প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জহিরুল হক বাপি | ০৩ ডিসেম্বর, ২০১৬
মাননীয়, আমরা কুশিক্ষায় শিক্ষিত - ২
পুলিশ জনগণের বন্ধু। এটা কেবল মুখের কথা। কেবলই শরতের সাদা মেঘ। ভেসে ভেসে চলে যাবে কিন্তু বৃষ্টি হয়ে নামে না। ঐ বাক্যটাও এমন। অবস্থা কেন এমন? অবস্থা এমন করা হয়েছে তাই এমন। এমন করা হয়েছে বহু আগেই। আর নীতি-নৈতিকতা, মানবতা, ভাবনা, গভীরভাবে সমাজের কোথায়ই বা আছে। তবে আশার কথা পরিবর্তন খুব ধীর গতিতে হলেও হচ্ছে। পুলিশের কাছে একতরফা আদি বাঙালিয়ানা খুঁজলে হবে না। পুলিশ তো আমাদেরই পরিবারের সদস্য। আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেমন কৌশলে কুশিক্ষা ঢুকানো হয়েছে, সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা হয়েছে, ধর্মের ভিতর তীব্র উগ্রতা সৃষ্টি করা হয়েছে সূফী ধারা বাদ দিয়ে কয়েক যুগ। পুলিশও এ সমাজেরই অংশ। আগে মানুষ, তারপর পরীক্ষা দিয়ে পুলিশ। পুলিশের সাফাই গাইছি না, বাস্তব অবস্থাটা বলছি।
পত্রিকায় পড়েছি টিএণ্ডটির একজন লাইনম্যান নাকি কয়েক’শ কোটি টাকার মালিক, বিদ্যুতের মিটার রিডারের ২৫ টা ফ্ল্যাট। ঘুষ সবাই খায়। তবে দোষ বেশি, বদনাম বেশি পুলিশের। এর কারণ সম্ভবত পুলিশের হাতে অনেক নির্দোষ নিগৃহীত হয়েছে, অনেকে নির্দোষ হয়েও শুধু ঘুষের জন্য লাঞ্ছিত হয়েছে, মারাও গেছে। শারীরিক নিগ্রহের কারণে সব পেশার মানুষের বদনাম একা বহন করে পুলিশ। এ ক্ষেত্রে পুলিশ বাস্তবিকই দোষী। আগে এসবের বিচার হতো না। এখন অবস্থা ভিন্ন। বিচার শুরু হয়েছে। আমি ইতিবাচকভাবে ভাবি সত্য চার্জশিট হবে। বিচার হবে। পুলিশের নিজেদের কারণেই এই সব বিচারে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা উচিত। গুটিকয়েক পুলিশের সীমাহীন দুর্নীতি, অমানবিকতা, অসততা, অপেশাদারিত্ব, লোভের দায় বাকি হাজার-লক্ষ পুলিশ নেবে? কেন তারা পরিবারের কাছে ছোট হবে? সমাজের কাছে ভীতিপ্রদ অসৎ হবে?
নাসিরনগরে দোষী কে? পুলিশ! সাঁওতাল পল্লীতে দোষী কে? পুলিশ! অধ্যাপক হত্যায় দোষী কে? পুলিশ! সব জায়গায় সামনে পুলিশ! পুলিশের অবস্থা নন-স্টপ চেয়ার কোচের সুপারভাইজারের মতো শতভাগ। টিকেট বিক্রি হয় নাই যাত্রীর অভাবে কাউন্টার ম্যানেজার বাস ছাড়ছে না, গালি খায় সুপারভাইজার! বাস মালিক ভাঙা চেয়ার, নষ্ট ফ্যান ঠিক করছে না, গালি খায় সুপারভাইজার! ড্রাইভার অনিরাপদ গাড়ি চালাচ্ছে, এক পর্যায়ে গালি খায় সুপারভাইজার! অথচ যাত্রী সেবা ছাড়া আর কোন কিছুর নিয়ন্ত্রণ সুপারভাইজারের নাই। সে যোগাযোগ ব্যবসার শেষ ব্যক্তি। পুলিশও তা।
