প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আলমগীর শাহরিয়ার | ১৩ নভেম্বর, ২০১৬
বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম লেখক হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ১৩ নভেম্বর। ১৯৪৮ সালের এমন এক দিনে রত্নগর্ভা এক জননীর কোল আলো করে এসেছিলেন কথাসাহিত্যের এই রাজপুত্র।
উল্লেখ্য, রাজপুত্র হুমায়ূন একা নন, আয়েশা-ফয়েজ দম্পতি পরিবারের সবাই তাদের জীবন ও কর্মে সোনা ফলিয়েছেন। সে অর্থে হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের অন্যতম আলোকিত এক পরিবারের সন্তান। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যের জীবন রাজকীয় হলেও একাত্তরে শহীদ বাবার অবর্তমানে, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে তাদের পারিবারিক প্রারম্ভিক জীবন মোটেই সুখকর ছিল না। ছিল ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ। সমস্যাসঙ্কুল উত্তাল সাগরে সম্ভাবনার জাহাজ সঠিক গন্তব্যে নির্ভুলভাবে নিয়ে যাওয়ার এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। সে চ্যালেঞ্জ সামাল দিয়ে যে নাবিক নির্ভীকভাবে কাঙ্ক্ষিত বন্দরে সোনার জাহাজ পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি হুমায়ূন জননী আয়েশা ফয়েজ। হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে এ মহীয়সী রমণীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই স্মৃতিকথা।
আগস্ট, ২০১২। মাসখানেক হলো মানবজমিন-এ রিপোর্টার হিসেবে জয়েন করেছি। প্রবেশনারী পিরিয়ড। ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। যথারীতি অফিস আওয়ার শেষে চীফ রিপোর্টার কাজল দা’র (কাজল ঘোষ) টেবিলে ডাক। দু’টো এ্যাসাইনমেন্ট দিলেন। শোকের মাস আগস্টে ধানমণ্ডি বত্রিশ নাম্বারে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর ঘুরে একটি প্রতিবেদন। আরেকটি রত্নগর্ভা মা হুমায়ূন জননী আয়েশা ফয়েজকে নিয়ে।
প্রিয় সন্তানের প্রয়াণে শোকাহত জননীর ঈদ। প্রিয় লেখক হুমায়ুন শোকে তখনো আচ্ছন্ন বাংলাদেশ। আয়েশা ফয়েজকে চিনি হুমায়ূন আহমেদ-এর বিভিন্ন লেখালেখি পড়ার সুবাদে। তাছাড়া আয়েশা ফয়েজ-এর নিজের লেখা বই ‘জীবন যখন যেরকম’ পড়েছি। এই সম্বল। কাজল দা’কে ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে বললেন, মিরপুরে কোথাও থাকেন ছোট ছেলে আহসান হাবীবের সঙ্গে থাকেন। খোঁজ নেন।
