প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জহিরুল হক বাপি | ১৭ নভেম্বর, ২০১৬
আসছে ডিসেম্বর মাস। বাঙালির মাস, ভূমির মাস বেঁচে থাকার উৎসব। বঙ্গোপসাগরে যত ফোঁটা পানি আছে তারচেয়ে বেশি শোক, বিরহ, কষ্ট, যন্ত্রণার পর ডিসেম্বর ১৬। বঙ্গোপসাগরে যতগুলো ঢেউ আছে তার চেয়ে বেশি ক্ষোভে, বিদ্রোহের, বীরত্বের পর ডিসেম্বর ১৬। স্বাধীন ভূখণ্ড। নিজেদের আকাশ। নীল নীল, সাদা সাদা, কালো সাদা মেঘেদের সাথে সমুদ্র হাওড় নদী বিলের যুগলবন্দীর বাংলাদেশ।
পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম যুদ্ধ “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ”। সম্মুখ যুদ্ধ, নিরীহ নিরস্ত্র মেরে জন সংখ্যা কমানো, জ্ঞানী হত্যার করে পথভ্রষ্ট করা, একই যুদ্ধের কয়েক রকম চেহরা। আগামী মাসকে সামনে রেখে যেমন উৎসব হবে তেমনি কোথাও কোথাও কান্নার, দীর্ঘ শ্বাসের খরস্রোতা জলধারাও বইবে। এর সাথে বের হয়ে আসবে চাপা পড়া মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাস, কান্না, বীরত্ব, ত্যাগ, নিষ্ঠুরতা বা অসততার ইতিহাস।
২০১৩ পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জনসাধারণের একাংশের আগ্রহ বেড়েছে। আগে যেমন “আই হেট পলিটিক্স” বলা ফ্যাশন ছিল এখন কিছুটা হলে তার বিপরীত অবস্থা বাড়ছে। আগামী ২/৩ বছর পর কেউ যদি “আই হেট পলিটিক্স” বলে তবে মূর্খ বা ক্ষেত হিসাবে পরিচিতি পেতে পারে। বড় জোর বলবে – আমি আসলে রাজনীতি ঠিক বুঝি না। ভোটের সময় প্রার্থী বুঝে ভোট দেই। ভালো। আমি আশাবাদী। যদিও বর্তমানের কিছু কিছু অবস্থা দেখে প্রবল আতংকিত না হয়ে পারি না। ৭৫ পরবর্তী থেকে এ দেশে স্বাধীনতার বিপক্ষ-শক্তি আধিপত্য করেছে। ইচ্ছে মতো মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস বিকৃতি করেছে। সাংস্কৃতিক, সামাজিক, একাডেমিক শিক্ষা, ধর্মীয় সব মাধ্যমেই জিয়ারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ইচ্ছা মতো লিখেছে, বাঙালিয়ানাকে পথভ্রষ্ট করেছে উদ্ভট যত দর্শনকে সূক্ষ্মভাবে বাতাসের অংশ করে দিয়ে। সব কিছুই তারা করেছে বাংলাদেশকে পথভ্রষ্ট করতে।
ডিসেম্বর মাস এলে আমরা আরেক বিভ্রাট শুরু করি। কে কবে এ বিভ্রাট শুরু করেছিল আমার জানা নেই। তবে অনুভূতি অস্বস্তিকর। আমরা হয়তো না জেনেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এ বিভ্রাট ছড়াতেই থাকবো যদি এখন থেকেই সর্তক না হই। অথবা পরবর্তী যুগগুলোর দিকে সময় তাকিয়ে থাকবে এ বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসার। আজ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রচুর ঘাটাঘাটি হতে দেখি। পক্ষে বিপক্ষে। বিপক্ষে যারা তারা বিভ্রান্তি ছড়ায় আর আরেক দল দক্ষ সার্জনের মতো বিভ্রান্তির বিপরীতে সত্য বের করে আনছে। কেঁচো খুড়তে সাপ বের হচ্ছে, সাপ খুড়তে গিয়ে পাওয়া যাচ্ছে প্রত্নতত্ত্ব। এ ভূমীর ঘাসের গোড়ায় গোড়ায়, নদীর ঢেউ এ ঢেউ এ, বাতাসের গায়ে গায়ে লেগে আছে ৭১।
১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষে বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা : বুদ্ধিজীবী অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি , বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তি।
বাংলাপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা ১,১১১ জন। তার মধ্যে আছেন, শিক্ষাবিদ - ৯৯১ জন, সাংবাদিক - ১৩, চিকিৎসক - ৪৯, আইনজীবী – ৪২, অন্যান্য (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী এবং প্রকৌশলী) – ১৬।
এর ভিতর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ২১ জন। আজ আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী বলতে জানি ১০/১৫ জনের কথা। যাদের সবাই প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, দুই একজন সাংবাদিক-চিকিৎসক। বাকীরা হারালো কেন, বাকীরা হারালো কি ভাবে? উত্তর অবশ্যই খুঁজতে হবে।
এ লেখায় কিছু বিভ্রাটের কথা বলছিলাম। বুদ্ধিজীবীদের নামের আগে বাড়তি বিশেষণ হিসাবে “শ্রেষ্ঠ সন্তান” বলা শুরু হবে আগামী মাসের এক তারিখ থেকে প্রতিদিনই। চলবে এক মাস। এরপর কোন কোন টিভি চ্যানেলে দেখা যাবে বছরে কয়েকবার। যারা শ্রেষ্ঠ সন্তান উপাধিটা ব্যবহার করছেন তারা একবার ভেবে দেখবেন কি- ঠিক করছেন কিনা?
