আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

বঙ্গবন্ধুর কথা বড় মনে পড়ে হে!

ইমতিয়াজ মাহমুদ  

বঙ্গবন্ধুর কথা বড় মনে পড়ে হে। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা যখনই কোন বড় অর্জন করে তখনই এই লোকটার কথা মনে পড়ে। এই পৃথিবীতে বাঙালিকে সকলের আগে আর সকলের উপরে দেখার কি তীব্র আকাঙ্ক্ষাই না ছিল এই লোকটার।

এই যে আজকে (৩০ অক্টোবর) বাংলাদেশ ইংল্যান্ডের সাথে টেস্ট ম্যাচটা জিতল, এটা তো বাংলাদেশের খেলাধুলার ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর আগে আমরা জিতেছি জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে, হতবল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। যেগুলিকে বলে বড় দল, সেইরকম একটা বড় দলের সাথে আমাদের এই প্রথম একটা টেস্ট ম্যাচ জয়।

এর আগে আমাদের ছেলেরা ভালো খেলেছে অনেক- জয় পায়নি। বাংলাদেশের প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসেই ভারতের বিরুদ্ধে চারশর উপর রান করে বাংলাদেশ সবাইকে একটু চমকেই দিয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল ঐ এক ইনিংসই। মুলতানে আমরা পাকিস্তানের সাথে জিততে জিততেও হেরে গেছি। এইরকম ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বড় দলের বিরুদ্ধে এইরকম বিজয় এইটাই প্রথম। মাইলফলক।

এইরকম ঘটনা ঘটলে, যখনই ঘটে, প্রথমেই আমার কেবল মনে হয় বঙ্গবন্ধুর কথা। আহা, এই লোকটা যদি আজকে থাকতেন তিনি কিভাবে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানাতেন! তিনি কি আমার মতোই বুকের গভীরে জয় বাংলা বলে চোখের জল লুকাতে চেষ্টা করতেন? মনে হয় না। তিনি অনেক বড় মানুষ ছিলেন। অনেক বড়। বাঙালির গৌরবগাঁথা নিয়ে অহংকারের সুযোগ তিনি এমনিই ছেড়ে দিতেন না। চোখের জল- সে তো বঙ্গবন্ধুর ছিলই। বাঙালির জন্যে বঙ্গবন্ধুর চোখের জল কি আমরা দেখিনি? দেখেছি তো। গৌরবের দিনেই অহংকার করেই তিনি চোখের জল ঝরিয়েছেন।

আজকে যদি তিনি থাকতেন, আজকের এই অহংকারের দিনে, অর্জনের দিনে, গৌরবের দিনে।


১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এর কথা মনে আছে আপনাদের? বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছেন। এই প্রথম তিনি স্বাধীন দেশের মাটিতে পা ফেলেছেন। লক্ষ লোক জড়ো হয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে বরণ করতে। বঙ্গবন্ধু অঝোর ধারায় কাঁদছেন। তাঁর দরাজ গলা ভেজা। তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত তর্জনী তুলে বলছেন, "বাংলাদেশকে কেউ দমাতে পারবে না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সাতকোটি বাঙালিরে হে বঙ্গ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ কর নি। কবিগুরুর কথা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।" কান্নায় বঙ্গবন্ধুর গলা বন্ধ হয়ে আসে, বাঙালিকে নিয়ে তাঁর অহংকার কমে না।

সেই বক্তৃতা এখন ইউটিউবে দেখা যায়। আমি সুযোগ পেলেই গোপনে সেই বক্তৃতা দেখি। বঙ্গবন্ধু কাঁদছেন। কিন্তু সেই কান্নার মধ্যেই নিজের জাতিকে নিয়ে তাঁর সে কি অহংকার! 'আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে'। বাঙালিকে নিয়ে এইরকম বুক ঠুকে অহংকার আর কে করেছে কবে? কি প্রবল ভালোবাসায় একজন নেতা তাঁর দেশবাসীকে নিয়ে এইরকম মাথা উঁচু করে বুক ঠুকে বলতে পারে 'আমার বাঙালি মানুষ হয়েছে' সেটা আমি অনুমান করতে চেষ্টা করি। আপনি একটু ভাবেন তো এই লোকটা আমাদেরকে কিরকম ভালবাসতেন!

