প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৩৭ শতাংশ ভোট; ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বেসিক ডেমোক্রেসিতে অনাস্থা রেখে ভোট দেননি ৩৭ শতাংশ ভোটার। বিএনপি পেয়েছে ২০ শতাংশ ভোট। আওয়ামী লীগের ক্লিন ইমেজের প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী নির্বাচনে জয় লাভ করলেও এই নির্বাচনে সরকারে আস্থা ও অনাস্থার ড্র হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের ২০ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগের বেনিফিশিয়ারি; ১০ শতাংশ স্যুইং ভোটার, ৭ শতাংশ ক্লিন ইমেজের প্রার্থীর ভোটার; সব মিলিয়ে ৩৭ শতাংশ আওয়ামী লীগে সমর্থন জারি রেখেছে। ৩৭ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক ব্যবসা বিরোধী; ২০ শতাংশ মানুষ বিএনপির বেনিফিশিয়ারি। ৩৭ শতাংশের প্রত্যাখ্যানকে মাথায় রাখা জরুরি। কারণ প্রত্যাখ্যানের শতাংশ আরো বাড়বে।
বিএনপি যে ২০ শতাংশের ভোট পেয়েছে; এরা কোন না কোন ভাবে বিএনপির শাসন আমলগুলোতে ব্যক্তিগতভাবে উপকৃত হয়েছে। হতে পারে কারো বাড়ি বা জমি দখলের সুযোগ পেয়েছে; টেন্ডার-কমিশনের ভাগ পেয়েছে; টি আর-কাবিখা'র ভাগ পেয়েছে, চাঁদাবাজির সুযোগ পেয়েছে, ঘুষ উদ্দীপক চাকরি পেয়েছে। এইভাবে ভিক্ষুক অবস্থা থেকে একটা অপেক্ষাকৃত ভালো অর্থনৈতিক অবস্থায় এসেছে কোনরকম কায়িক পরিশ্রম না করে। কেবল বিএনপির সমর্থক হিসেবে মিটিং-মিছিল করে; এদের নেতা-নেত্রীদের ছবি হাতে করে ঘুরে।
আওয়ামী লীগেরও এরকম ২০ শতাংশ ভোট রয়েছে যারা একই পদ্ধতিতে কোন কায়িক পরিশ্রম না করে ভিক্ষুক থেকে আজকের একটি সম্পন্ন অবস্থায় এসেছে। বাকি ১৭ শতাংশের মধ্যে দশ শতাংশ স্যুইং ভোট। এরা পাঁচ বছর বিএনপিকে; পাঁচ বছর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখে দেখতে চেষ্টা করেছে ফলাফল কী দাঁড়ায়। ওতে কাজ হয়না দেখে আওয়ামী লীগকে দশবছর সমর্থন দিয়ে চলেছে; যদি এতে দেশের-সমাজের উন্নতি হয়; উন্নয়ন ধারাবাহিকতা বজায় থাকে এই আশায়। এরা আরো দুবছর দেখবে; তারপর সিদ্ধান্ত নেবে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে। আর বাকী সাত শতাংশ ভোট এসেছে আইভীর ক্লিন ইমেজের কারণে। আইভীর মত এমন জনপ্রিয় মানুষ আওয়ামী-বিএনপি দুই দলেই অল্পসংখ্যক রয়েছেন। আর ঐ সাত শতাংশ ভোটার ক্লিন ইমেজের প্রার্থী থাকলেই তাদেরকে ভোট দেয়। অর্থাৎ এই ১৭ শতাংশ মানুষ এখনো রাজনীতিতে আগ্রহ ধরে রেখেছে; সামাজিকতার অংশ হিসেবে।
কিন্তু যে ৩৭ শতাংশ ভোটার ভোট দেয়নি; এরা আসলে শেষবার আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিলো ১৯৭০ সালে। বাংলাদেশের মুক্তির ম্যান্ডেট বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের হাতে তুলে দিতে। তাদের স্বপ্ন সফল হয়েছে; বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এই ৩৭ শতাংশ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা সবসময় একইরকম ছিলো এবং থাকবে। কারণ এরা পরিশ্রম করে দুটি ডাল-ভাত জোগাড়ের সামর্থ্য রাখে। ভিক্ষাবৃত্তি এদের স্বভাবে নেই।
কিন্তু এরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, শিক্ষা- সাংস্কৃতিক অবনমন, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, হত্যা-গুম, লুণ্ঠন এসবে বীতশ্রদ্ধ। এরা বৃটিশ শাসন, পাকিস্তান শোষণ, বাংলাদেশের ভাষণে তিতিবিরক্ত হয়ে বুঝে গেছে ভারতীয় উপমহাদেশের কালো-রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি হিসেবে; ৪০ শতাংশ লোক কোন না কোন রকমের শান্তি কমিটির সদস্য হয়ে ভিক্ষুক থেকে কোটিপতি অধুনা মিলিওনিয়ার হবেই। বৃটিশের শান্তি-কমিটি ছিলো, পাকিস্তানীদের শান্তি কমিটি ছিলো, বাংলাদেশ আমলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পৃথক অথচ কর্মপদ্ধতিতে একই শান্তিকমিটি গোষ্ঠী রয়েছে। সুতরাং এই ৩৭ শতাংশ মানুষের জন্য রাষ্ট্র-সরকার-প্রশাসন যন্ত্র-পুলিশ-সেনাবাহিনী ও বিরোধী দল মিলিয়ে যে ৪০ শতাংশ বাংলাদেশ আমলের শান্তি কমিটির সদস্য বা দালাল রয়েছে; তারা আসলে গোদের ওপর বিষফোঁড়া; বোঝার উপর শাকের আঁটি। ভারতীয় উপমহাদেশে জন্মই যে আজন্ম পাপ তা হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছে এই ৩৭ শতাংশ মানুষ।
