আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

আগস্ট ২০১৬ হোক সম্মিলিতভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর মাস

রণেশ মৈত্র  

আমরা বহুদিন ধরে জেনে আসছি আগস্ট মাস শোকের মাস-কান্নার মাস-অশ্রুপাতের মাস। কারণটি সবারই জানা। ১৯৭৫ এর আগস্টের ১৫ তারিখে ভোররাতে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ীতে সামরিক বাহিনীর একটি অংশ নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করে। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা সেই ভোরেই রেডিও ষ্টেশন, টেলিভিশন দখল করে শেখ “মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে”-অবিশ্বাস্য এই ঘোষণা মুহুর্মুহু প্রচার করতে থাকে। ঐ দিন সন্ধ্যা লাগতে না লাগতেই খোন্দকার মুশতাক প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে “ইসলাম-বিরোধী” “গণতন্ত্র বিরোধী” বলে আখ্যায়িত করে দেশের সূর্য সন্তানেরা (হত্যাকারী সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা জোয়ানেরা) ইসলাম ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে জানিয়ে নতুন প্রশাসনের প্রতি দেশবাসীর সমর্থন কামনা করেন।

বিস্ময়কর হলেও সত্য, আওয়ামী লীগের গুটিকয়েক নেতা বাদে অধিকাংশই “ঐ নতুন প্রশাসনও তো আওয়ামী লীগেরই এবং ক্ষমতায় তো আওয়ামী লীগই বসেছে” এমন কথা বলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন অনেক আওয়ামী লীগের স্বচক্ষে দেখেছি। দেখেছি অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথেই তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী প্রমুখ হাতে গোনা জনাকয়েক বাদে সবাই দিব্যি পুনরায় মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করলেন। এগুলি সবই চোখে দেখা অত্যন্ত বেদনার সাথে। চোখে আরও দেখা গেল-ঐ ভয়াবহ হত্যালীলার পর পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী করাচীতে মিষ্টি বিতরণ ও আনন্দ উচ্ছ্বাসের ঢেউ-ই শুধু না বাংলাদেশকে তৎক্ষণাৎ স্বীকৃতিও দেয়। অত:পর স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসে চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি বাদশার নেতৃত্বাধীন সৌদি মুসলিম দেশগুলি। যেন ১৫ আগস্টেই বাংলাদেশ প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীন হয়েছিল ১৯৭৫ এ।

স্বভাবত:ই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে যাঁরা নিষ্ঠ, যাঁরাই বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ-তাঁরা সেদিন হয়ে ছিলেন প্রচণ্ড শোকাহত। সামরিক আইন বলবত থাকায় তার তাৎক্ষণিক বহি:প্রকাশ তেমন একটা সর্বত্র না ঘটলেও ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়ন যখন যেখানে যে ভাবে পেরেছে শোকের কান্না নয়-প্রতিবাদ মিছিল সমাবেশের আয়োজন করেছে। কারারুদ্ধও হয়েছে জিয়ার কারাগারে। ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন সাধারণ আওয়ামী লীগ কর্মী-ছাত্র লীগারদেরকেও যেখানেই পেরেছে, প্রতিবাদী মিছিলে সম্পৃক্ত করেছে। একত্রে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগ নেতারা জিয়ার রাজত্বে জেলেও ঢুকেছে।

যা হোক, আকাশের মেঘ কিছুটা কাটলে-প্রতি বছর ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস এবং আরও কয়েক বছর পর থেকে আগস্ট মাসের পহেলা থেকে ৩১ শে পর্যন্ত শোকের মাস হিসেবে আওয়ামী লীগ পালন করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সকল মিডিয়ায় বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলি আগস্ট মাসব্যাপী টি,ভি’র পর্দায় কালো বা বঙ্গবন্ধুর ছবি ধারণ করে নানা কর্মসূচীর আয়োজন করতে থাকে আজও তা অব্যাহত। সুদূর সিডনীতে বসে অনুমান করি সারা দেশে এবারেও তার কোন ব্যত্যয় হবে না। দেখা যাবে মাসজুড়ে সর্বত্র চড়া ভলিউমে মাইক্রোফোনে আওয়ামী লীগ-ছাত্র লীগ-যুবলীগের আয়োজনে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি দিবারাত্র প্রচারের আয়োজন-কালো ব্যাচ ধারণ, আলোচনা সভা প্রভৃতির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই লেখাটি পত্রিকায় ছাপা হওয়ার আগেই ঐ জাতীয় কর্মসূচী পালনও শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি যে জঙ্গি কার্যক্রমের ব্যাপক প্রসার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জঙ্গি তত্ত্ব স্থান করে নেওয়া, শিক্ষকদের একাংশ জঙ্গিবাদের প্রচার প্রসারে নেমে পড়া, বহু পরিবারের ছেলে মেয়েরা ঘর-বাড়ী, মাবাবা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোনকে ফেলে যেভাবে তথাকথিত বেহেশতের খোঁজে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতার যেভাবে অবাধ প্রসার ঘটে চলেছে, অতর্কিতে খুন যেভাবে বাড়ছে, যেভাবে নানা জনকে খুনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে-তার ফলে মানুষ তো আজ উদ্বেগাকুল হয়ে পড়েছে, আতংকিত জীবন নিয়ে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যে ধরণের কর্মসূচী আগস্ট মাসে নেওয়া হয়ে থাকে তা কি ২০১৬ তে , নতুন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?

