প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
শারমিন শামস্ | ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
মানবতার নতুন সংজ্ঞা শিখছি! আমার পরিচিত লোকজনই শেখাচ্ছেন। তারা মানবতার ধ্বজা উড়িয়ে চলেন, সবাইকে ভালোবেসে সুখি বাংলাদেশ গড়তে চান। এদের কেউ কেউ বাংলার চেয়ে ইংরেজিটাই বেশি বলেন, দেশের বাইরেই কাটে তাদের অধিক সময়।
আর যদি বলি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানেন কি না? ওই যে ‘তিরিশ লক্ষ মানুষের রক্ত আর দুই লাখ বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এসেছে বাংলার স্বাধীনতা’- এই লাইনখানা নির্ঘাত শুনিয়ে দেবেন। তাদের ইতিহাস বিদ্যার দৌড় ওই পর্যন্তই।
আবার কেউ কেউ আছেন অ্যামনেস্টির মত মানবতাবাদী, ভিতরে ভিতরে সিঁদ কাটেন, আমরা টের পাই না। পাইলেও কিছু কইতে পারি না। সভ্যসমাজে বসবাসের সীমাবদ্ধতা এখানেই যে, টের পাইবার পরও মানসিকভাবে একটা পুরাদস্তুর রাজাকারকে আপনি জনসমক্ষে থাপরাইতেও পারবেন না। আপনাকে সয়ে যেতে হবে। এমনকি তারা যদি মানবতার নয়া নয়া সংজ্ঞা আপনারে শিখাইতে আসে, তাও।
তো মীর কাশেম নামের একটি পিশাচের ফাঁসি হচ্ছে। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার জায়া-পুত্র-কন্যা সরব। তারা শোকগাথা লিখে লিখে প্রচার করছেন।
ঘটনা হচ্ছে, এতদিন ফাঁসির পর মিষ্টি খাওয়াকে অমানবিক বলতো একটি দল। এখন আরেকটি মানবতাবাদী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যারা কয়, বাপের জন্য, স্বামীর জন্য শোক করবার অধিকার তাদের আছে। এটা নিয়ে কথা বলা নাকি অমানবিকতা।
এখন আমি তাদের কাছে জানতে চাই, শোক করার অধিকার কীভাবে তাদের আছে এবং তা আবার ঢাকঢোল পিটায়ে? একজন প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধী একজন খুনি একজন ধর্ষক একজন ষড়যন্ত্রকারীর রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে। এখানে সেই ক্রিমিনালের স্বজনদের কীভাবে ঢোল পিটায়ে শোক করার অধিকার আছে, আমি তা জানতে চাই।
আমি আরো জানতে চাই, তাদের পুত্র-কন্যা-স্ত্রীরা কি বাপের ও স্বামীর এই যুদ্ধাপরাধের কথা স্বীকার করে এখনও? তারা কি একটি মুহূর্তের জন্য অনুতপ্ত হয়েছে যুদ্ধাপরাধী বাপের একাত্তরে ঘটানো নৃশংস ভূমিকার জন্য? তাদের পিতার কৃতকর্মের জন্য তাদেরকে অভিযুক্ত করা নাকি অযৌক্তিক, তবে আমি জানতে চাই, আলাদা ব্যক্তি হিসেবে, বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে, একজন বিবেকবান মানুষ হিসেবে, একাত্তরের গণহত্যা, ধর্ষণ আর ষড়যন্ত্রের সহযোগি বাপের জন্য তারা কি এতটুকু সংকুচিত হয়েছে কোনদিন?
আর যদি তারা এ সমস্তকে এখনও অবিশ্বাস করে থাকে, তবে তো তারা বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রকেই অবিশ্বাস করে, এই দেশের অস্তিত্বে অবিশ্বাস করে, এদেশের রক্তাক্ত ইতিহাসকে অবিশ্বাস করে এবং সর্বোপরি তারা অবিশ্বাস করে এ দেশের আইনের শাসনকে। এ তো সত্য, তারা অবিশ্বাস করে একাত্তরকে, বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের ইতিহাসকে। তারা নিজেরা আলাদা কোন ব্যক্তি মানুষ হিসবে গড়ে উঠেছে- এমন কোন প্রমাণ শীর্ষ কোন যুদ্ধাপরাধীর সন্তানের ভিতরে আমরা পাইনি। বরং তারা বাপের আদর্শকে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বড় হয়ে বাপের সহযোগি হিসেবে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে নতুন নতুন ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছে।
এহেন রাজাকার সন্তানদের পিতৃশোকে একজন সুস্থ মস্তিষ্কের বিবেকবান বাঙালি কীভাবে কাতর হতে পারেন, আমি জানতে চাই।
আমার প্রশ্ন তাদের প্রতি, কেন আমি সেইসব লোকদের দুঃখে কষ্ট পাবো, যাদের বাপ ও স্বামী হাজার হাজার নিরপরাধ লোককে হত্যা আর ধর্ষণের ঘটনায় সহযোগি হয়েছিলেন এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে আজ ৪৪ বছর পর তার ফাঁসি হচ্ছে! এবং সেই ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তকে তার সন্তানরা মনে করে বীর শহীদ, ইসলামি চিন্তাবিদ!