রাষ্ট্রব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার নিঃগৃহীত এই ৩৭ শতাংশ মানুষ। স্যুইং ভোটার ১০ শতাংশ আর ক্লিন ইমেজের প্রার্থী খোঁজা ৭ শতাংশ মানুষও রাষ্ট্রিক অব্যবস্থাপনায় সব আমলেই নিঃগৃহীত। তাই তারা একজন অপেক্ষাকৃত ভালো মানুষ জনপ্রতিনিধি খোঁজে বা মন্দের ভালো সরকার খোঁজে। বাকী যে ৬ শতাংশ ভোটার এদিকে ওদিকে কিছু ভোট দিয়েছে এদের কাছে রাজনীতি অবসর বিনোদন ও সময় কাটানোর বিষয়। তবে সার্বিক বিচারে তারাও নিগৃহীতের দলে।
অর্থাৎ বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ মানুষ যারা নিজের খায়, নিজের পরে, শ্রমে-ঘামে অর্থনীতি গড়ে, উন্নয়ন পরিসংখ্যানে দ্যুতি আনে; তারা সত্যিকার মুক্তির পথ আজো খুঁজে পায়নি। যুগে যুগে এরা মুক্তির জন্য লড়াই করেছে; বৃটিশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রক্ত দিয়েছে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রক্ত দিয়েছে; কিন্তু আজো তারা লুণ্ঠকদের রক্ত শোষণ প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত হতে পারেনি। কারণ ৪০ শতাংশ নিষ্কর্মা ভিক্ষুক সন্ত্রাসী নানা আঙ্গিকে ৬০ শতাংশ মানুষকে নিজভূমে পরবাসী করে রেখেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর আজ লুণ্ঠনের জন্য ৪০ শতাংশ লুণ্ঠক কর্তৃক সৃষ্ট স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি-বিপক্ষের শক্তি, পাকিস্তান প্রেমী-ভারত প্রেমী, ইসলামের হেফাজতকারী ওলামা-জামাতের অনুভূতির আতরের সুবাস; এগুলোর সঙ্গে প্রতিদিনের যাপিত জীবনের কোন সম্পর্কই আর নেই। বাংলাদেশের নিজের কষ্টার্জিত অর্থে দুটো ভাত-কাপড়ের সংস্থান করা ৬০ শতাংশ মানুষের বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন প্রেম নেই; বাংলা মায়ের কোল ছাড়া আর কোন আশ্রয় নেই। আর ২০ শতাংশ আওয়ামী লীগের মানুষ কোনদিন ভারতে সেকেন্ড হোম গড়েনা। বাংলাদেশেই ৬০ শতাংশ জিম্মি মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন করে সম্পদ গড়ে; সেকেন্ড-থার্ড হোম গড়ে পশ্চিমে। অন্যদিকে ২০ শতাংশ বিএনপির মানুষ কখনোই পাকিস্তানে সেকেন্ড হোম গড়ে না; এরাও বাংলাদেশেই ৬০ শতাংশ জিম্মি মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন করে সম্পদ গড়ে; সেকেন্ড-থার্ড হোম গড়ে পশ্চিমে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অনুবর্তী ৪০ শতাংশ মানুষের লুট করে খাওয়ার লীলাভূমি গত ৪৫ বছরের বাংলাদেশ। তাদের ব্যবহৃত রাজনৈতিক রেটোরিক-কথকতা-ধমক-চোখ রাঙানি-অস্ত্র,পেশী-ক্ষমতা দেখানো এগুলো বহু ব্যবহারে জীর্ণ। লুণ্ঠনের সব ছলাকলাই আজ উন্মোচিত। ফলে প্রতিদিনের যাপিত জীবনে তারা অপ্রাসঙ্গিক ও অনভিপ্রেত উপস্থিতি। তাই রাজনীতিতে যে গুটিকতক চিন্তাশীল মানুষ রয়েছেন; তাদেরকে রাজনৈতিক-পুনর্ভাবনা করতে হবে; চেষ্টা করতে হবে রাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা ৬০ শতাংশ মানুষের যাপিত জীবনে প্রাসঙ্গিক হতে। প্রতিদিন ঘৃণা ও অভিশাপ কুড়ানোর উঞ্ছজীবন থেকে মুক্ত হতে আওয়ামী লীগের ২০ শতাংশ ক্যাডার ও বিএনপির ২০ শতাংশ ক্যাডারকে অবশ্যই সচেষ্ট হতে হবে। কারণ শেষ পর্যন্ত একটি আত্ম-মর্যাদাসম্পন্ন জীবন মানুষ হয়ে ওঠার পূর্বশর্ত।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য