মিরপুর বিশাল এলাকা। রোড নাম্বার, বাড়ি নাম্বার কিছুই জানা নেই। অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাওয়ার মতো অবস্থা। অনেকটা ছোট ছেলেকে মা যেমন পুকুরে টান দিয়ে ফেলে বলেন, সাতার শেখো অনেকটা সেরকমই। বই মেলায় আমার এক নবীন লেখকবন্ধু জহীর (জহীর চৌধুরী) বসতো ‘উন্মাদ’ স্টলে। মেলায় একদল উন্মাদ তরুণ ঘিরে রাখে আহসান হাবীবকে। মনে পড়ে জহীরকেও এদের সঙ্গে দেখেছি। পাত্তা লাগাই। কাজ হয়। জহীরের বদান্যতায় আহসান হাবীবের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। মিরপুর ১৪-তে নেমে হাঁটি। ভরদুপুরে বাসা খুঁজি। বাসার নাম্বার ধরে খুঁজতে হয় না। ও গলির সবাই এ বাসা চেনে। যাক, বাঁচা গেল। ছিমছাম পরিপাটি শৈল্পিক এক কুটির। সবুজ লতা-পাতা-গুল্ম ছড়িয়ে ছিটিয়ে, মমতায় জড়িয়ে রেখেছে কংক্রিট। আমার চোখ জুড়িয়ে যায়। এখানে একজন লেখক, মননশীল মানুষ বাস করেন - এ আর বলে দিতে হয় না।
গেইটে কড়া নাড়লাম। একজন ভদ্র মহিলা আসলেন। কারণ জিজ্ঞাসিলে পরিচয় দিলাম। হুমায়ুন জননীর সঙ্গে কথা বলতে এসেছি তাও জানালাম। জানালেন, তিনি অসুস্থ। বিশ্রামে আছেন। মিডিয়ার কারও সঙ্গে কথা বলতে ডাক্তার অজুহাত আপত্তি আছে বলে উনি ভেতরে হারিয়ে যান। আমি চোখে অন্ধকার দেখি। পণ্ডশ্রম ও সময়ের কথা চিন্তা করে শঙ্কিত হই। অফিসে যেয়ে কি বলব। ব্যর্থ! কিছু দূরে গলির মুখে যেয়ে হাওয়াই টং দোকানে চা খাই। মাথায় এক নতুন বুদ্ধি খেলে। বিরতি দিয়ে আবার যাই। গেইটে শব্দ করি। ভাগ্যিস এবার নতুন একজন গেইটে এসে দাঁড়ান। আমি বলি, খালাম্মাকে দেখতে এসেছি। বাড়ি সিলেট (আমার মন বলছিল সিলেটের জন্য অন্যরকম আবেগ এখনো তিনি লালন করেন)। পড়াশোনা করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (সত্যিই তখন মাস্টার্স, ফার্স্ট সেমিস্টার )। উনিও আগেরজনের কাছাকাছি উত্তর দেন। আমি নানাকিছু বলে নাছোড়বান্দার মতো খালাম্মাকে যেয়ে আমার কথাগুলো বলতে বলি। কি ভেবে যেন উনি ভেতরে যান। ম্যাজিকের মতো কাজ হয়। খালাম্মা আসছেন। ড্রয়িং রুমে আমাকে বসতে বলেছেন।
বসার ঘরে হুমায়ূন আহমদের এক বিশাল পোট্রেট টানানো। দেখি লেখক হুমায়ূন বিষণ্ণ বদনে নিরুদ্দেশে তাকিয়ে আছেন। বই ভর্তি এ ঘরটায় সেলফে আমার চোখ যায়। অনেক পুরনো ঈদ সংখ্যাগুলো এখানে স্তূপাকারে রাখা। আরো নানান বই। আমার প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে হুমায়ূন জননী আসেন। পরনে হালকা টিয়ে রঙের পাড়ওয়ালা একখানা শুভ্র সফেদ শাড়ি। নাতিদীর্ঘ শরীরে এখনো উজ্জ্বলতা। চোখে ভারী চশমা। আমি উঠে দাড়াই। আমাকে বসতে বলেন। দূরে নয় বেতের সোফায় আমার পাশে বসেন। আমি প্রশান্তি অনুভব করি। কি বলে শুরু করবো ভেবে পাই না। সাদামাটা প্রশ্ন করি, আপনার শরীর কেমন? জানালেন খুব ভালো না। আর কি প্রশ্ন করা যায় যখন ভেবে পাচ্ছি না তখন তিনিই আমাকে উদ্ধার করেন। জানতে চান- কি করি, কোথায় থাকি? এসব আলাপে আমাদের আলোচনা জমে উঠে। আমি বলি, খালাম্মা আপনার সিলেটে থাকার স্মৃতি কী কিছু মনে আছে?
