প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মো. মাহমুদুর রহমান | ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
কাগজের পাতায় অনেক খবর আসে, আবার অনেক খবরই আসে না। আর এ কথাটি বাংলা জনপ্রিয় একটি গানে এসেছে এভাবে- ‘প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে, জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে।’
অবশ্য জীবনের কোন ঘটনাটি খবর আর কোনটি নয়- এ বিষয়ে সাংবাদিকদের কিছু পেশাগত নির্দেশনা রয়েছে। তাই সাধারণ মানুষের চিন্তা এবং পেশাদার সাংবাদিকের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। খবর নিয়ে এসব ভাবনার সূত্রপাত একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইনে ‘সুইপার কেন চিকিৎসক?’ শিরোনামে ঢাকা মেডিকেল কলেজে একজন রোগীর মৃত্যুর সংবাদ। খবরে জানা যায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত বিপ্লব মণ্ডল কয়েকদিন আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২০০ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হন। ঘটনার দিন হঠাৎ রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু হলে সুমন নামে একজন চিকিৎসক সেজে তাকে চিকিৎসা দেন। রোগীর ভাই ইনজেকশন আনার আগেই অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে সুমন রোগীর মুখে চেপে ধরেন। এতে রোগী মারা যান। পরে রোগীর আত্মীয়-স্বজন ও বিক্ষুব্ধ জনতা সুমন কে প্রহার করলে কর্তব্যরত আনসার সদস্যরা তাকে উদ্ধার করার পর পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
২৩ সেপ্টেম্বর পত্রিকার অনলাইনে সিনেমাটিক শিরোনামের খবরটির পর একই পত্রিকা দুদিন পর ২৫ তারিখ সম্পাদকীয় পাতায় ‘ওয়ার্ডবয়ের ডাক্তারি!’ শিরোনামে মতামত প্রকাশ করে। এতে দেখা যায় প্রথম খবরটি অসত্য তথ্যে ভরপুর ছিল। এখানে ঘটনার নতুন বর্ণনায় বলা হয়েছে, রোগীর শ্বাসকষ্টের উপশমের জন্য ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ি রোগীর ভাই ওষুধ এনে নেবুলাইজ করার জন্য নার্সকে অনুরোধ করেন। নার্স ওয়ার্ডবয় সুমনকে পাঠান নেবুলাইজার লাগানোর জন্য। রোগীর ভাই এতে আপত্তি করলে নার্স তাকে বুঝিয়ে বলেন নেবুলাইজার মাস্ক ওয়ার্ডবয়রাই লাগান। কিছুসময় নেবুলাইজ করার পর রোগীর মৃত্যু হয়। এতে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে সুমনকে প্রহার করলে আনসার ও পুলিশ তাকে উদ্ধার করে ধরে নিয়ে যায়।
প্রথম দিন খবরে সুমনকে অপরাধী মনে হলেও দুই দিন পরের প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতার মতামত পড়ে সুমনের জন্য খুব মায়া হয়। কারণ ওইদিন জাতীয় সংসদেও একজন সংসদ সদস্য বিষয়টি তুলে ধরেন। প্রথমে সুমনকে ডাক্তার ছদ্মবেশ ধারণের অভিযোগ থাকলেও দ্বিতীয় দিনের বর্ণনা অনুযায়ি সে শুধু কর্তব্য-কাজ করেছে সিনিয়রের নির্দেশে এবং রোগীর সাথের লোকজনের জ্ঞাতসারে। অথচ তাকে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে পুলিশ কাস্টডিতে যেতে হয়েছে। দুটো খবর এবং সংসদ সদস্যের বক্তব্য পড়ে আমার মনে হয়েছে উনারা দেশের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা তো দূরে থাক সাধারণ ওয়ার্ডগুলোতে কোনো রোগী দেখতেও যান কিনা সন্দেহ। নতুবা জানা থাকার কথা ছিল প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার দুই থেকে তিন গুন বেশি রোগীকে চিকিৎসা দিতে হয় কর্মকর্তা কর্মচারীর স্বল্পতা নিয়ে।