নাসিরনগর, সাঁওতাল পল্লীতে কি পুলিশ লুটপাটের জন্য হামলা চালিয়ে ছিল? সাঁওতাল পল্লীতে কি পুলিশ নিজের জন্য জমি দখলে নেমে ছিল? অধ্যাপককে কি পুলিশ নিজ স্বার্থে হত্যা করেছে? সবগুলোর উত্তরই না। পুলিশ শেষ ব্যক্তি। অফিসিয়াল নিয়ম অনুযায়ী পুলিশ আদেশ মানতে বাধ্য। এ আদেশ দেওয়া মানুষগুলো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে বায়বীয়, অদৃশ্য। এরা বাস মালিক। অঘটন, কু-ঘটনা ঘটার পর শাস্তি কার হয়, পুলিশের? চড় থাপ্পড় যা খায় তা বাসের সুপারভাইজারই খায়। পুলিশ যদি আবার আদেশ না মানে তাহলেও শাস্তি। জলে কুমীর-ডাঙায় বাঘ। পুলিশকে যারা এ্যাকশন চালাতে আদেশ দিল তাদের কখনও বিচার হয়েছে বলে শুনিনি। এমন ঘটনায় কোন রাজনৈতিক নেতার দলীয়, আইনি শাস্তি হয়েছে বলে শুনিনি। কিন্তু নামকাওয়াস্তে হলেও বাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী ক্লোজড, বদলি ইত্যাদির মতো শাস্তি হয়।
চারদিকের অবকাঠামোগত উন্নয়নের সুফল পেতে হলে জাতিগত আত্মিক উন্নতির সাথে সাথে, অন্যান্য পেশার সাথে পুলিশেরও আত্মিক উন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিশ, শিক্ষক, চিকিৎসক জনগণের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। পুলিশ এবং শিক্ষক নৈতিকভাবে দুর্বল হলে সমাজের শান্তি নষ্ট হবেই। পুলিশ আসলে সাময়িক শান্তি রক্ষা করে। ঘটনাকে লম্বা হতে দেয় না। অপরাধকে দমন করে রাখে। তাই পুলিশের আত্মিক উন্নতির প্রশিক্ষণ জরুরি।
পুরো পৃথিবী জুড়েই জঙ্গি হামলার কারণে পুলিশ, কোথাও কোথাও সেনাবাহিনীর নাভিশ্বাস উঠে গেছে। আমাদের দেশীয় জঙ্গির শিকড় উপড়ে ফেলছে পুলিশ, পেট্রোল বোমা, জামাতি তাণ্ডব সব নিয়ন্ত্রণ করেছে পুলিশ। তখন সাধারণ একজন চাকরিজীবীর আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থা। যতই ট্রেনিং থাক সেও তো মানুষ। কিন্তু থাকতে হচ্ছে রাস্তায়, বিভিন্ন বিধি নিষেধের বেড়াজালে। হাতে অস্ত্র আছে কিন্তু ব্যবহার করার আদেশ নেই বা অন্য কোন নিয়মে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। মাথা থেঁতলে দিয়েছে প্রকাশ্য রাস্তায়। নিষেধ অমান্য করলে জীবন বাঁচাতে অস্ত্র ব্যাবহার করলেও আরেক বিপদ। এখনও সব ঠিক হয়নি। নিত্য নতুন অবস্থায় এখানে সেখানে জ্বলে উঠছে। গত দুই/তিন বছরে পুলিশের শারীরিক, মানসিক অবস্থার কথা একটু ভাবেন। কি পরিমাণ শারীরিক, মানসিক চাপ তাদের উপর দিয়ে যাচ্ছে!! এ ক্ষেত্রে উত্তপ্ত অবস্থায় দাঙ্গা থামাতে পুলিশের কেউ কেউ সভ্যতার সীমা অতিক্রম করে, চুলের মুঠি ধরে, বাড়াবাড়ি রকম উগ্র হয়ে উঠে। এমন দুই একজনকে পুলিশ রুলসে শাস্তি হতে দেখেছি।
এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, পুলিশের কর্ণধার, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছে প্রশ্ন করি আমাদের পুলিশদের কত জনের জন্য একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট আছেন? কত জন আছেন স্পোর্টস সাইন্টিস্ট? মানসিক, শারীরিক যেমন ইয়োগো, মেডিটেশন, যোগ ব্যায়াম ইত্যাদির জন্য কত জন প্রশিক্ষক আছে? নৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় শিক্ষার জন্য কি ব্যবস্থা আছে? যে ব্যবস্থায় থাকুক সেটা যে পর্যাপ্ত নয়, সেটা কখনও কখনও পুলিশে পরস্পর বিরোধী আচরণে প্রকাশ হয়।