যে বঙ্গবন্ধুকে ওরা হত্যা করেছে সে বঙ্গবন্ধু তো মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক। সে বঙ্গবন্ধু এদেশে ধর্মনিরপেক্ষর প্রতীক। প্রতীক বাঙালি জাতীয়তাবাদের এবং সমাজতন্ত্রের ও গণতন্ত্রের। সে বঙ্গবন্ধু বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের প্রতীক। তাই ঐ বাঙালির শত্রুরা-যারা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে ছিল (আজ তারা অধিকতর শক্তিতে শক্তিমান), যারা ১৯৭১ এ বাঙালির কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল-তারাই তাকে হত্যা করেছে।

হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে-প্রমাণিত অপরাধীদের আদালত শাস্তি দিয়েছে। যারা গ্রেফতার হয়েছিল, শক্তির আদেশের পর তাদের ক্ষেত্রে সেই আদেশ কার্যকরও করা হয়েছে। কিন্তু যারা বিদেশে পালিয়ে আছে-কোন বিদেশী সরকারকেই তাদেরকে ফিরিয়ে দিতে এবং ফিরিয়ে এনে সেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রদত্ত শাস্তির কার্যকর করা আজও সম্ভব হয় নি। বিষয়টি আজ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছে-এবারের আগস্ট ইস্যুটাকে পুনরায় জাগিয়ে তুলুক-সে দাবী জোরেসোরে উচ্চারিত হোক।

এর পরেও বলবো, যাদের শাস্তি হয়েছে তারা তো হত্যালীলার পরপর জোরগলায় ঘোষণা দিয়েছিল যে তারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে-তারা আত্মস্বীকৃত খুনি। কিন্তু এই হত্যালীলার ষড়যন্ত্রকারী কারা? তারা তো আরও বড় অপরাধী। তাদের তো বিচার আজও হয় নি-সে বিচারের লক্ষ্যে কোন মামলাও দায়ের করা হয় নি কোনভাবে কোন তদন্তও পরিচালিত হয় নি। আজ তাই সজোরে উচ্চারিত হওয়া প্রয়োজন-বঙ্গবন্ধু হত্যার (যার প্রকৃত অর্থ-মুক্তিযুদ্ধ ও তার আদর্শ ও চেতনাকে হত্যার) ষড়যন্ত্র যারাই করেছিল-তারাও রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যার দায়ে অপরাধী। তাই তাদের বিরুদ্ধে মামলা দয়ের করা হোক উপযুক্ত তদন্তের মাধ্যমে সু-স্পষ্ট অভিযোগে তাদেরকে (তা তারা দেশী-বিদেশী যাই হোক না কেন) আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক।

এ দাবীকে উপেক্ষা করলে চলবে না উপেক্ষিত হবেও না। যদি সত্যিকারভাবে এই দাবী কোটি কণ্ঠে ধারণ করে বাংলার রাজপথ সমূহ প্রকাশিত করে তোলা যায়। কারণ জনগণের সম্মিলিত শক্তিকে কেউ কদাপি উপেক্ষা করতে পারে নি। আর বর্তমান সরকার কোনভাবেই এ দাবীকে উপেক্ষা করতে চাইবেনও না। তবে দাবীটি তুলতে হবে সকল শক্তি দিয়ে সম্মিলিতভাবে। তেমনি ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীকেও সামনে আনতে হবে।

এবারে আসা দরকার কেন হত্যা করা হলো বঙ্গবন্ধুকে? এক কথায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে বাংলাদেশের বুক থেকে উপড়ে ফেলে পাকিস্তানী ভাবাদর্শকে ফিরিয়ে আনা। তারা চেয়েছিলো বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীতটাকে প্রথমে বদলাতে। সে চেষ্টা জিয়ার আমল থেকে সুরুও করেছিল কিন্তু জনগণের সায় না পাওয়ায় তা পরিত্যক্ত হয়। একই সাথে জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আজমকে বাংলাদেশের ভিসা দিয়ে স্থায়ীভাবেই বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনে।

সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন ঘটায় সামরিক আইনের ফরমান বলে। শুরুতেই বাহাত্তরের সংবিধানে (মুসলিম সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিক দিন থাকার অভিপ্রায়ে) “বিসমিল্লাহ” সংযোজন করে যদিও কোন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সংবিধানে এ জাতীয় বিশেষ একটি বা কোন ধর্মের কথা উল্লেখ করা হয় না-বিশ্বে এটা নজির বিহীন। পাকিস্তান ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়-ওটাকে শাসকেরা বহু আগেই “ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান” বলে ঘোষণা দিয়েছে কিন্তু তবুও তারাও তাদের সংবিধানের শুরুতে “বিসমিল্লাহ” শব্দ বসায় নি। এই ইসলামই শাসন প্রক্রিয়া তখন থেকে আজ অবধি অব্যাহত গতিতে চলছে। স্বৈরশাসক হোসেন মুহা: এরশাদও একইভাবে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী আনয়ন করে একটি বিশেষ ধর্মকে “রাষ্ট্রধর্ম” হিসেবে প্রতিস্থাপন করে সংবিধানের চরিত্র ও মূলনীতিগুলির মৌলিক ও পাকিস্তান মুখী পরিবর্তন ঘটায়। এতে একটা মেসেজ দেওয়া হয়,  ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা এদেশে অনাকাঙ্ক্ষিত। যখন জিয়া-এরশাদ এই সব সংশোধনী প্রবর্তন করেন, অন্যান্য অসাম্প্রদায়িক দলের সাথে আওয়ামী লীগও তার তীব্র বিরোধিতা করে।

তখন দলটি প্রধান বিরোধী দল ছিল। আজ দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও এগুলি পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধান অবিকলভাবে পুন:স্থাপন করে নি-বরং জিয়া-এরশাদ প্রবর্তিত সংশোধনীগুলোকেই পঞ্চদশ সংশোধনী এনে স্থায়িরূপ দিয়েছে। ফলে দেশটির পাকিস্তানাইজেশন প্রক্রিয়াটি আরও জোরদার ভাবে চলমান রয়েছে।

আইন শাস্ত্রের বিশাল বিশাল গ্রন্থ না ঘেঁটেও বা নামী দামী ব্যারিস্টার-উকিল না হয়েও একথা দিব্যি বুঝা যায় এবং সকলেই বুঝতে পারেন যে রাষ্ট্রধর্মও ধর্মনিরপেক্ষতা দুটি পরস্পর বিরোধী শব্দ এবং তার ফলে স্পষ্টত:ই সাংঘর্ষিক। এই কথা আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যরা জানেন না বা বুঝেন না-এমন কথা পাগলেও বলবে না। সর্বোপরি মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর ইচ্ছার বাইরে যে পঞ্চদল বা কোন সংবিধানই সংশোধনী প্রস্তাব আমাদের জাতীয় সংসদে পাশ হওয়া সম্ভব নয়-তাও সকলেরই জানা।

তাই দৃঢ়ভাবেই বলা চলে যে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী জেনে-বুঝেই অত্যন্ত সচেতনভাবেই ঐ সংঘর্ষিক দুই নীতি সম্মিলিত পঞ্চদল সংশোধনীর সংসদে উত্থাপিত হতে দিয়েছেন এবং সংসদ বহির্ভূত সকল অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির প্রবল বিরোধিতাকে উপেক্ষা করেই ঐ সংশোধনী মন্ত্রীসভার সকল সদস্য এবং সকল সাংসদ ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করেন। সেদিন ঐ ধর্মনিরপেক্ষ সংসদ বহির্ভূত দলগুলি তার প্রতিবাদে ঢাকার রাজপথে মিছিল করে সংসদ ভবনে গিয়ে স্পীকারের কাছে স্মারকলিপি দিতে চাইলে পুলিশ লাঠি চার্জ করে এবং তাতে মিছিলরত কয়েকজনের দেহের রক্ত রাজপথকে রক্তরঞ্জিত করে। ঐ মিছিলে আমিও ছিলাম দলীয় নেতৃস্থানীয়। আর একই সাথে সেদিন মুচকি হেসেছিল জামায়াত-হেফাজত ও জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি কারণ সরকারের ঐ পদক্ষেপ প্রমাণ করেছিল তারা সাম্প্রদায়িক শক্তির দাবী মানতে বিলম্ব করে নি। উল্লেখ্য, ঐ অপশক্তিগুলি বিসমিল্লাহ-রাষ্ট্রধর্ম অক্ষুণ্ণ করার দাবি জানিয়ে আসছিলো। তাই তারা ঐ পঞ্চদল সংশোধনী পাশের ঘটনাকে তারা সঙ্গতভাবেই তাদের আদর্শের বিজয় বলে প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছিল।