একটা ওয়ার্ডে ৬০-৭০ জন রোগীর জন্য দুজন নার্স, একজন ওয়ার্ডবয়, একজন মাসি এবং দু’তিন জন ডাক্তার থাকেন। অথচ বাস্তবে তাদেরকে চিকিৎসা দিতে হয় দ্বিগুণের চেয়েও বেশি রোগীকে। এই চিকিৎসা দিতে গিয়ে ইন্টার্ন ও বিভিন্ন উচ্চতর কোর্সে অধ্যয়নরত ডাক্তার ছাড়াও নতুন ডাক্তাররা অমানুষিক পরিশ্রম করেন অস্বাভাবিক ধৈর্য নিয়ে। একই সাথে নার্স, মাসি ও ওয়ার্ডবয়রাও কঠোর পরিশ্রম করে। অত্যধিক রোগীর চাপ সামলাতে গিয়ে তারা নিজেদের মতো কাজগুলো ভাগাভাগি করে নেন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ওয়ার্ডবয় বা মাসিরা অক্সিজেন মাস্ক বা নেবুলাইজার মাস্ক লাগান। সরকারি হাসপাতালে বিগত সময়ে যারা চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের বেশিরভাগের এ অভিজ্ঞতা রয়েছে। সচরাচর স্বাভাবিকভাবে এ ঘটনাগুলো ঘটলেও পত্রিকায় খবর হয়না, হয়েছে সাথে মৃত্যু যোগ হওয়ায়। আর যারা ভারত বা সিঙ্গাপুরে গিয়ে চিকিৎসা নেন তারা সবাই দেশের সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে সচেতন হয়েছেন। এটা ভালো লক্ষণ। তবে মূল সমস্যা সমাধান না করে এরকম অতিসচেতনতা অনেক সমস্যার সৃষ্টি করে। সাধারণ মানুষ হাসপাতালে সেবা প্রদানকারীদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা পায়। এ পূর্বধারণা নিয়ে হাসপাতালে গেলে রোগীর আত্মীয়-স্বজনের সাথে ডাক্তার, নার্স ও স্টাফদের সংঘাত সৃষ্টির আশংকা থাকে। আর অন্যদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে নির্ধারিত সংখ্যার অতিরিক্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি করবে না তাহলে হাসপাতালের বারান্দায় নয় খোলা আকাশের নীচে রোগ নিয়ে বসে থাকতে হবে অনেক রোগীকে তা কি ভেবে দেখেছেন কেউ?
ওয়ার্ডবয়দের প্রতিদিনের ড্রেসিং, মাস্ক লাগানো এগুলো খবরে আসে না। হয়তো এগুলো খবর নয় তাই। তবে কোনোদিন তাদের কাজের সাথে মৃত্যু যোগ হলে তাকে উত্তম-মধ্যমের সাথে কাগজের পাতায়ও তা আসে। আসে তা খুব নিষ্ঠুরভাবে। তখন সুমনদের প্রতি কারো সহানুভূতি থাকে না।
এভাবে মানব জীবনের অনেক বিষয়ই খবর নয়। যেমন কার বাড়িতে টয়লেট আছে কার নেই এটা যেমন খবর নয়, তেমনি কে খোলা জায়গায় হাগু-মুতু করে তাও খবর নয়। তবে খোলা জায়গায় মলমুত্রত্যাগকারী কেউ হেলিকপ্টার ভাড়া করে বিয়ে করতে চাইলে মানুষের হাসি পায়। আর খোলা জায়গায় মলমূত্রত্যাগের সাথে বিমান দিয়ে বিয়ের শখ জাগায় তা খবর হয়ে যায়।