গেল পহেলা বৈশাখে, ঢাকা বিমান বন্দরে পুলিশের আচরণে আমি রীতিমতো মুগ্ধ। পুলিশ যেন পুলিশ না, বাঙালি, কারো ভাই, কারো চাচা, কারো বন্ধু। পহেলা বৈশাখের পুলিশেরা তো আমাদের দেশী পুলিশই ছিল ফরেন ইম্পোর্টেড না। নাকি তাদের উপর কোন গায়েবী “দেও” বা “জিন” ভর করছিল। অসীম ধৈর্য হাসি মুখে পানি বিতরণ করছে, কারো কারো ঘ্যান-ঘ্যানে আচরণেও পুলিশের মুখ মলিন হচ্ছে না। আবার আগ বাড়িয়ে শিশু, মহিলাদের জিজ্ঞাসা করছে পানির বোতল লাগবে কিনা। রাস্তায় চেকিং এর সময় লুঙ্গি পরা লোকটারেও স্যার বলছে। চেকিংও ছিল কড়াকড়ি। কিন্তু পুলিশের ব্যবহারে সে দিন অন্তত সবাই খুব খুশী হয়ে ছিল বলে আমার ধারণা। সেই পুলিশ প্রতিদিনের না কেন?
পুলিশকে তো আমরা গালি দিতেই পারি। সবার মতো পুলিশের বেতন বেড়েছে। তবুও সবাই এখনও ঘুষ খায়, পুলিশও খায়। আসলে ঘুষ খাওয়াটা আমাদের অভ্যাসের জায়গায় চলে গেছে, ভয়াবহভাবে নৈতিকতার সাথে ব্যালেন্স হয়ে গেছে। তাই সরকারী বেতন বাড়লেও ঘুষ বাড়ে নি। আমাদের একাডেমিক শিক্ষায় তো
“লেখা পড়া করে যে
গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে”
এমন পড়ে এসেছি। পড়া, লেখা যখন করছি যে কোন উপায়ে গাড়ি চড়া আমার শিক্ষার অধিকার। গাড়ির নিত্য নতুন মডেল, এলইডি টিভি, সম্পদের আকাঙ্ক্ষা বাড়ে। তাই জিহ্বাও বাড়ে। সবার জ্বিহ্বা বাড়বে আরও পুলিশের যাদু মন্ত্রের মতো একলা কমে যাবে এটাতো অসম্ভব। সামগ্রিক ভাবে আমাদের আত্মিক শিক্ষার, পুরানো বাঙালিয়ানায় ফিরে যাওয়ার শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে পুলিশের যেহেতু এ মুহূর্তে বেশি ব্যস্ততা এবং জনগণের সাথে প্রতি মুহূর্তে, প্রায় সব কার্যক্রমেই পুলিশ জড়িত তাই তাদের আত্মিক উন্নয়নের শিক্ষা সবার আগে শুরু করা দরকার। একে একে সব জায়গায়।
পুলিশকে আমরা কোলবালিশ ভাবছি। পুলিশ কোলবালিশই। আপনার সারা ঘরে ময়লা আর ময়লার দোষ একলা কোলবালিশের কেন হবে। আপনি ঘর দোর পরিষ্কার করেন কোলবালিশ পরিষ্কার থাকবে। তবে পুরো ঘর পরিষ্কার করতে যেহেতু সময় লাগবে, বড় পরিকল্পনা-বাজেট লাগবে তাই আপাতত কোলবালিশকে পরিষ্কার রাখলে রাতে অন্তত কিছুটা আয়েশে ঘুমাতে পারবেন। ভালো ঘুম মানে ভালো মন, ভালো কাজ, ভাল ভাবে ঘর পরিষ্কার।
এ সাধারণ বিষয় বোঝার মতো জ্ঞানও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। চরম মাত্রায় অসহিষ্ণু বলেই সুপারভাইজারকে গালাগাল দিচ্ছি। সে এসেছে চাকরী করতে কেবল। আমারদের সহিষ্ণুতা, বোধ ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, সাব-ওয়ের সাথেই করতে হবে। না হলে গন্ধ আত্মা কেবল গন্ধই ছড়াবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য