সাবলীল জবানে অনেক কিছু বলেন। তখন কাজল (হুমায়ূন) ছোট। ওর বাবা(ফয়েজুর রহমান) সেখানে চাকরি করেন। সিলেট শহরে মীরাবাজারে থাকার স্মৃতি এখনো সজীব। কিছু কিছু বলেনও। বরষায় ভাসান পানিতে কিভাবে নেত্রকোনা থেকে সুনামগঞ্জ হয়ে নৌকায় সিলেট আসতে-সেইসব স্মৃতিও। আমার মনে হয় আমিও একবার তাদের সঙ্গে আত্মজৈবনিক ইতিহাসে ঘুরে আসি। ‘বাবা, একটু বসো, আসতেছি’ বলে খালাম্মা আলগোছ উঠে যান। ভেতর ঘরে আমাকে খাওয়ার জন্য কিছু দিতে বলে আবার এসে বসেন। দেখি খালাম্মা আন্তরিক থেকে আন্তরিকতার হয়ে উঠছেন। আমার আব্বা আম্মার কথা জানতে চাইলেন। বলি, বাবা সদ্যপ্রয়াত। ভাই বোনের বহর নিয়ে মা এখন একাই। আমি যেন ওনার সংগ্রামী অধ্যায়ের স্মৃতি উসকে দেই। আমার মার প্রতি খুব মমতাময়ী হয়ে উঠেন এ জননী। বারবার বলেন, ঢাকা আসলে যেন মা’কে নিয়ে তাদের বাসায় যাই। আমি বলি মা ঢাকায় আসেন না। আর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকি। উনি আবারও বলেন, নিয়ে এসো একদিন। সমস্যা নেই আমাদের এখানেই থাকবেন। কৃত্রিম ভালোবাসার এই শহরে অকৃত্রিম এই মমতায় আমি সিক্ত হই। আমার মাকে তাঁর সালাম দিতে বলেন। আমি আপ্লুত হই। সম্মানিত হই।
সবশেষে আমি হুমায়ূন আহমদের প্রসঙ্গ তুলি। আসছে ঈদ....তিনি বলেন, আমার আর ঈদ নেই বাবা। ঈদ উৎসব সব শেষ। প্রতি ঈদে ধানমণ্ডিতে (দখিনা হাওয়া) ওর বাসায় যেতাম। হুমায়ূন আহমেদ আমেরিকা থেকে সেবার শীতের একটা সোয়েটার এনেছিলেন সে গল্প করলেন। এছাড়া, আমেরিকা (নিউইয়র্ক) থেকে ফোন দিয়ে বলেছিল ঈদের আগেই চিকিৎসা শেষ করে আসবে। কই আসলো না তো। আমি তাকে সান্ত¦না দেয়ার সাহস পাই না। তবু বলি, মানুষ কি চিরকাল বাঁচে খালাম্মা। তিনি পাল্টা উত্তরে বলেন, ওর আগে তো আমার যাওয়া কথা। ওর বাবাকে (একাত্তরে শহীদ ফয়েজুর রহমান) হারানোর শোক এখনো আমি ভুলতে পারিনি। এর মধ্যে ও চলে গেলো। আমি প্রসঙ্গ পাল্টাই। আমার সঙ্গে থাকা ‘মানবজমিন’ ঈদসংখ্যাটি টি-টেবিলে রাখি। ওনার চোখ পড়ে। প্রচ্ছদে সাদাকালো হুমায়ূন। হুমায়ূনময় সংখ্যা। তিনি পাতার পর পাতা উলটান। লেখা আর ছবিগুলো দেখেন। বুঝতে পারি তিনিও নানা স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। ভেতরের লেখা ও ছবিগুলো এক নজর দেখা শেষ হলে তিনি প্রচ্ছদে হাত রাখেন। প্রচ্ছদে হুমায়ূন।
পরম মমতায় হাত বোলাতে থাকেন জননী। যেন কতদিন পর মা তার হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে কাছে পেয়েছেন। আদর করছেন। চশমা খোলেন। চোখে তখন তাঁর জলের ধারা। শুভ্র সফেদ শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখ মোছেন। আবেগী এ জলের ধারা কি সহজে থামে। দিনের প্রখর আলো ফুরিয়ে যাচ্ছে। ঠের পাই জাদুর শহরে মায়ার মুহূর্ত সংক্ষেপ করতে হবে। আলোচনার উপসংহার টানার আগে আমার এক অদ্ভুত ইচ্ছে জাগে। আমি বলি খালাম্মা- সচরাচর কারও পা ছুঁয়ে আমি সালাম করি না। আজ আপনাকে করব। এ পায়ে আপনি সংগ্রামের, কষ্টের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন; থামেননি। একাকী, অকুতোভয়, অক্লান্ত থেকে জীবনভর সোনা ফলিয়েছেন। তিনি বিব্রত হয়ে আমার দিকে তাকান। আমার ডান হাত তার মুঠোয় পোরেন। তবুও বিদায়ের আগে প্রগাঢ় শ্রদ্ধায় অবনত আমি - জননীর পায়ের একটু কোমল স্পর্শ নিই। দু:খভারাক্রান্ত, গর্বিত জননীর পরশ নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বাইরে বের হই তখন দিনের আকাশে রোদের তেজ নাই। সন্ধ্যার আলোয় ম্লান পৃথিবী।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য