প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রাজেশ পাল | ০৩ নভেম্বর, ২০১৬
৭ই নভেম্বর। “মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস”!
১৯৭৫ সালের এই দিনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তিন কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধা কে ফোর্সের খালেদ মোশাররফ বীরউত্তম, ক্র্যাক প্লাটুনের মাস্টারমাইণ্ড মেজর হায়দার বীরউত্তম , আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী কর্নেল হুদা বীরউত্তমকে। ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। কালুরঘাটের বেতার কেন্দ্রের মতো ভাগ্য আরো একবার সহায় হলো তার।
কিছু মানুষ আসলেই চরম সৌভাগ্য নিয়ে জন্ম নেন পৃথিবীতে। জিয়া তাদেরই একজন অনস্বীকার্যভাবেই। কালুরঘাটের বেতারকেন্দ্র যেভাবে একাত্তরে তাঁকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠকের সুযোগ এনে দিয়েছিল, ঠিক সেভাবেই কর্নেল তাহেরের জাসদ আর তার “বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা” কথিত সিপাহী জনতার বিপ্লবের নামে একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের হত্যা করে তাকে বসিয়ে দেয় ক্ষমতার মসনদে। আর তিনি সদম্ভে শুরু করেন, “Money is no problem” এর শতরঞ্জির খেল।
দিনটিকে বিএনপি "সিপাহি জনতার বিপ্লব " নামে বেশ ঘটা করেই পালন করে। কিন্তু , জিয়া কি জড়িত ছিলেন সেই বিপ্লবে? মোটেই নয়, তিনি তখন বন্দি ক্যাপ্টেন হাফিজের হাতে। নিজ গৃহে অন্তরীন। নিজেই ছিলেন চরম ভীত প্রাণ-শঙ্কায়।
তাহলে কারা ঘটিয়েছিল বিপ্লবের নামে সে হত্যাকাণ্ড? নিঃসন্দেহে জাসদ।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরে ভেঙে পড়ে সামরিক বাহিনীর চেইন অফ কমান্ড। খুনি নিম্নপদস্থ অফিসারদের দম্ভে তীব্র আক্রোশে ফুসতে থাকেন উচ্চপদস্থ মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা। মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের মধ্যে সৃষ্টি হয় চরম বিভেদ। এমতাবস্থায় ৩রা নভেম্বর সামরিক অভ্যুত্থান সংগঠিত হয় খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে। ক্ষমতা চ্যুত হয় মোশতাক চক্র।
ঠিক এই সময় রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে নতুন পদক্ষেপ নেয় জাসদ। রাতারাতি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর এই দলটি দীর্ঘদিন ধরেই সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে "বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা " নামের এক অতি-বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলে কর্নেল তাহেরের মাধ্যমে। সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে বিভোর তাহের, জলিল, জিয়া উদ্দিনদের মত অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ভ্রান্ত রাজনীতির শিকার হয়ে জড়িয়ে পড়েন এর সঙ্গে। ৭ নভেম্বরে জাসদ গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা মিলে সংঘটিত করে পাল্টা অভ্যুত্থান।
সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই ,
অফিসারের রক্ত চাই
শ্লোগান দিতে দিতে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করে খালেদ ,হায়দার ,হুদাকে। তাহের মুক্ত করেন জিয়াকে। বসান ক্ষমতার মসনদে।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, জিয়াউর রহমান ক্ষমতা পেয়েই চরম দমন নীতি চালান জাসদের উপর। ৭ নভেম্বরের ঘটনার সাথে জড়িত কর্নেল তাহের সহ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সাথে জড়িত অধিকাংশ অফিসার ও জওয়ানকে কোর্ট মার্শালের প্রহসনে রাতের অন্ধকারে ফাঁসি দেয়া হয়। চিরতরে পঙ্গু করে দেয়া হয় জাসদকে।