ফলে আজকের যে সকল তরুণ-তরুণীরা বিভ্রান্ত হয়ে বিপথগামী হচ্ছে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং অত্যন্ত সম্ভ্রম পরিবারের সন্তান হয়েও তার বহুমাত্রিক কারণের মধ্যে অন্তত: একটি এই “বিসমিল্লাহ রাষ্ট্রধর্ম” বিধান সম্বলিত জগাখিচুড়ি কিন্তু স্পষ্টত:ই “Islamic” Secularism সম্বলিত সংবিধানের মধ্যেই নিহিত রয়েছে-রয়েছে বিপথগামী হওয়ার প্রচ্ছন্ন প্রেরণাও। আইন প্রণেতারা এই মাসেই প্রয়োজনে সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে বাহাত্তরের মূল সংবিধানকে অবিকল পুন:স্থাপন করলে তরুণতরুণীদের বিপথগামী হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ও প্রেরণা দূর করতে পারেন দেশ ও জনগণের স্বার্থের দিকে নজর দিয়ে।

বাহাত্তরের মূল সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঙালির আদর্শগত উৎকর্ষ সাধনের অনুকূল ছিল। এবং ছিল বলেই বঙ্গবন্ধু এর প্রতি অনুমোদন দিয়েছিলেন। নিজে ব্যক্তিগতভাবে মুসলমান হওয়া স্বত্বেও এবং বাল্যকালে মুসলিম লীগর ক্যাডার হয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে ও জীবনে প্রবেশ করলেও-পরিণত জীবনে এসে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পরিত্যাগ করতে এবং নিজেদের হাতে গড়া আওয়ামী মুসলিম লীগকে মাত্র ৭ বছরের মাথায় (১৯৬৫ সালে) অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত করার জন্য মওলানা ভাসানীর সাথে তিনিও উদ্যোগী হন। পাকিস্তান আমলে ঢাকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে অন্যান্যদের সাথে স্বয়ং তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ মিছিল বের করেন ও দাঙ্গা প্রতিরোধে সক্রিয়ভাবে প্রয়াসী হন। কিন্তু আজকের আওয়ামী লীগ? হাজারো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চোখে দেখেও তার বিরুদ্ধে সামান্যতম আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না-প্রতিবাদ মিছিল তো দূরের কথা।

বাহাত্তরের মূল সংবিধানে প্রতিটি তরুণ-তরুণীকে আদর্শগতভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক ও শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে  সকলতে দলক্রমে অসাম্প্রদায়িক ভাবধারায় ও শোষণমুক্ত, বেকারত্বমুক্ত, সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। ঐ ধারকে বজায় রাখলে, বঙ্গবন্ধুর ও মুক্তিযুদ্ধের নীতিমালাকে অক্ষুণ্ণ রাখলে এবং জিয়া, এরশাদের আদর্শের “বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম” প্রভৃতিকে সংবিধানে স্থান না দিলে আজ আমরা নিত্য রক্তঝরা বাংলাদেশ দেখতাম না। দেখতাম একাত্তরের মত ইস্পাত, কঠিন জাতীয় ঐক্য শীর্ষক ভিত্তিতে আরও দৃঢ় হতে।

সাপ্তাহিক ছুটি হিসেবে শুক্র-শনিবারে তো পাকিস্তান আমলেও ছিল না-বঙ্গবন্ধুও করেন নি-করলা বর্তমান সরকার সকল ব্যবসায়ী সংগঠন ও সুধীজনদের বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে। দেশের বিমানবন্দরগুলির নামের ইসলামাইজেশন করলো বর্তমান সরকার-কিন্তু এমনটা তো পাকিস্তানও করেনি। তারা দিব্যি করাচী এয়ারপোর্ট, লাহোর এয়ারপোর্ট, ইসলামাবাদ এয়ারপোর্ট, জেদ্দা এয়ারপোর্ট প্রভৃতি দিব্যি কাজ করছে কিন্তু বাংলাদেশ অতি-ইসলামী পথ ধরে কার্যত: এই ধর্মীয় রাজনীতি এবং জেহাদি কার্যক্রমের ভিত্তি রচনা করেছে।

আগস্ট ২০১৬ আমাদের পথ দেখাক-আইন সন্ধান হোক, ত্রুটি-বিচ্যুতি দূরীকরণের মাস হোক, একটি প্রাণোজ্জ্বল শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনার পথ প্রশস্ত করুক। বঙ্গবন্ধুর সেই আওয়ামী লীগ হারিয়ে গেছে-পুনরায় সেই আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনা হোক দেশ ও জাতির স্বার্থে।

রণেশ মৈত্র, লেখক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক; মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ইমেইল : [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