থ্রি-নট-থ্রি রাইফেলের ট্রিগারে আঙুল। রাত পোকারা কত কথা কয়। পায়ের নিচে জোক সাপের আনাগোনা। তারাহীন গভীর রাত। নির্ঘুম চোখ গাড় আঁধার খুঁজে আর গাঢ় অন্ধ মানুষ “পাকি অথবা রেজাকার”। মুক্তি অথবা মৃত্যু। ৭১-এর কাহিনী। হয়ত ট্রিগারওয়ালার বয়স ১৩ থেকে আঠারো নিচে। যুদ্ধের শুরুতে কেউ কেউ নতুন বৌ, দুই দিন বয়সের সন্তান রেখে যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, কেউ বা এতিমখানা থেকে বের হয়ে যোগ দিয়েছেন, কেউ কেউ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বই তুলে রেখে তুলে নিয়েছেন মুক্তির জন্য অস্ত্র কোন বরষার রাতে।
রাত ভোর হয়েছে কিন্তু এমন যুদ্ধে যাওয়া অনেকেই স্বাধীন দেশে সূর্যোদয় দেখতে পারেননি। অনেকে ফিরেছেন আজীবনের পঙ্গুত্ব নিয়ে, অনেকেই ফিরে এসে দেখেছেন পৃথিবীতে আর তার রক্তের কাউকেই রাখেনি পাকি-রেজাকাররা। এ মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে এদেশে কেউ শ্রেষ্ঠ না, কেউ শ্রেষ্ঠ হতে পারেন না। মুক্তিযোদ্ধারা এ মাটির শ্রেষ্ঠ সন্তান। প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে যারা আধুনিক অস্ত্রের বিপরীতে পুরনো অস্ত্র দিয়ে এ দেশ স্বাধীন করেছে, বেশি মাইনের অভাবে একটি মাত্র মাইনে ট্যাঙ্ক ধ্বংস করার জন্য ট্যাঙ্কের নিচে ঝাপ দিয়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেছে তারচেয়ে এ মাটির কেউ শ্রেষ্ঠ নয়।
বুদ্ধিজীবীরা শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী কিন্তু জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধারা। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়মিত সরকারি চাকরি করেছেন, এর ভিতর কেউ কেউ গোপনে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সাহায্য করেছেন। পাকিস্তান যদি জিতে যেত তবে এই নিরীহ শিক্ষাবিদরা নীরবেই জ্ঞান সাধনা করে যেতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতেন, চাকরী করতেন, রোগী দেখতেন।
অন্যদিকে আজ যেমন তালিকা ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা দেওয়া হয় তখন তালিকা ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁসি দিত পাকি-রাজাকাররা। পাকিস্তান হেরে যাওয়ার পরও এ স্বাধীন দেশে কম মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুদণ্ড হয়নি। পাকিস্তানীরা যদি ন্যুনতম যুদ্ধনীতি বা মানবিকতা মানতো তবে এ বুদ্ধিজীবীদের অনেককেই হত্যা করতো না। তারা সরাসরি কখনও পাকিস্তানের বিপক্ষে অবস্থান নেননি। এসব জ্ঞান তাপসের স্বভাবসুলভ জ্ঞান চর্চা, নির্বিবাদ ও চাকরীতে থাকার কারণে পাকিস্তানীরা ৭১-এ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বিদেশে দেখাতে পেরেছিল পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক। কিন্তু পাকিস্তান নামের পাপস্থান বাসিন্দারা কেউই মানুষ নয় এবং দীর্ঘ জিঘাংসা চলমান রাখার জন্য তারা এসব সরল, নিরীহ জ্ঞান সাধককে হত্যা করেছে।
তারা স্বাধীন বাংলাদেশে সম্মানের অধিকারী কিন্তু কখনওই শ্রেষ্ঠ সম্মানের অধিকারী নন। এদেশের শ্রেষ্ঠ সম্মানের অধিকারী কেবল মাত্র মুক্তিযোদ্ধারা। আপনিই চিন্তা করে দেখেন আপনি বিভ্রান্তি থেকে “জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবী” বলছেন কিনা।
বুদ্ধিজীবীরা যদি শ্রেষ্ঠ হয় তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান দেবেন কোথায়?
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য