সেই যে মুখ থুবড়ে পড়েছিল তারা, আর সোজা হয়ে দাড়াতে পারেনি অদ্যাবধি। "লক্ষ্য শূন্য লক্ষ বাসনা" থাকার নাটকের এপিটাফ যে ট্র্যাজেডি, এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জাসদ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। পরবর্তীতে আসম রব, শাহজাহান সিরাজ, হাসানুল হক ইনু, মঈনুদ্দীন খান বাদলদের রাজনৈতিক অবস্থান তারই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে অদ্যাবধি। আর যার অঙ্গুলি হেলনে রাতারাতি লাল পতাকার নেশায় মেতে উঠেছিলেন তারা, বাংলাদেশের রাজনীতির রহস্য-পুরুষ খ্যাত সেই সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা দেশের প্রতিটি রাজনীতি সচেতন মানুষেরই তো জানা আছে।
কর্নেল তাহের তাঁর আদালতে প্রদত্ত জবানবন্দিতে নিজেই বলেছেন,
"৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। ৭ নভেম্বর ভোররাত একটায় সিপাহি অভ্যুত্থান শুরু হবে বলে ঠিক হয়। আমাদের সিদ্ধান্তগুলো ছিল:
১. খালেদ মোশাররফ চক্রকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা
২. বন্দিদশা থেকে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা
৩. একটা বিপ্লবী সামরিক কমান্ড কাউন্সিল গঠন করা
৪. দল-মত নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি দান
৫. রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার
৬. বাকশালকে বাদ দিয়ে একটা সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করা
৭. বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি মেনে নেওয়া ও তার বাস্তবায়ন করা।
সবকিছুই পরিকল্পনা মাফিক হয়। বেতার, টিভি, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, পোস্ট অফিস, বিমানবন্দর ও অন্যান্য সব গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র প্রথম আঘাতেই দখল করা হয়। ভোররাতে জিয়াকে মুক্ত করে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার বড় ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানের সঙ্গে আমি ভোর তিনটার দিকে সেনানিবাসে যাই। সঙ্গে ছিল ট্রাকভর্তি সেনাদল। জিয়াকে আমি তাঁর নৈশ পোশাকে পেলাম। সেখানে ব্রিগেডিয়ার মীর শওকতসহ আরও কয়েকজন অফিসার ও সৈনিক ছিল। জিয়া আমাকে আর আমার ভাইকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করলেন। জলভরা চোখে তিনি আমাদের তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানালেন। তাঁর জীবন রক্ষার জন্য জাসদ যা করেছে, তার জন্য জিয়া আমার প্রতি ও জাসদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললেন, আমরা যা বলব, তিনি তা-ই করবেন। আমরা তখন পরবর্তী করণীয় নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করি। তখন ভোর চারটা। আমরা একসঙ্গে বেতার ভবনে পৌঁছাই। পথে আমরা তাৎক্ষণিক কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করি। এর মধ্যে বেতার থেকে সিপাহি অভ্যুত্থানের ঘোষণা করা হয়। জিয়াকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা দেওয়া হয়। বেতার ভবনে যাওয়ার পথে জিয়া শহীদ মিনারে একটা জনসমাবেশে ভাষণ দিতে রাজি হয়েছিলেন। তাই কথামতো আমি শহীদ মিনারে সমবেত হতে সিপাহিদের নির্দেশ দিয়েছিলাম। ঠিক হয়, সেখানে আমি ও জিয়া সমাবেশে ভাষণ দেব। তাহলে অফিসারদের ছাড়াই যে বিপ্লবী সৈনিকেরা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছে, সেই সৈনিকদের কাছে দেওয়া অঙ্গীকার থেকে কেউ পিছু হঠতে পারবে না।"
পৃথিবীর যেকোনো আধুনিক সেনাবাহিনীতে রাজনৈতিক সংশ্রব সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। সেই জায়গায় সেই সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে "বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা"র এহেন কর্মকাণ্ড ছিলো সম্পূর্ণ ভাবে আইনের পরিপন্থী। যার কারণে তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ক্ষমতায় বসানোর ঋণ শোধ করতে বেশী বেগ পেতে হয়নি জিয়ার। শত্রু মিত্র চিনতে পারার ব্যর্থতার মূল্য তাই কড়া দামেই শোধ করতে হয়েছিল কর্নেল তাহেরদের।
মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবসে খালেদ, হায়দার, হুদার খুনের দায় আজ সরকারের অংশীদার ইনু সাহেবের জাসদ নেতারা অস্বীকার করতে পারবেন কি?
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য