আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

সংখ্যালঘুর অনুভূতি আর আখেরের গুড়ে আমাদের ভাগ!

শারমিন শামস্  

এই দেশে তিনটি ইস্যুতে আন্দোলন করে কখনো কোন লাভ হয় না, কোন দাবি আদায় বা কোন বিচারও পাওয়া যায় না। একটি হলো নারীর প্রতি সহিংসতা, দ্বিতীয়টি সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং তৃতীয়টি পাহাড়ের আদিবাসীদের ওপর বাঙালি সেটেলারদের নির্যাতন।

মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্ট ধর্মের মানুষেরা মুসলমানদের চেয়ে সংখ্যায় কম বলে এই দেশে তাকে সংখ্যালঘু বলে শুধু ডাকাই হয় না, তার যাবতীয় অধিকার, দাবি, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তিকে লঘু করেও দেখা হয়। তাই এই দেশে তারা সর্ব-অর্থেই সংখ্যালঘু, শুধু সংখ্যায় নয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর আর মাধবপুরে অসংখ্য মন্দির ভাংচুর করা হয়েছে। হিন্দু বাড়িঘরে লুটপাট চালানো হয়েছে। শুক্রবার নাসিরনগরের হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাসের ফেসবুক পাতায় একটি পোস্ট নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত। যে পোষ্ট দেখে অনুভূতি আক্রান্ত কিছু মুসলিম হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে প্রবল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েন হিন্দুদের বাড়িঘর মন্দিরে। দেবদেবীর মূর্তি ভেঙ্গে, জিনিস লুট করে প্রতিশোধের আনন্দ উদযাপন করেন তারা। রসরাজের শাস্তির দাবিতে একদল মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব চত্বরে বিক্ষোভ দেখায়। আর কয়েকশ লোক সরাইল-নাসিরনগর-লাখাই সড়ক অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। অবরোধ থেকে একদল লোক দেশি অস্ত্র নিয়ে নাসিরনগর সদরের দত্তবাড়ির মন্দির, নমশুদ্রপাড়া মন্দির, জগন্নাথ মন্দির, ঘোষপাড়া মন্দির, গৌরমন্দির গুঁড়িয়ে দেয়।

উপজেলা সদরের দত্তপাড়া, ঘোষপাড়া, গাংকুলপাড়া পাড়া, মহাকাল পাড়া, কাশিপাড়া, নমসুদপাড়া, মালিপাড়া, শীলপাড়ায় হামলা হয়। ১০-১৫টি মন্দিরের পাশাপাশি দেড়শ’র বেশি বাড়িতে হামলা চালানো হয়। এ সময় কয়েকজন পূজারীসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। এই ঘটনার পর পাশাপাশি দুটি উপজেলা সদরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিজিবি মোতায়েন করা হলেও আতঙ্ক কাটছে না বলে জানিয়েছেন হিন্দু নেতারা।

এই ঘটনার আপডেট হলো, ফেসবুকে রসরাজ ‘ইসলাম অবমাননা করে’ পোস্ট দিয়েছে বলে অভিযোগ ওঠার পর পুলিশ তাকে শনিবার আটক করে। আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আর প্রতিটি ভাংচুরের ঘটনায় আলাদা মামলার প্রস্তুতি চলছে। ছয় ‘হামলাকারীকে’ নাকি গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।

তো এত বড় বড় হামলায় মামলার প্রস্তুতি নিতে নিতেই যখন ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায় আর শত শত লুটেরা দুর্বৃত্তের ভিতরে মাত্র ছয়জন সন্দেহভাজনকে ধরা যায়, তখন এ নিয়ে আর বেশি কিছু আশা করার কোন মানে হয় না। রসরাজকে ধরতে পুলিশ যত তৎপর, তাকে কারাগারে পাঠাতে যে দ্রুতগতি, সেই দ্রুততা অন্যপক্ষের প্রতিও ঘটবে, এ প্রত্যাশা বোকার স্বর্গে বাস ছাড়া কিছু নয়। তো আপনি তো বাস করেন বাংলাদেশে, এমনকি সেটা বোকার স্বর্গের চেয়েও বায়বীয় কোন অবস্থায় পৌঁছুচ্ছে এইসব বিচার আচার ন্যায় অন্যায়ের মীমাংসা বা সমাধান প্রশ্নে।

