আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

১৫ আগস্ট ও বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের প্রেক্ষাপট

জুয়েল রাজ  

শ্যামল সবুজ বাংলাদেশ হঠাৎ করেই আজ রক্তাক্ত। ধর্মের নামে একদল খুনি মেতে উঠেছে খুনের উৎসবে। কেন এমন হচ্ছে? অনেকই ছিদ্রান্বেষণ করছেন, জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে। আজকের এই জঙ্গিবাদ হঠাৎ করে শুরু হয়নি। একদিনে এই অবস্থায় পৌঁছেনি। আজকের জঙ্গিবাদ যদিও একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান এর প্রেক্ষাপট নিয়ে ভাবতে হলে  একটু  পিছনে ফিরে তাকাতে হবে।

১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও দুই লাখ বীরাঙ্গনার বিনিময়ে একটি  অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ পেয়েছিলাম আমরা।সেই ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ যখন ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে  নিজের অবস্থান জানান দিতে শুরু করল মূল সমস্যা সেখানেই শুরু।

বাংলাদেশের এই জঙ্গিবাদের জন্ম ১৯৭৫ সালের  ১৫ আগস্ট থেকে। বঙ্গবন্ধুকে  সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে রক্তাক্ত যে ইতিহাসের শুরু তারই চূড়ান্ত  রূপ দেখছে আজ বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যে দিয়ে মূলত বাংলাদেশ কে দুই ভাবে বিভক্ত করা হয়ে যায়। পরাজিত শক্তি মাথা তুলে দাঁড়ায় । দীর্ঘ ৪৩ বছরে ইতিহাসের মিথ্যাচার করতে করতে মিথ্যাগুলোকে নতুন প্রজন্মের একটা প্রজন্মের কাছে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। বিভ্রান্ত করছে প্রজন্মকে।
 
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে  অর্জিত একটা দেশের মানুষ কিভাবে পরাজিত একটা শক্তির সাথে একাত্ম হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যেভাবে মুক্তি সংগ্রামকে ধর্মের নামে কলুষিত করে মেতে উঠেছিল ধর্ষণ আর হত্যাযজ্ঞে  স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে ঠিক একইভাবে ধর্মের নামে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে।

১৫ আগস্টের খুনিচক্র পাকিস্তানী পরাজিত শক্তির  সাথে আঁতাত করে  সৌদি আরব লিবিয়ার মতো দেশের কাছ থেকে প্রথম সহায়তা পেয়েছিল।

১৯৭৫ সালে যে খুনিচক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল তাঁরা নিজেদের বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিল ধর্মীয় রাজনীতির বুকে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে যেখানে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান যখন পর্দার আড়াল থেকে রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হলেন সাফারির পকেটে করে নিয়ে আসলেন ধর্মকে। তারপর সুযোগ বুঝে ছেড়ে দিলেন ময়দানে। একে একে ফণা তুলে আপন রূপে আবির্ভূত হল জামায়াতে ইসলামি সহ নানা ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী।

গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, মীর কাসেম, সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরীরা বাংলাদেশে ফিরে আসে। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নানা রকম মিথ্যাচার। আওয়ামী লীগ যখন আত্মরক্ষার্থে ব্যস্ত গোলাম আযম গং তাদের ধর্মের হাতিয়ার নিয়ে  ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে গঞ্জে। মাদ্রাসা মসজিদ প্রতিষ্ঠার নামে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তার নামে সৌদি আরব পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে  শুরু হয় তাদের মিশন। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের পর মাদ্রাসার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ১১শত শতাংশ মানে হলো আগে যেখানে ছিল ১টি মাদ্রাসা এখন সেখানে ১১শত মাদ্রাসা। যার বেশিরভাগই জামায়াতে ইসলামি সমর্থিত অথবা উগ্রবাদে বিশ্বাসী। ছাত্র রাজনীতিতে অস্ত্রের মহড়া, জামায়াতে ইসলামির ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের হাত ধরে আমদানি হয় চাপাতি নামক অস্ত্রের।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার আইন করে বন্ধ করে দেয়া হয়।  খুনের বিচার হবেনা এমন আইন পৃথিবীতে এর আগে হয়েছে কিনা জানা নেই।  দীর্ঘ ২১ বছর রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ ছিল গন্তব্যহীন নৌকার মাঝি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রথম রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ততদিনে পদ্মা মেঘনা সুরমায় বহু জল গড়িয়ে গেছে। জিয়াকে হটিয়ে রাজনীতির মাঠে এরশাদের আবির্ভাব  বাংলাদেশকে এক অতল অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়ে গেছে। ৭২-এর  সংবিধানের ব্যবচ্ছেদ করে মুক্তিযুদ্ধের মূল ভিত্তিকে বদলে দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেছে।

