামোর কারণে আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে জঙ্গি উৎপাদনের সূতিকাগার বলছি, এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তো গড়ে উঠেছিল রাষ্ট্রেরই অনুমোদনে, রাষ্ট্র নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানই এগুলির দেখভাল করেছে, এমনকি সব সরকারের আমলেই ক্ষমতাসীনদের কেউকেউ এর বোর্ড মেম্বার, মালিক ছিলেন এবং আছেন। পুঁথিগত বিদ্যা বিতরণ এবং সনদ বাণিজ্যের বাইরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বদেশপ্রেম, ঐহিত্যচেতনা তৈরিতে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কী ভূমিকা পালন করছে, আদৌ কি করছে, তার কোন খোঁজ তারা কি রেখেছিলেন? সরকার শিক্ষা বাণিজ্যের উপর মূল্যসংযোজন কর আরোপের চেষ্টা করেছে, কারণ সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানো দরকার। কিন্তু একবারও দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মতো বিষয়গুলির প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিকায়ন প্রক্রিয়া আরোপের চেষ্টা করেনি। আমরা এখন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি চালুর কথা বলছি, ছাত্ররাজনীতি চালুর মধ্যে সমাধান খুঁজছি। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানকর্তৃক ’ধূমপান ও রাজনীতি মুক্ত’ ট্যাগকে শিক্ষা বাণিজ্যে বিজ্ঞাপনের অন্যতম উপকরণে পরিণত করার সময় রাষ্ট্র চুপ থেকেছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজগুলিতে সিগারেট ফু দেয়া আর রাজনীতি করাকে সমার্থক ও সমান অপরাধ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু তার প্রতিবাদ করেননি মূলধারার কোনো রাজনীতিবিদ। সরকারি কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় ভিসিকেও বলতে শুনেছি, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি না থাকার কারণে এ রকম সমস্যা তৈরি হয়েছে। কিন্তু তারা তাঁদের নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বছরের পর বছর বন্ধ রেখে সুস্থ রাজনৈতিক ধারা, রাজনৈতিক সচেতন বিকশিত তারুণ্য গড়ে তোলার পথ বন্ধ রেখেছেন সেটা কোনোভাবেই বলছেন না। তাঁরা একবারও বলছেন না ঢাকসু, রাকসু, চাকসু, ঢামেকসু, চমেকসু সহ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কেন নির্বাচন দিচ্ছেন না, তাঁরা বলছেন না- নির্বাচন না দেয়ার কারণে দেশ, জাতি ও তারুণ্যের কী কী ক্ষতি করছেন অথবা আদৌ কোনো ক্ষতি করছেন কি না।

সম্প্রতি ছাত্রলীগও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কার্যক্রম চালু করার কথা বলেছে, কিন্তু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নিয়ে একটি বাক্যও ব্যয় করেনি। যে বিদ্যালয়গুলি বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে বা বন্ধ করে দেয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে সে বিদ্যালয়গুলিকে সরকারই অনুমোদন দিয়েছে। আবার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলি দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই পরিচালিত হয়েছে। তাহলে এসবে দায়ভার সরকার ও রাষ্ট্র কীভাবে এড়াবে?আজ এ প্রশ্নটাও করা জরুরি যে, তরুণদের গড়ে তোলা ও বিকাশের জন্য রাষ্ট্রের কার্যকর পর্যাপ্ত বিনিয়োগ আছে কি না। যুব মন্ত্রণালয় নামে যে মন্ত্রণালয়টি আছে তার কার্যক্রম প্রধানত আয়বর্ধন ও কর্মসংস্থান কেন্দ্রিক, কিন্তু তারুণ্যের সুকুমার বৃত্তি বিকাশের কোন কাজই তাদের নেই। আর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাজও পর্যাপ্ত, সন্তোষজনক বলা চলে না। ধর্মীয় জঙ্গিবাদ নিয়ে দোষারোপের রাজনীতিও চালু আছে অন্তত দু’দশক ধরে। এ সময় যারা ক্ষমতায় ছিলেন ও আছেন, তারা কখনও এটাকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছেন সেটা মনে হয়নি। বরং প্রতিটি ঘটনার রাজনৈতিক ফায়দা ঘরে তোলায় সচেষ্ট ছিলেন। এ দোষারোপের রাজনীতিও জঙ্গিবাদ ও চরমপন্থার বিকাশে একটা সহায়ক পরিবেশ যে তৈরি করেছে সেটা অস্বীকারের উপায় নেই।