রসরাজ কী পোষ্ট দিয়েছে আমি জানিনা। শুনলাম কাবা শরীফের ওপর শিবের মূর্তির ছবি। এই পোষ্ট যদি কারো ধর্মানুভূতিকে আঘাত করে, তবে তার প্রতিশোধ হিসেবে নেয়া সক্রিয় কর্মকাণ্ড- অর্থাৎ উপাসনালয়ে ভাংচুর, বিশেষ ধর্মের লোকের বাড়িতে লুটপাট, সন্ত্রাসও ধর্মানুভূতিতে আঘাত এবং এই আঘাত মাত্রায়, পরিমাণে, সংখ্যায়- যেকোনো হিসাবে অনেক বেশি এবং তা চরম আকারে ক্ষতিকর। কারণ এই আঘাতে শুধু বিশেষ ধর্মাবলম্বীর মানসিক দিকটিই আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি, সেইসাথে অবকাঠামো, সম্পদ, সম্পত্তির ক্ষতিসাধন হয়েছে এবং দৈহিকভাবেও বেশ কিছু মানুষ আহত হয়েছেন। কিন্তু এই ক্ষতিসাধনের প্রক্রিয়াটি এই দেশে এখন এত নৈমিত্তিক এত সাধারণ হয়ে উঠেছে যে খবরটি পড়তে পড়তেই আমরা মাছ ভাত খেয়ে ঢেঁকুর তুলে ভাতঘুমের প্রস্তুতি নিতে শুরু করবো। এবং রসরাজ নামের যে ব্যক্তিটি আজ কাঠগড়ায়, একজন হিন্দু হিসেবে এই দেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তিনি আদৌ সেই বহুল আলোচিত পোষ্টটি তার ফেসবুকে দেবার সাহস করেছিলেন কী না, সেটি ভেবে দেখার কথাও ভুলে যাব। এ ধরণের পোষ্ট দিলে কার পার্পাস সার্ভ হয়, তা যেকোনো হামলা ভাংচুরের পর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই রসরাজরা কতটুকু লাভবান হন, তা সকলেই খোলাচোখে দেখতে পাই।

এই দেশে অনুভূতির দণ্ডগুলো বিশেষ মানদণ্ডের দ্বারা রক্ষিত। তাই মুসলিম ছাড়া অন্য কোন ধর্মাবলম্বীর অনুভূতি এই দেশে তেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। অন্য ধর্মের মানুষ এই দেশে নিজেকে অচ্ছুৎ, অবহেলিত, নির্যাতিত, ন্যায়বিচার বঞ্চিত অনুভব করলে তাদের সেটা প্রকাশ করবার অধিকারও নেই। মোল্লারহাটের ধর্ষণ বা পূজা ধর্ষণের বিষয়টি নির্ভুল নারী নির্যাতনের ঘটনা হলেও এর পেছনে সংখ্যালঘুর দুর্বল সামাজিক অবস্থান, ভীত সন্ত্রস্ত পরিস্থিতি এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেও বিবেচনার জন্য কোনভাবেই বাদ দেয়া চলতে পারে না।

সংখ্যালঘু শব্দটিকেই টিকিয়ে রেখেছি আমরা আমাদের স্বার্থে। নিজেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলার ভিতরে এক অবদমিত অহংকার আর শক্তিমত্তাই এর উৎস। রাষ্ট্রীয় ধর্মকে ধারণ করে এই অহংকারের বীজ আমরা বুনে দিয়েছি আমাদের মনের গভীর অন্ধকারে। তাই মহাসমারোহে পূজা, বড়দিন, বুদ্ধপূর্ণিমা উদযাপনকে আমরা গালভরা আত্মবন্দনা দিয়ে প্রকাশ করতে থাকি আর মগ্ন থাকি মিথ্যা আত্মতুষ্টিতে। তারপর ফেসবুকে দীপাবলীর ছবির পবিত্র সৌন্দর্য নাশ করতে আমরাই নেমে পড়ি সহিংসতায়। এতে আমাদের উৎসাহ যোগায় ধর্মান্ধ রাজনীতি। আখেরের গুড় ভাগাভাগি হয় আমাদেরই মধ্যে।

তাই দিনশেষে আমরা ভালোই থাকি। প্রগতিশীলতার মুখোশ পড়ে যারা অসাম্প্রদায়িকতার গান গায়, ক্ষমতার সিঁড়িতে তাদের আসন আরো পাকা হয়। মুখোশের আড়ালে তাদের হাসি আর সংখ্যাগরিষ্ঠের পরিতৃপ্তির হাসি মিলেমিশে এক হয়ে যায়। আমার সোনার বাংলা- আমরা হয়তো একেই ভালোবাসি!

শারমিন শামস্, লেখক, স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