যারা আমাকে মানবতা শেখাতে চান, যারা বলতে চান, পিতার জন্য স্বামীর জন্য শোক করা তাদের অধিকার, তাদের কাছে আমি জানতে চাই, খুন ধর্ষণের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বাপের জন্য প্রকাশ্যে শোক করে আর তাকে মহান ইসলামী নেতা বলে যারা আমার দেশ, একাত্তরের ইতিহাস ও লাখ লাখ শহীদকে অপমান করছে, সেই দুঃসাহস তারা কীভাবে পায়?
একজন অপরাধীর পুত্র কন্যা স্ত্রী কেন লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকে না? একজন গাদ্দারের ছেলেমেয়ে কেন মাটিতে মিশে থাকে না? কোন দুঃসাহসে তারা এই বাংলার মাটি দাপিয়ে বেড়ায়? উত্তর দিন।
বহুবছর আগে, তখনও স্বাধীনতা দলিল পড়িনি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পড়ালেখা ছিল সীমিত। কিন্তু যেটুকু পড়েছিলাম এবং বাবা মা আত্মীয়পরিজনের মুখে যা শুনেছি, তাতেই জানতাম কী ভয়ংকর দিন পাড়ি দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ উনিশ একাত্তরে। পরে একদিন হাতে এলো রশীদ হায়দারের সম্পাদনায় ‘একাত্তরের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা’ বইটি। স্বাধীনতার দলিল থেকে নেয়া কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান তুলে ধরা হয়েছে সেই বইতে। তাদের মধ্যে নীলিমা ইব্রাহীমের অভিজ্ঞতা যেমন আছে, তেমনি আছে একাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ডোম, সুইপারের কথা, আছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে ফিরে আসা বীরাঙ্গনার নিজ মুখে বলা ইতিহাস।
সেই প্রথম আমি জেনেছিলাম, জবাই হওয়া মানুষের স্তূপ জমে জমে কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল পাহাড়, কীভাবে ধর্ষণের পর যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে দেয়া হত জ্বলন্ত সিগারেট, রড, স্তন কেটে রেখে দেয়া হত ফর্মালিনে ডুবিয়ে, পেট চিরে বের করা হত গর্ভবতীর সন্তান।
বীরাঙ্গনা মহিলাটি বলেছিলেন, ‘এতদিন জানতাম মানুষের চুলে উকুন হয়, শরীরেও যে উকুন হয়, তা জানলাম একাত্তরে’। আমি এইসব বয়ান নির্বাচন ও গ্রন্থনা করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রাঙ্গণে একটি পাঠ অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। নাম ছিল: ১৯৭১। অনুষ্ঠান শেষ হলে আমার বাবা অশ্রুভরা চোখে আমাকে বলেছিলেন, ‘কোন মানে হয় না। কেন তুই এইসব আবার মনে করায়ে দিলি’!
মনে আছে, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে একটি শিশুর জামা আছে রাখা। একাত্তরে শিশুটির বয়স ছিল তিনমাস। পাক আর্মি আর রাজাকার ঘরে ঢুকে তাকে আছড়ে মেরেছিল। বহুবছর পর শিশুটির বাবা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে জামাটি দিয়ে দেয়।
আজ যখন এই লেখাটি লিখছি, এখনও চোখভরা পানি নিয়ে লিখছি। আমি একাত্তর দেখিনি। এর বহু বছর পর আমার জন্ম। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। যে রক্তস্নানের অধ্যায় পার করে এসেছে আমার দেশ আমার দেশের মানুষ, আমিও তার অংশ। যদি আমি মানুষের রক্ত ধারণ করি দেহে, যদি খেয়ে থাকি দেশের নুন, যদি আমি মানবতার কথা বলি, তবে আমার এই অশ্রুর চেয়ে সত্য আর পবিত্র কিছু নেই। যদি আমি আমার সন্তানকে শেখাতে চাই ভালোবাসা আর প্রেম, তবে সবার আগে ভালোবাসতে শেখাবো তাকে বাংলাদেশকে, বাংলাভাষাকে। সবার আগে তাকে চেনাবো দেশের শত্রুকে।
যে অপরাধ ৪৪ বছর আগে করে গেছে সাকা, মীর কাশেম, মুজাহিদ, নিজামীরা, আজ তার ধারাবাহিতা রক্ষা করে চলেছে তাদের সন্তানসন্ততি, তাদের আত্মীয় বন্ধুরা। তবে কীসের মানবতা তাদের জন্য? কীসের সহমর্মিতা? আমি জানতে চাই। আমি আমার প্রশ্নের উত্তর সত্যি সত্যি চাই।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য