আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

একজন রসরাজ দাশ এবং মিডিয়ার কিছু গুজব!

দেবজ্যোতি দেবু  

রসরাজ দাশ নামের একজন জেলের ফেইসবুকের একটি পোস্টের নাম করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর কি ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছিল তা আমরা সকলেই জানি। জানি, সেদিন কি হয়েছিল এবং কারা তা করেছিল। কিন্তু আজ অবধি এর কোন সুরাহা হয়নি। আদৌ কোনদিন হবে কি-না তাও আমার জানা নেই।

আমি বলতে চাইছিলাম অন্য কথা। ঐদিন থেকেই মিডিয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে তাতে কোন সন্দেহ নাই। সময়ে সময়ে সর্বশেষ সংবাদটুকু প্রচার করে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। কিন্তু তবুও প্রশ্ন জাগে, সবাই কি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচার করছে? হঠাৎ এমন প্রশ্ন পড়ে একটু দ্বিধান্বিত হতে পারেন। শুরুতে আমিও হয়েছিলাম।

নাসিরনগরে হামলা পরবর্তি সময়ে 'এবেলা ডট কম' নামের একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল থেকে প্রচার করা হয়, প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী ছায়দুল হক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের 'মালাউন' বলে গালি দিয়েছেন! এই সংবাদের উপর ভিত্তি করেই স্বনামধন্য পত্রিকা 'ভোরের কাগজ' তাদের অনলাইন সংস্করণে ঠিক এই সংবাদটাই তাদের নামে প্রচার করে। ফলে সংবাদটি ভাইরাল হয়ে সাধারণ মানুষ নাসিরনগর আর রসরাজকে ভুলে ঐ একটি শব্দ নিয়ে আলোচনায় মেতে ওঠে। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তও এই একই রকম তথ্য পেয়ে ক্ষেপে ওঠেন ঐ মন্ত্রীর উপর। ফলে জল ঘোলা হয়ে হিন্দু পরিবারগুলোর উপর হামলার পিছনের মূল পরিকল্পনাকারীদের ছেড়ে সবাই মন্ত্রীর পিছনে ছুটতে শুরু করেন। হাস্যকর হলেও সত্য যে কোন রকম প্রমাণ ছাড়াই প্রচার করা একটা গুজবকে সত্য ভেবে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা স্বেচ্ছায় নিজেদের নামের পাশে ঐ বিতর্কিত শব্দটি জুড়ে দিয়ে নিজেদের আরো হাস্যকর করে তোলেন। আফসোসের বিষয়, মন্ত্রী সাহেব এখনো বহাল তবিয়তেই আছেন এবং নিশ্চিন্তে সুখনিদ্রায় আছে মূল হামলাকারীরাও। কিন্তু মাঝপথে ন্যায্যতা হারিয়েছে একটি প্রতিবাদ!

কিছুদিন আগে ওই একই অনলাইন পোর্টাল 'এবেলা ডট কম' থেকে প্রচার করা হলো রসরাজের পরিবার ভারতে পালিয়ে গেছে। এই সংবাদের ফাঁদে পা দিয়ে 'বাংলাট্রিবিউন'ও একই রকম সংবাদ প্রচার করে। কোন রকম প্রমাণ ছাড়াই প্রচার করা এমন সংবাদ খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং আবারও বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর আলোচনা শুরু হয় রসরাজের পরিবার নিয়ে। তার সাথে যুক্ত হয়ে যায় বাংলাদেশের সমস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের নামও। যুক্ত হয় কিছু উস্কানিমূলক কথাবার্তাও!

গতকাল (২ ডিসেম্বর) দেখা যায়, রসরাজের পরিবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে রসরাজকে নির্দোষ এবং তার মুক্তি দাবি করছেন! প্রশ্ন ওঠে, তারা ভারতে চলে গিয়ে থাকলে আবার বাংলাদেশে সংবাদ সম্মেলন কিভাবে করছেন? জবাবে তারা বলেন, তারা ভারতে যাননি। আত্মীয়-স্বজনের বাসায় আত্মগোপন করে আছেন। প্রমাণ হয়, ঐ সংবাদটাও নেহায়েতই একটা গুজব ছিল।

