আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

আট মিনিটের ভিডিও এবং সমাজ বদলের আজাইরা চিন্তা

শারমিন শামস্  

ঘটনা অত্যন্ত পুরাতন, চিরাচরিত ও নিয়মমাফিক। আট মিনিট উনত্রিশ সেকেন্ডের একটা ভিডিও বের হয়েছে। প্রেমিক প্রেমিকার অন্তরঙ্গতার দৃশ্য ধারণ করে নিজ দায়িত্বে প্রেমিকটি ভিডিওখানা আপলোড করে দিয়েছে। এই ভিডিও’র মূল আকর্ষণ মেয়েটির স্তন, কোমর, যৌনাঙ্গ এবং যৌনকর্মে মেয়েটির স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। যদিও যৌনকর্ম পুরুষের পুরুষাঙ্গ, অন্ডকোষ প্রদর্শন ছাড়া ঘটে না এবং পুরুষটিরও স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকে, তবু ভিডিও’র আকর্ষণ মেয়েটির দেহ ও তার অ্যাকটিভ রোল। ভিডিও দেখার পর দর্শকদের প্রতিক্রিয়া, ‘মেয়েটি বেশ্যা, মেয়েটি নষ্ট।’ একটি অন্তরঙ্গ ভিডিও ধারণ করে তা আপলোড করে দেয়ার মত অপরাধ যে পুরুষটি করেছে, তার জন্য বাংলা ডিকশনারিতে সমার্থক কোন শব্দ নাই, শব্দ সৃষ্টির কারো কোন ইচ্ছাও নাই। যদিও জিগালো বলে একটি পেশা আছে, কিন্তু কোন পুরুষকে এখন পর্যন্ত ‘জিগালো’ বলে গালি দেয়া হয়েছে কি না, আমার জানা নাই।

এইসব কথা বহুল চর্চিত, পুরুষটির আস্পর্ধা আর রুচি দেখে অনেকেই স্তম্ভিত। মেয়েটি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। আমি জানি না, তার এখন কী অবস্থা। এদেশের মেয়েরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে জন্মায়, বড় হয়, বারবার লাথি খায়, তারপরও আপাদমস্তক একটি পুরুষতান্ত্রিক পুরুষকে মেনে নিয়ে তার সাথে প্রেম করে, তাকে বিয়ে করে, বাচ্চাকাচ্চা জন্ম দেয়, তারপর সেই পুরুষের লাথি সহ্যের বাইরে চলে গেলে মাঝে মাঝে ভেউ ভেউ করে কান্দে। যে পুরুষের সাথে মেয়ের যৌনসম্পর্ক ছিল, এখন সেই ছেলে তার ভিডিও ছেড়ে দিয়েছে, এমন এক পুরুষের লাথি খেয়ে মেয়েটা আত্মহত্যার উদ্যোগ নিয়েছিল- এইটা খুবই সাধারণ, অতি সাধারণ ঘটনা। এইসব সাধারণ ঘটনাই তো হরহামেশা দেখি। তবে কি এই সমাজে অসাধারণ কিছু ঘটে না?

