প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জাহিদ নেওয়াজ খান | ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
আমরা অভাগা। আমরা আমাদের পথটা ঠিকঠাকমতো পাইনি। পথ ঠিকই ছিল, কিন্তু সেটা আমাদের সামনে থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। শুধু সরিয়েই নেওয়া হয়নি, উল্টোপথেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আমাদের। সে ছিল এক কালো অধ্যায়।
সেই কালো অধ্যায় পেরিয়ে আসা আমরা, মানে যাদের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর পরে বা আগে; আমরাই ছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশে শৈশব এবং কৈশোর পার করা প্রথম প্রজন্ম। পূর্ব প্রজন্ম রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করার পর আমাদের এ প্রজন্মেরই সবচেয়ে বেশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত হওয়ার কথা ছিল। বাংলাদেশ ছাড়া আর কিছুই থাকার কথা ছিল না তাদের মস্তিষ্ক আর হৃদয়ে। অথচ, তাদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তি।
বিভ্রান্তির বীজটা বপন করা হয়েছিল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার মধ্য দিয়ে। নৃশংসতম এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে খুনিচক্রের লক্ষ্য ছিল মোটাদাগে তিনটি: ১. একটি স্বাধীন দেশ সৃষ্টির জন্য বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে হত্যা করে প্রতিশোধ, ২. তাঁর পরিবারের কেউ যাতে তাঁর পতাকাকে বহন করে নিয়ে যেতে না পারেন সেটা নিশ্চিত করা, এবং ৩. যে আদর্শে তিনি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়তে চেয়েছিলেন তার মৃত্যু ঘটানো।
ষড়যন্ত্রকারীরা প্রাথমিকভাবে সফল হয়েছিল। সফল হয়েছিল বলেই ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ এর আগের বাংলাদেশ আর পরের বাংলাদেশ এক ছিল না। সেটা যে শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কারণে তার শারীরিক অনুপস্থিতির কারণে এমন নয়। এটা আসলে ছিল বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্রের মাত্র সাড়ে তিন বছর নিজের অস্তিত্বে থাকার পর আবারো পাকিস্তানের রাষ্ট্রচরিত্র ধারণ করা। পরের একুশ বছর পদে পদে আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। সে কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের বড় অংশ বাংলাদেশের জন্মআদর্শের বদলে বড় হয়েছে পাকিস্তানী ভাবাদর্শে।
জাতির জনক নিহত হওয়ার সময় আমরা নিতান্তই শিশু। মনে আছে, ছিয়াত্তর-সাতাত্তরে অমর একুশেতে প্রভাত ফেরী করতে গিয়ে এ আমরা-- ছয়/সাত থেকে আট/দশ বছরের শিশুরা-- পুলিশের ধাওয়া খেয়েছিলাম। কারণ, আমরা ‘শহীদ স্মৃতি অঙ্গন’ নামে যে সংগঠনটির পতাকা বহন করছিলাম সেটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা পরিচালিত। তারা বেশিরভাগই যুবলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
সেদিন এভাবে শিশুদেরও লাঠিপেটা করে জিয়াউর রহমানের জান্তা সরকার আসলে কয়েকটি বার্তা দিতে চেয়েছিল: ১. শহীদের নামে সংগঠন মানে রাষ্ট্রবিরোধী, ২. মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রের চোখে শত্রু, ৩. বঙ্গবন্ধুর দল এবং সংগঠনগুলোর কোন অস্তিত্ব এদেশে রাখা হবে না। এভাবে একদিকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে, অন্যদিকে কচিমনের শিশুদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু এবং তার অনুসারীদের বিষয়ে এমন নেতিবাচক ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যার প্রভাব হয়েছে সুদূরপ্রসারী।
সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পাঠ্যপুস্তকেও তখন বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে উপরের শ্রেণীর বইগুলোতে শুধু যে বঙ্গবন্ধু এবং জাতির জনক শব্দগুলোই মুছে ফেলা হয়েছে এমন নয়, মাত্র কয়েক বাক্যে তাঁকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেনো তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে আর যেকোনো একজন সাধারণ রাজনীতিক। বিপরীতে জিয়াউর রহমানকে শুধু স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়নি, এমনভাবে তার বর্ণনা এসেছে যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো তার এক ডাকেই বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে।
তবে, পাঠ্যপুস্তকে শুধু ব্যক্তির অবদানকে খাটো বা বড় করার মধ্যেই দেশবিরোধীরা সক্রিয় ছিল না। ‘ব্রেইন ওয়াশ’- এর জন্য ইতিহাস বিকৃতির পাশাপাশি পাঠক্রমও এমনভাবে তৈরি করা হয় যেখানে আসল বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মূল চেতনাকে কবর দিয়ে পাকিস্তানী ভাবাদর্শে একটি জাতি গঠনের চেষ্টা করা হয়। সঙ্গে অন্য চেষ্টা তো ছিলই। মনে আছে, জাতির জনক নিহত হওয়ার পরের কয়েক বছর স্বাধীনতা দিবস, নতুন করে চালু করা কথিত ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ এবং বিজয় দিবসে আমাদের মতো শিশুদেরকে কুচকাওয়াজে নিয়ে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান মুখস্থ করানো হয়েছে।
এসবের সঙ্গে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত তো অবশ্যই, বাংলাদেশের সুবিধাবাদী এবং চাপ নিতে অক্ষম বেসরকারি গণমাধ্যম থেকেও দীর্ঘ সময় বঙ্গবন্ধু একরকম ‘নির্বাসিত’ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে এভাবে রাষ্ট্র এবং এর সকল অঙ্গ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘নির্বাসনে’ রাখা আসলে ছিল বাংলাদেশকে অস্বীকার করা, যে মৌলনীতির ভিত্তিতে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম; সেই মৌলনীতিগুলো থেকে বাংলাদেশকে বিচ্যুত রাখা।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের বড় অংশ তাই ভুল ইতিহাস জেনে বড় হয়েছে। নিজের মূল তারা জানতে পারেনি। আসল ইতিহাসপাঠ থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হয়েছে তারা। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগ ও গৌরবগাঁথা জানার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। আসল বীরদের সম্পর্কে জেনেছে অনেক মিথ্যা, ষড়যন্ত্রকারীদের ভেবেছে বীর। শেষ পর্যন্ত তারা মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে তাই ভুল পথে হেঁটেছে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবার হত্যা করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উল্টোপথে যাত্রা নিশ্চিত করে এভাবে ষড়যন্ত্রকারীরা প্রাথমিক সাফল্য পেয়েছিল। কিন্তু, সেটা স্থায়ী হওয়ার নয়, তাই স্থায়ী হয়নি। জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা জাতির পিতার আদর্শের সংগ্রাম জারি রেখেছেন, তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের পতাকাকে উঁচু থেকে আরো উঁচুতে তুলে ধরেছেন। সঙ্গে সাংস্কৃতিক সংগ্রামটাও অব্যাহত ছিল। আর ছিল বাংলাদেশের মানুষের মনে বঙ্গবন্ধুর জন্য অপরিসীম ভালবাসা। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর আদর্শ তাই আবারো বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে সমাসীন।
এখনকার প্রজন্ম তাই বেড়ে উঠার সঙ্গে সত্য যেমন জানতে পারছে তেমনি সত্য আদর্শকে ধারণ করার সুযোগও তাদের সামনে। তবে, ষড়যন্ত্র কিন্তু থেমে নেই। পাকিস্তানের যে প্রেতাত্মারা জাতির জনককে হত্যা করেছিল, তারা ফিরে আসার চেষ্টা রেখেছে। পাকিস্তান শুধু একটি ভূ-খণ্ডের নাম নয়, পাকিস্তান একটি অপআদর্শেরও নাম। নানা নামে নানাভাবে তারা ফিরে ফিরে আসতে চায়। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের নতুন যে সমস্যা সেটাও সেই অপ-ভাবাদর্শ থেকেই এসেছে। নতুন যে প্রজন্ম সত্য জেনে বড় হচ্ছে, তাদের সামনে দায়িত্বটা তাই আরো বেশি।
[১৫ আগস্ট ২০১৬ জাতীয় শোক দিবসে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রকাশনা "মাতৃভূমি"-তে প্রথম প্রকাশ]
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য