প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ০৩ ডিসেম্বর, ২০১৬
শুরুতে মানুষ মানুষের প্রতি অনুগত ছিলো; সমতাভিত্তিক পারস্পরিক আনুগত্যের এই বন্ধনটিই সুস্থ ও প্রকৃতিবান্ধব। কিন্তু এই আনুগত্য যখন রাজা-রাণীর প্রতি চলে গেলো; তখনই ভেঙ্গে গেলো মানবিক বন্ধন। লং লিভ দ্য কিং বা কুইন বলে আনুগত্য প্রদর্শন করে কেউ কেউ রাতারাতি সমাজের একজন থেকে সমাজপতি হয়ে উঠলো। কারণ রাজা বা রাণী তার অন্ধ আনুগত্যে খুশী হয়ে জমি দিলো বেশ কিছু; সে জমিদার হয়ে উঠলো।
খুব তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে কায়িক পরিশ্রমে অনাগ্রহী ভিক্ষুক প্রকৃতির অলস অথচ চতুর লোকেরাই রাজা-রাণীর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। অর্থাৎ পরিশ্রম নয়; দালালীই আপাত: সৌভাগ্যের প্রসূতি যেন।
রাজা বা রাণীর ধারণাটি নানা আঙ্গিকে আজো অনগ্রসর দেশগুলোতে চালু রয়েছে। শুধু পশ্চিমা গণতন্ত্রের স্যুট-টাই পরিয়ে পদগুলোকে প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট বলা হয়। আজকের রাজা-রাণীরা বৃটিশ কুইনেরই একটি অপভ্রংশ রূপ। কিন্তু যেহেতু তারা গণতন্ত্রের নামাবলী গায়ে দিয়ে মাঠে নেমেছেন; তারা তো আর সরাসরি বলতে পারেন না; লং লিভ কুইন বলো। তাই তাদের সামনে নিয়ে আসতে হয়েছে জাতীয়তাবাদের জিগিরটি। এটা একটা আফিম জাতীয় জিনিস; তরলমতি তারুণ্যের জীবন বলি দিয়ে নিজের তখতটি নিশ্চিত রাখতে সমসাময়িক রাজা রাণীরা এই জাতীয়তাবাদের গভীর অনুভূতি তৈরি করেন।
এই যে জাতীয়তাবাদের আফিম; এটি বিক্রি করাই পৃথিবীর সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। কারণ এখানে কোন পুঁজির প্রয়োজন পড়ছে না। রাজা বা রাণীর প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রকাশ করে জাতীয়তাবাদের নেশাসামগ্রী বিক্রি করলেই রাজা-রাণী খুশী হয়ে একখণ্ড জমি দিয়ে দেন। পদ-পদবী-পদক-বিদেশ সফর-রাজবাড়িতে ভ্রমণ- ব্যাংক ঋণ, টেণ্ডার ও কমিশনের রাজভিক্ষা-সমাজে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় সেলফি ইত্যাদি উগ্র-জাতীয়তাবাদীদের লক্ষ্যবস্তু। কারণ এদের কারোরই নিজে পরিশ্রম করে কোন কিছু সৃষ্টির ক্ষমতা-মেধা কিছুই নেই। আছে শুধু অনুভূতি-চতুর আবেগ আর চাকরস্য চাকর মনোবৃত্তি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানিতে ইহুদিরা তাদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ, সৃজনশীলতা আর কঠোর পরিশ্রমের মাঝ দিয়ে বেশ কিছু সম্পদ অর্জন করেছিলো। এ সময় কিছু অলস, লোভী, ঘাতক-দালাল ভিক্ষুক প্রকৃতির জার্মান চ্যান্সেলর বা রাজা অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি জাতীয়তাবাদের আফিমে আসক্ত হয়। চোখ ছিলো তাদের ইহুদিদের সম্পদের দিকে। সুতরাং তারা উগ্র নাৎসি জাতীয়তাবাদের আফিম বিক্রেতা হয়ে পড়ে। পেয়ে যায় ইহুদিদের হত্যা-লুণ্ঠন ও তাদের বাড়ি-জমি দখলের লাইসেন্স। এ হচ্ছে যুদ্ধের বাজারে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া। হিটলার পুরস্কৃত করলো তার এই নাৎসি জাতীয়তাবাদের রাজাকারদের।
এই ঘটনাটি দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশে ঘটেছে; এখন এই উগ্র জাতীয়তাবাদের ব্যবসাটা তুঙ্গে। এসব জাতীয়তাবাদের নানা দেশে নানা নাম। একটু গভীর পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে বৃটিশদের জাতীয়তাবাদের আফিম বেচে বেশ কিছু হিন্দু-মুসলমান আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিলো। পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদের আফিম বেচে পরিশ্রমী হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-আদিবাসীর জমি-বাড়ি দখল নাৎসি জাতীয়তাবাদের নরভোজী কৌশল অনুসরণ করেই ঘটেছে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আফিম বেচে দেশবিভাগের সময়েই খুব কৌশলে উপমহাদেশের বেশীর ভাগ জমিজমা দখল করা গেছে। অন্যায়ভাবে জমি দখলে উগ্র জাতীয়তাবাদের তলোয়ার বা ত্রিশূলের চেয়ে বড় আর কোন অস্ত্র নেই। উগ্র জাতীয়তাবাদের এক গ্লাস শরবত এক গ্লাস রক্তের মতোই নিষ্ঠুর।
দক্ষিণ এশিয়ায় এখন উগ্র জাতীয়তাবাদ বিক্রির খুবই উপযোগী মরশুম। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে এক চিমটি ইসলামের "অনুভূতি" ঘুঁটা দিলেই তৈরি হয়ে যায় উগ্র জাতীয়তাবাদের শরবত। এটি গেলাসে গেলাসে বিলিয়ে দিলেই কেল্লাফতে। আবার শুধু ইসলামের অনুভূতির রুহ-আফজা নিয়ে অপেক্ষমাণ আরেকটি অশুভ গোষ্ঠী। দুটি সমান্তরাল উগ্রবাদী গোষ্ঠী জমি-বাড়ি দখল ও রাজা-রাণীর প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন করে নানা স্থানে নাৎসিদের মতোই চোখ লাল করে ঘুরে। এদের উদ্দেশ্যও নাৎসিদের মতোই। সাধারণ মানুষের প্রাণঘাতী এইসব উগ্র জাতীয়তাবাদের রেসিপি। পরমতসহিষ্ণু-মানবতাবাদী-উদারপন্থার শুভবোধের পরিসর সংকুচিত হয়ে আসছে। ঘাতক বুশের মতো; "আইদার ইউ আর উইদ আস অর এগেইনস্ট আস" হুংকারে ক্রমশ: হিংস্র হয়ে উঠছে উগ্র জাতীয়তাবাদী ঘাতক-দালালেরা।
ভারত-পাকিস্তান থৈ থৈ করছে নাৎসিদের মতো ঘাতক-দালাল উগ্র জাতীয়তাবাদীতে। ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদ-পাকিস্তানের কট্টর মুসলমানিত্ববাদ হোয়াইট হাউজে কট্টর খ্রিস্টিয়বাদের ট্রাম্প কার্ড পেয়ে আনন্দে আটখানা। কারণ উগ্র জাতীয়তাবাদ যেটাই হোক; এর আসল লক্ষ্য ভিক্ষুকপুত্র থেকে চৌধুরী হওয়া।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য