ঘটে। এই সমাজে, এখন পর্যন্ত আমার দেখা সবচেয়ে সাহসী মেয়েটার নাম -প্রভা, সাদিয়া জাহান প্রভা। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আমি কখনো কোন মানুষকে স্যালুট করার কথা ভেবেছি কি না, তবে আমার উত্তর হবে- প্রভাকে আমি বহু, বহুবার স্যালুট করতে চেয়েছি এবং এখনো চাই। যদি কখনো তার সাথে দেখা হয়, আমি আমার শ্রদ্ধার কথা তাকে অবশ্যই জানাবো। প্রভা হলেন সেই মেয়ে, যে শুধু তার চরিত্রহীন প্রেমিক রাজীব আর মেরুদন্ডহীন প্রাক্তন স্বামী অপূর্বই না, এই তাবৎ সমাজ সংসারের মুখে সবচেয়ে সশব্দ চড়টি মারতে পেরেছেন। তিনি নিজেকে মানসিকভাবে সুস্থ রেখেছেন, উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং নিজের কাজের জগতে পূর্ণ উদ্যমে ফিরে গেছেন। এই সমাজে প্রভার ভিডিও এখনো অলিতে গলিতে, কুশীল ও সুশীলের গোপন পকেটে মোবাইলে পিসিতে চলছে, ‘নষ্ট মেয়ে’ বুঝাতে ‘প্রভা’ নামে মেয়েদের ডাকা হচ্ছে- তাতে প্রভার কিচ্ছু যায় আসে না, তা তিনি বহু আগেই প্রমাণ করে দিয়েছেন। আমি জানি, কাজের জগতে এখনো বহু পুরুষ মহিলা তাকে নানাভাবে হেনস্তা করার চেষ্টা করে চলেছেন, কিন্তু এই কুৎসিত বিকারগ্রস্থ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিময়ী মেয়েটির নাম- প্রভা। আমি বিশ্বাস করি এইসব খড়কুটো নোংরা জঞ্জাল নিতান্ত অবহেলা ভরে দুহাতে সরিয়ে পথ তৈরি করে সামনে এগিয়ে যাবেন তিনি।

এই দেশে ধর্ষণ হলে মেয়ে সুইসাইড করে। কেন করে? কারণ, সমাজে ধর্ষণের অন্য নাম- সম্ভ্রমহানি। সমাজ এবং বাংলা ভাষাবিদদের ধারণা, মেয়ের সম্ভ্রম তার ভ্যাজাইনাতে থাকে। এখন সম্ভ্রম যে ভ্যাজাইনাতে থাকে না, সেটা বুঝানোর কাজটা কে করবে? কীভাবে করবে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজের লোকেরা কি কাজটা মেয়ের হয়ে করে দেবে? জীবনেও না। ডিকশনারি থেকে সম্ভ্রমহানি শব্দখানা উঠায় দেয়ার দাবি তুলতে হবে মেয়ে আপনাকেই। ইজ্জত গেছে বলে ধর্ষণকে যে সংজ্ঞায়িত করবে, তারে লাথি মেরে চৌরাস্তা পার করে দেয়ার কাজটা করতে হবে তোমারেই। এখন তুমি ইজ্জতের শোকে, ভিডিওতে তোমার স্তন, যৌনাঙ্গ দেখা গেছে, লোকে তোমার অন্তরঙ্গ দৃশ্য দেখে ফেলেছে এই শোকে যদি সুইসাইড করে, কিংবা আত্মগোপনে গিয়ে, অথবা জীবন্মৃত থেকে, লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গিয়ে, কাইন্দা কাইটা জীবন কাটায়ে দাও, তবে ডিকশনারি থেকে ওই চূড়ান্ত অপমানজনক নোংরা শব্দখানা দূর করার কাজটা করবে কে? একজন বা কয়েকজন পুরুষ তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমারে ধর্ষণ করেছে, তুমি বাড়ি ফিরে গলায় দড়ি দাও কেন? তুমি যাকে বিশ্বাস করে ভালোবাসছো, সে সেইসব একান্ত মুহূর্ত বাজারে ছেড়ে দিয়েছে, তাতে তোমার ইজ্জতের হানি হয় কেন? এই সমাজ কি যৌনকর্ম করে না? সেক্স ছাড়াই চৌদ্দ কোটিতে ভরে গেছে দেশ? সেক্স কি অন্যায়? সেক্স কি নোংরা? তুমি ভালোবেসে মিলিত হয়েছো। এর চেয়ে সুন্দর কিছু নাই। ভালোবাসা, প্রেমিকের সাথে মিলিত হওয়া কি অপরাধ? তাহলে লজ্জায়, ভয়ে, অপরাধবোধে গুটিয়ে থাকার কারণটা কি? তোমার হাতে তো এখন অনেক কাজ। যে পুরুষ ভিডিও ধারণ করে তোমার বিনা অনুমতিতে তা আপলোড করলো, তোমার প্রথম এবং প্রধান কাজ তাকে আইনের মুখোমুখি করা। তাকে তার প্রাপ্য শাস্তি বুঝিয়ে দেয়া। তা না করে, একটি ক্রিমিনাল তোমার সঙ্গে অপরাধ করেছে, সেজন্য সুইসাইড করে, লোকলজ্জার ভয়ে গুটিয়ে থেকে, মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে তুমি নিজেকে কেন শাস্তি দাও? কেন তুমি লুকিয়ে থাকো?