কিছুদিন আগে ৬ নভেম্বর, ভোরের কাগজ অনলাইন সংস্করণে নিজেদের সংবাদদাতার নাম ব্যবহার করে একটি প্রতিবেদনকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বলে দাবি করে তাতে প্রচার করা হয়, 'অনুসন্ধানে জানা গেছে, অন্য কেউ নয়, রসরাজের পরিবর্তে ছোট ভাই পলাশ দাশই বিতর্কিত ওই ছবি ভুলে ফেসবুকে প্রকাশ করে। পরে ভাইয়ের অপকর্মের দায় পড়ে রসরাজের ওপর। আর আক্রান্ত হয় নাসিরনগরের হিন্দু বাড়ি ও মন্দির।' তারা আরো দাবি করে, 'রসরাজ দাশের নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট চালু হলেও সেটি খুলে দেয় তার ছোট ভাই ব্রাক্ষণবাড়িয়ার বিজয়নগরের ইসলামপুর কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া পলাশ দাশ। পলাশ দাশই রসরাজ দাশের নামে ফেসবুক চালাতো। রসরাজের নামে ‘কাবা শরিফের বিতর্কিত ছবি’ ফেসবুকে আপলোড হওয়ার পর তার ভাই পলাশ দাশ ছুটে যায় গ্রামের আশুতোষ দাশের কাছে। পলাশ দাশ আশুতোষ দাশের কাছে গিয়ে এই বিতর্কিত ছবি দেখানোর পর আশুতোষ দাশ সেটি ‘ডিলিট’ করে দেন এবং এই ছবি আপলোডের জন্য স্ট্যাটাসের মাধ্যমে ক্ষমাও চাওয়া হয়।'

কিন্তু গত তিন-চার দিন আগে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, রসরাজ দাশ নির্দোষ। তিনি ঐ ছবি আপ্লোড করেননি বা তার ফোন থেকেও ঐ ছবি আপ্লোড করা হয়নি। ঐ ছবি আপ্লোডকারী সন্দেহে পুলিশ 'আল-আমিন সাইবার ক্যাফে'র মালিক জাহাঙ্গিরকে গ্রেপ্তার করে। এখন পুলিশের তদন্তকে যদি সত্য বলে ধরে নেই, তাহলে ভোরের কাগজের সেই কথিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আসলে কি প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছিল? আর ভোরের কাগজের প্রতিবেদনকে যদি সত্য বলে ধরে নেই, তাহলে পুলিশের তদন্ত কি তবে ভুল পথে যাচ্ছে?

এমন প্রশ্নের উত্তরটা জটিল নয় কিন্তু। একটু খেয়াল করে দেখুন, ভোরের কাগজ বলছে রসরাজের ফেইসবুক আইডি করে দিয়েছে তার ভাই পলাশ এবং পলাশই ঐ আইডি চালাতেন। পলাশ 'ভুল করে' ঐ ছবি রসরাজের আইডিতে আপ্লোড করে ফেলে। আপ্লোড হয়ে গেলে সে তার আরেক ভাইয়ের কাছে গিয়ে ছবিটা দেখালে সেই ভাই আশুতোষ দাশ সেটা ডিলেট করে দেন। এখন প্রশ্ন জাগে, কলেজ পড়ুয়া একটা ছেলে যে ফেইসবুকের আইডি করতে পারে, তা চালাতে পারে, সে ভুল করে একটা ছবি কিভাবে আপলোড করে দিবে? আর করলোই যদি, তাহলে সেটা ডিলেট করার জন্য আরেকজনের কাছে যাবে কেন? সে নিজে কি সেটা ডিলেট করতে পারে না? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, রসরাজের ভাই পলাশ সেই ছবিটা পেলই বা কোথায়? রীতিমত অযৌক্তিক কিছু গল্প সাজিয়ে একটা রিপোর্টকে তারা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বলে চালিয়ে দিয়ে আসলে কি প্রমাণ করতে চাইছে তা আমার বোধগম্য হয়নি।

এরকম আরো অনেক ছোট বড় বিভ্রান্তিকর তথ্য আছে, যা এসব সংবাদ মাধ্যমের দ্বারা প্রচার হচ্ছে এবং মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। সব লিখতে গেলে অনেক বড় হয়ে যাবে বলেই ছোট করে চুম্বক অংশটুকু তুলে ধরলাম। এমন অসত্য এবং মনগড়া সংবাদ পরিবেশনের পিছনে উদ্দেশ্যটা আসলে কি? এটা কি কোন সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়ার জন্য করা হচ্ছে, নাকি শুধুই বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ব্যবসা করে নেয়ার ধান্দা করা হচ্ছে? কারণ যাই হোক, এটা বন্ধ করা উচিৎ। বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন কোন সংবাদ মাধ্যমের কাছ থেকে আশা করি না। একটা কথা তাদের আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই, আপনাদের এসব সংবাদই অনেক ক্ষেত্রে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই আপনারাই যদি ভুল তথ্য দিয়ে থাকেন তাহলে সাধারণ মানুষ সত্যটা জানবে কিভাবে? এরকম স্পর্শকাতর ইস্যুতে আপনাদের বিভ্রান্তিকর তথ্য সাধারণ মানুষের মনে সাম্প্রদায়িক উস্কানির জন্ম দিতে পারে। এতে ক্ষতিটা দেশের এবং দেশের সাধারণ মানুষেরই হবে।

দেবজ্যোতি দেবু, সংস্কৃতি কর্মি, অনলাইন এক্টিভিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