শিল্পী শাহাবুদ্দিনের কাছে শুনেছি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর ফ্রান্সে যাওয়ার কথা বলছেন। "বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু’র একটি কথাই আমার দেশের বাহিরে আসার ক্ষেত্রে অনেকটা কাজ করছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আর্ট কলেজের বিষয়ে কথা বলার জন্য আমি তাঁর সাথে একবার দেখা করতে গেলাম। সেদিন তিনি আমকে বললেন, “তুই তো ভাল ছবি আঁকিস, তোকে কিন্তু অনেক বড় হতে হবে”- এই কথাটি বলেই কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বললেন, “তোকে ফ্রান্সে যেতে হবে। পিকাসোকে মার দিতে কি পারবিনা? আর তুই তো একজন মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধারা সব পারে”।

কি সরলতা? 'পিকাসোকে মার দিতে পারবি না'। পৃথিবীতে সবার উপরে তিনি বাঙালিকে দেখতে চেয়েছিলেন। কি আস্থা! মুক্তিযোদ্ধারা সব পারে!


আপনারা যারা অপেক্ষাকৃত তরুণ, আপনারা এই অনুভূতি পুরোপুরি বুঝতে পারবেন কিনা জানিনা। সারা পৃথিবীতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে একটা হতচ্ছাড়া ফকিরা টাইপ জাতি হিসাবে পরিচিত ছিলাম। কিন্তু এরকম হওয়ার কথা ছিল না। আমরা যখন যুদ্ধে জিতেছি, দেশ স্বাধীন করেছি, তখন সারা দুনিয়া আমাদের দিকে সম্মানের চোখে তাকিয়েছে। অবাক বিস্ময়ে দেখেছে, খর্বাকৃতি কালচে গয়ের রঙের একটা গান গাওয়া আলস্যে ধরনের জাতি কি বিপুল পরাক্রমে একটা অসম যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে।

সেই মর্যাদাটা আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই। বঙ্গবন্ধুকে হারানোর সাথে সাথে আমার মর্যাদাও হারিয়ে গিয়েছিল। বিজয়ী জাতি আমরা পরিণত হয়েছিলাম ভিখিরির জাতিতে।

আপনারা এখন যখন পেছন ফিরে দেখবেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির ইতিহাস দেখবেন- আপনারা দেখবেন বাংলাদেশ সম্পর্কে সেসময়ের আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার আজেবাজে কথা বলছেন। দেখবেন পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলি বাংলাদেশের বদনাম করার জন্যে তৎপর ছিল। এগুলো দেখলে আপনার মনে তখন প্রশ্ন জাগবে, 'ভাই, এতো বড় বড় শক্তিধর রাষ্ট্র, ওরা কেন বাংলাদেশের পেছনে লেগেছিল?' লেগেছিল কারণ বাংলাদেশের হাল ধরে ছিলেন তখন বঙ্গবন্ধু। ঘাড় ত্যাড়া এক নেতা- তিনি নতজানু হবেন না। ঐসব বড় বড় শক্তির এটা পছন্দ হবে কেন? এই ব্যাটা একটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীন করে ফেললো। ওরা বিরোধিতা করেও কিছুই ছিঁড়তে পারেনাই। স্বাধীনতার পরেও ওরা যখন বলছে, আচ্ছা ঠিক আছে, স্বাধীন হয়েছেন, ভাল কথা, এখন আসেন আমাদের ক্যাম্পে। বাঙালির নেতা এইসব বড় বড় শক্তিকে টেকস দিয়ে চলতে রাজি না। ওরা তাইলে বাঙালিকে পছন্দ করবে কেন?

এইরকম কত কথা। বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা এসেছে বাংলাদেশে। এই রবার্ট ম্যাকনামারা ছিলেন কেনেডির পররাষ্ট্রমন্ত্রী। জাঁদরেল লোক। তার সাথে আমাদের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের ইন্টার-একশনের কথা মনে পড়ে।


বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ১৯৭৬ সন থেকেই আমরা এক অন্ধকার অমর্যাদাকর যুগে প্রবেশ করেছি। সেইসব কথা মনে করতেও গ্লানি হয়।


বঙ্গবন্ধুর কথা মনে পড়ে রে ভাই! তিনিই আমাদেরকে মর্যাদা শিখিয়েছেন। তিনিই সারা পৃথিবীকে বলেছেন, বাঙালিকে দাবাইয়া রাখবার পারবা না। আহারে কি আকুতিটা তার ছিল- বাঙালি ছেলেমেয়েরা সারা দুনিয়াকে মার দিবে। আজকে বাঙালি ছেলেরা টেস্ট ক্রিকেটে ইংরেজদেরকে মার দিচ্ছে। আজকে তিনি থাকলে তাঁর ঐ উঁচু মাথাটা আকাশ স্পর্শ করতো।

আমি নিশ্চিত বলতে পারি, আজকে তিনিই হতেন বাংলাদেশে সবচেয়ে আনন্দিত মানুষটি।

আমরা লোকটিকে মেরে ফেলেছি!

ইমতিয়াজ মাহমুদ, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