মেয়ে, আমি চাই তুমি বেরিয়ে আসো, প্রকাশ্যে। মাথা উঁচু করে থানায় যাও, আদালতে যাও। মিডিয়ার সামনে তুলে ধরো তোমার কথা। ফিরে যাও নিজের পড়াশুনায়, কাজের জগতে, বন্ধুদের মাঝে। সবাইকে জানাও তুমি আছো, আরো বেশি করে আছো। আমি জানি, যত সহজে লিখে ফেলতে পারছি, তত সহজ নয় এটা। কিন্তু মনে রেখো, অসম্ভব নয়। তার প্রমাণ প্রভা। এই সমাজ বদলাবে, এমন ভেবো না কখনো। তোমার ভিডিও আরো বহু বহু বছর অনলাইনের চোরাপথে ঘুরে বেড়াবে, সেসব দেখে বিকৃত আনন্দ পাবে কোটি কোটি পুরুষ, নোংরা ক্লেদাক্ত মন্তব্য ঝরে ঝরে পড়বে। কিন্তু তাতে কী যায় আসে তোমার? কী করেছো তুমি? চুরি? ডাকাতি? খুন না রাজাজানি? কোনটা? কোনটাই নয়। সোজা বাংলায় যাকে বলে ভালোবাসা, ভালোবেসে মিলিত হওয়া, তাই করেছ। প্রতিদিন প্রতি ঘণ্টায় প্রতি মিনিটে কোটি কোটি নারী পুরুষ এই ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে, সারা পৃথিবীতে, এমনকি ধোয়া তুলসী পাতার এই সমাজেও। তাহলে কোনটা তোমার অপরাধ মেয়ে? হ্যাঁ, অপরাধ হবে তখন, যখন তুমি নিজেকে শাস্তি দেবে, যখন তুমি মেনে নেবে অন্যায়, যখন তুমি আইনের মুখোমুখি করবে না অপরাধীকে। মনে রেখো। সেই অপরাধ ক্ষমাযোগ্য নয়!

এই সমাজকে বদলানোর কথা ভেবো না ভুলেও। বদলাও নিজেকে। শক্তিতে, সাহসে, আত্মবিশ্বাসে, আধুনিক চিন্তায়, মননে যত পরিপক্ক হবে তুমি, তত শক্ত ভিত গড়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারবে। এই সমাজ তো দাঁড়িয়ে আছে এক মিথ্যে কপট ভন্ড চিন্তা ও জীবনযাপন কাঠামোয় ভর করে। এই সমাজের চোখে নিজেকে পবিত্র আর নিষ্পাপ বলে প্রমাণ করতে চাও কেন? তাতে কার স্বার্থ হাসিল হয়? কে হয় লাভবান? নিজেকে এইবার মুখোমুখি করো এইসব প্রশ্নের। যদি খুঁজে পাও সত্য জবাব, আমি বিশ্বাস করি, তুমি এরপর আজীবন মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে চাইবে, নষ্ট গলিত সমাজ আর ততধিক নষ্ট লোকেদের পৃষ্ঠদেশে লাথি মেরে।

শারমিন শামস্, লেখক, স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