৯১ সালে বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে দিলেন। জাহানারা ইমামের পরিচালিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে আন্দোলনকে দেশদ্রোহী মামলার নামে বানচাল করে দিতে চাইলেন। সর্বশেষ ২০০১ সালে রাজাকারদের হাতে পতাকা তুলে দিলেন মন্ত্রী বানালেন।
 
এই দীর্ঘ সময়ে জামায়াতে ইসলামি ফুলে ফেঁপে অজগরে রূপ নিয়েছিল। শুধু দেশটাকে গিলে ফেলার অপেক্ষায় ছিল। সেই জায়গা থেকে ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার শক্তিশালী নেতৃত্বে শুরু হয় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধীদের বিচার প্রক্রিয়া। অজগরের পেট থেকে রক্ষা পায় বাংলাদেশ। একে একে যখন এদের  রাজাকার আলবদরদের বিচার করে সাজা বাস্তবায়িত করা হচ্ছিল নতুন রূপে আবির্ভূত হয় জঙ্গিবাদ।

পেট্রোল বোমা, আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারা সহ সারাদেশে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। সরকার যখন কঠোরভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে, শুরু হয় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুন করা। প্রথমে ব্লগার ও মুক্তচিন্তার মানুষদের খুন করার মধ্য দিয়ে  ধর্মীয় অনুভূতির কথা বলে হত্যাকাণ্ডগুলোকে একটা ধর্মীয় রূপদান করে। এর পর শুরু হয় সংখ্যালঘু সহ ভিন্ন ধর্মের ধর্মগুরুদের খুনের ধারাবাহিকতা।

শেষ হলো গুলশানে দুই পুলিশ কর্মকর্তা সহ দেশী বিদেশী ২২ জন সাধারণ মানুষকে নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শোলাকিয়াতে ঈদের জামাতে আক্রমণের মধ্যে দিয়ে সেখানে ও দুই পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। এখানেই শেষ বলে দেয়া যাচ্ছেনা। সামনে হয়তো এর চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্য।

ডিজিটাল বাংলাদেশের যে স্বপ্ন শেখ হাসিনা বাস্তবায়ন করেছেন তার সবচেয়ে বেশী সুবিধা নিয়েছে  এর বিরোধীতাকারী সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ প্রতিটা ডিজিটাল প্রচারণায় তারা আওয়ামী লীগের চেয়ে এগিয়ে আছে। নানা রকম ভুয়া ভিডিও বানিয়ে, সংবাদ ছাপিয়ে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছে। যার প্রথম উদাহরণ মানবতা বিরোধী অপরাধে দণ্ডিত দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে বলে প্রচারণা।  
 
বর্তমান সময়ে যে জঙ্গিবাদ বা হত্যাকাণ্ডগুলো বাংলাদেশে ঘটছে তার শুরু জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে। কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে  বলেছিলেন ‘‘আমি হিমালয় দেখিনি শেখ মুজিবকে দেখেছি’’। পাকিস্তানী পরাজিত শক্তিও সেই সত্যটা খুব ভাল করেই জানত। ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা ৭১ সালে  পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখতে পারে নাই। একমাত্র  বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশেই তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়া সম্ভব। আর  সেই কাজটাই তারা করেছে। এখনো করে যাচ্ছে। রাজাকারের ফাঁসি হয় বাংলাদেশে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয় পাকিস্তানের সংসদে! রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল করে পাকিস্তান। সেটা বুঝার জন্য রকেট বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই।

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ আমদানির সোল এজেন্ট হচ্ছে জামায়াতে ইসলামি। এখন  পর্যন্ত বাংলাদেশে জেএমবি,  হরকাতুল জিহাদ, হিজবুত কিংবা স্লিপার সেল আনসারুল্লাহ সহ যতো আসামী ধরা পড়েছে এদের নেতাদের  প্রায় সবাই জামায়াতে ইসলামির রাজনীতি থেকে এসেছে।

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের এই উত্থানকে আমরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে একে বৈশ্বিক সমস্যা কিংবা পশ্চিমাদের সৃষ্টি বলে এড়িয়ে যাওয়ার এক ধরণের চেষ্টা করি। কিন্তু  বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট যদি বিচার করি তাহলে খুব পরিষ্কারভাবেই বুঝা যায়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যদিয়ে  এই জঙ্গিবাদের সূত্রপাত। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার যদি সেই সময় করা হতো, ধর্মীয় রাজনীতির নামে যদি পরাজিত শক্তিদের বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে সুযোগ দেয়া না হতো, বাংলাদেশের আজকের জঙ্গিবাদের জন্ম হতো না।
১৫ আগস্ট বাঙালি ও বাংলাদেশের এক কলঙ্কিত অধ্যায়, যার পথ ধরেই জন্ম নিয়েছে জঙ্গিবাদ।

জুয়েল রাজ, সম্পাদক, ব্রিকলেন; যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি, দৈনিক কালেরকন্ঠ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