সম্প্রতি ভারতে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। বিবিসি’র বরাত দিয়ে দৈনিক যুগান্তর গত ১৯ সেপ্টেম্বর একটি খবর ছাপে। এখানে দেখা যায়, ভারতের মধ্যপ্রদেশের সিহোর জেলার আজমতনগর গ্রামের বাসিন্দা গুরজ সিং গুর্জ-এর শখ হয় তার ছেলে নেম সিংয়ের বিয়েতে হেলিকপ্টারে বরযাত্রা করার। হেলিকপ্টার ভাড়া দেয়ার আগে গুরজ সিংয়ের বাড়ির খবর নিয়ে জানা যায় তার বাড়িতে কোনো শৌচাগার নেই। তাই তাকে হেলিকপ্টার ভাড়া দেয়া হয়নি। শৌচাগার ছাড়া খোলা জায়গায় সারাবিশ্বে যত মানুষ শৌচকর্ম করে তাদের প্রায় শতকরা ষাট শতাংশের বসবাস ভারতে। ভারত সরকার ২০১৯ সালের মধ্যে সবার জন্য শৌচাগার নিশ্চিত করতে চায়। তাই কোন ব্যক্তির বাড়িতে শৌচাগার না থাকা ভারতের জন্য খবর নয়। খবর হয়েছে হেলিকপ্টারে বরযাত্রার শখ-এর সাথে যোগ হওয়ায়।
এ খবরটির সাথে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কিছু বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা মিলে যায়। প্রায় দুই মাসের কাছাকাছি হাসপাতালের কেবিনে বাবাকে নিয়ে থাকার সুবাদে কিছু জিনিস চোখে পড়ে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে হাসপাতাল ফ্লোরে খোলা জায়গায় মূত্রত্যাগ। পাঁচ তলা হাসপাতাল ভবনের তিনতলার গাইনী ওয়ার্ডের সামনের খোলা জায়গায় রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা অবস্থান করে এবং অনেকেই রাত্রিযাপনও করে থাকে। এদের অনেকেই সন্ধ্যা হতেই পিলার ও দেয়ালের পাশে প্রস্রাব করা শুরু করে। সারারাত লোকজনের প্রস্রাবের কারণে সকালে জায়গাটিতে প্রস্রাবের বন্যা দেখা যায়। অনেকেই প্রস্রাবের উপর দিয়ে না জেনে হাঁটে। মজার বিষয় হচ্ছে পিলার ও দেয়ালের কর্নারে প্রস্রাবের পানি যেখানে জমে থাকে সেখানে দুজন ডাক্তারের অফিস রুম। এর একজন অধ্যাপিকা, অন্যজন সহযোগি অধ্যাপক। আমি কখনও উনাদের নেম প্লেট লাগানো রুমগুলো খুলতে দেখিনি। তাই উনাদের চোখে পড়ার কথা নয়। আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চোখেও পড়েনি নিশ্চয়ই। পড়লে এর একটা সুরাহা হতো। কাগজের পাতায় আসার প্রশ্নই আসে না। কারণ কে কোথায় মূত্রত্যাগ করল এটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করার সময় নেই সংবাদকর্মীদের। তবে আমার মনে হয় এই প্রস্রাবে কোনো ভিআইপি যদি পা পিছলে পড়ে পা ভেঙে ফেলতেন তখন হয়তো এটা পত্রিকার পাতায়ও আসত এবং একটা সুরাহাও হতো।
হয়তো এরকম কোনো দুর্ঘটনার পর ওসমানী হাসপাতালের যত্রতত্র প্রস্রাব করার বিষয়টির সমাধান হবে। যদিও এ সমস্যাগুলো সমাধান করা খুব কঠিন নয়। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের পক্ষেই সম্ভব। এ জন্য সংসদেও বক্তব্য দেয়ার দরকার নাই কিংবা পত্রিকায় সম্পাদকীয় প্রকাশেরও দরকার নেই।
এ দেশে অঘটন ঘটার আগেই প্রো-একটিভ হয়ে সার্বিক সমস্যা সমাধানের নজির খুব কম। কারো মৃত্যু বা কারো নাজেহাল হওয়ার আগেই স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে সরকার পর্যাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে উদ্যোগ নিলে জনগণ উপকৃত হবে!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য