আবারও শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ প্রসঙ্গে ফিরে যাই। এটি ছিল বাংলাদেশের নিকট ইতিহাসে তরুণদের সবচেয়ে বড় জাগরণ। দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জেগে উঠা বাংলাদেশের জাগরণ। কিন্তু শাহবাগসহ সারা বাংলাদেশে তরুণদের এ জাগরণকে বিএনপি যেমন সন্দেহের চোখে দেখেছে ঠিক তেমনি ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগও আস্থায় নিতে পারেনি। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবেই একে বিতর্কিত করার প্রয়াস চালিয়েছে দু’পক্ষই, কেউ আগে, কেউ পরে। কিন্তু তারুণ্যের এ জাগরণ, এ রাজনীতি অব্যাহত থাকুক- সেটা দু’দলের কেউ চায়নি। বিএনপি জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্ট দলগুলির সাথে মিশে গিয়েছিল, আর আ’লীগ সম্ভবত তার দলের বাইরে যেকোনো ধরনের ঐক্য, জাগরণে ভীতসন্ত্রস্ত।অথচ গণজাগরণ মঞ্চের আদলে তারুণ্যের যে জাগরণ তৈরি হয়েছিল, নতুন প্রজন্মের মধ্যে, যেটি রাজনৈতিক হলেও দলীয় ছিল না, তার সামাজিকায়ন যদি অব্যাহত রাখা যেত, সেটি যদি ছড়িয়ে দেয়া যেত শহর-গ্রাম-গঞ্জে, সর্বত্র, তাহলে আজকের সংকটে তরুণদের জেগে উঠার জন্য যে চিৎকার করছি তার দরকার হতো না, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তারুণ্যের জাগরণ স্বত:স্ফুর্তভাবেই ঘটতো। সুতরাং তরুণদের মধ্যে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করা দু:সাধ্য হবে।

আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাকে কোনোভাবে খাটো করে দেখছি না। প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের সক্রিয় ভূমিকা অব্যাহত থাকতে হবে। তবে আজকের ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়, এটাকে শেষও করতে হবে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের জনমিতিক কাঠামোয় তরুণরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তরুণদের উপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের পথচলা। নির্ভর করছে নতুন সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন। অতএব তরুণদের জন্য ক্ষমতা ও নজরদারি চোখ সর্বত্র বিছিয়ে দিয়ে গোটা সমাজটাকে তারুণ্যের কারাগারে পরিণত করা নয়; দরকার সৃষ্টিশীল ও দায়িত্বশীল তারুণ্যবিকাশের রাজনীতি চালু করা।

বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নয়; প্রকৃত ছাত্ররাজনীতির পথ উন্মুক্ত করে দেয়া। সকল প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। সৃষ্টিশীল তারুণ্য বিকাশের এ রাজনীতি প্রসারে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সহায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। যত দ্রুত এ কাজটি করা যাবে তত দ্রুতই আমরা আশংকামুক্ত হতে পারবো, আশাবাদী হতে পারবো। আমরা আমাদের তরুণদের উপরই আশাবাদী হয়ে থাকতে চাই। তরুণরাই বাংলাদেশকে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদমুক্ত করবে। জয় তোক তারুণ্যের।

মুনীর উদ্দীন শামীম, গবেষক ও উন্নয়ন কর্মী; সুশাসন বিষয়ক একটি কারিগরি প্রকল্পে কর্মরত।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