আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বাংলা একাডেমীর মৌলবাদী নখর আর আগামীর বাংলাদেশে সুদূর প্রসারী প্রভাব

আরিফ জেবতিক  

অমর একুশে বইমেলায় শ্রাবণ প্রকাশনী নামের একটি প্রকাশনীকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে! এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলা একাডেমী বইমেলা কমিটির সচিব জালাল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, গত ১০ নভেম্বর বাংলা একাডেমীর কাউন্সিলের সভায় শ্রাবণ প্রকাশনীকে বইমেলায় দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত বইমেলায় বাংলা একাডেমী পরিস্থিতি বিবেচনায় ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামে একটি বই নিষিদ্ধ করেছিল। আর একাডেমীর সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন শ্রাবণ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী রবিন আহসান; যা বাংলা একাডেমীর বইমেলার স্বার্থের পরিপন্থী। আর এ জন্য বৃহত্তর স্বার্থে বাংলা একাডেমীর বইমেলায় শ্রাবণ প্রকাশনীকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ভাবতে অবাক লাগে, যে ১৯৫২ সালের কথা বলার অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের উত্তরাধিকার হিসেবে বাংলা একাডেমী গঠিত হয়েছিল, সেই বাংলা একাডেমী আজ স্বাধীন দেশে কথা বলার অপরাধে একজন তরুণ প্রকাশকের উপর তাঁদের ক্ষমতার দম্ভ দেখাতে উদ্যত হয়েছে!

আমলাতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদের সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে এই নিষিদ্ধকরণ। নিষিদ্ধ করার আগে শ্রাবণ প্রকাশনীকে কোনো কারণ দর্শানো হয়নি, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি, শ্রাবণ প্রকাশনীর সঙ্গে কোনো আলাপ আলোচনা করা হয়নি। সম্পূর্ণ একতরফা ভাবে আমলাতান্ত্রিক শক্তি প্রদর্শন করে এই স্বঘোষিত নিষিদ্ধকরণ করা হয়েছে। এবং সেটি করার পরেও বিষয়টি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গোপন রাখা হয়েছে।

শ্রাবণ প্রকাশনীর আসলে অপরাধ কী? বাংলা একাডেমীর সচিব জালাল সাহেব জানিয়েছেন, একাডেমী গতবছর বইমেলায় একটি বই নিষিদ্ধ করেছিল। বই নিষিদ্ধ করা বাংলা একাডেমীর আইনি এখতিয়ার বহির্ভূত, সরকারের নির্বাহী আদেশ অথবা আদালত কর্তৃক নিষিদ্ধ না হলে বাংলা একাডেমী কোনো বইকে নিষিদ্ধ করতে পারে না।

তাছাড়া বিষয়টি শুধু মাত্র বই নিষিদ্ধকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সেই প্রকাশককে অত্যন্ত অবমাননাকরভাবে কোমরে দড়ি বেঁধে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

'পরিস্থিতি বিবেচনায় ' যদি বইমেলায় কোনো বই বিক্রি ও প্রদর্শনে বাংলা একাডেমী বাঁধা দেয় সেটির সমালোচনা করা ও প্রতিবাদ করার অধিকার যে কোনো মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের আছে। মানসিকভাবে সুস্থ দুইজন মুক্ত মানুষ একে অপরের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত করতে পারে, সমালোচনা করতে পারে এবং সেই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে বক্তব্যও দিতে পারে। একমাত্র মানসিকভাবে অসুস্থ ফ্যাসিবাদী মানসিকতার মানুষজনই মনে করে যে তাদের সিদ্ধান্ত অলঙ্ঘনীয়। তারা বাকিদেরকে তাদের তাবেদার গোষ্ঠী হিসেবে মনে করে।

বইমেলা বাংলা একাডেমীর সৃষ্টি করা কোনো বিষয় নয়। বইমেলার বীজ রোপণ হয় চিত্তরঞ্জন সাহার মতো একজন ডায়নামিক প্রকাশকের একক উদ্যোগে। বাংলা একাডেমী পরবর্তীতে এই কাজটি নিজেদের কাঁধে নিয়ে নেয় এবং বর্তমানে তাঁদের ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ করার জন্য এটিকে ব্যবহার করে থাকে। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, আমাদের দেশে প্রকাশকদের শক্ত কোনো সমিতি গড়ে উঠেনি। অধিকাংশ প্রকাশকই জনপ্রিয় লেখকদের বাসায় বগুড়ার দইয়ের হাড়ি সরবরাহ করে 'প্রকাশক' হয়ে উঠেছেন। আসলে এদেশে এখনও 'প্রকাশক' অনেক কম, অধিকাংশই মুদ্রাকর। এর কারণে প্রকাশকদের কোনো গিল্ড তৈরি না হওয়ায় নিজেদের মতো করে বইমেলা ব্যবস্থাপনা করার হিম্মত তাদের নেই, বাংলা একাডেমীর বইমেলার দিকেই তাই তাদেরকে তাকিয়ে থাকতে হয়। এই সুযোগে বাংলা একাডেমী গত কয়েকবছর ধরে যে স্বেচ্ছাচারিতা শুরু করছে, শ্রাবণ প্রকাশনীকে বইমেলায় অংশগ্রহণে বাঁধা সৃষ্টি করা তার সর্বশেষ নজির। এটি একটি অশনি সংকেত। গত কয়েকবছর ধরে বাংলা একাডেমী বিভিন্ন সময়ে বইমেলায় সৃজনশীল প্রকাশকদেরকে লাঞ্ছিত করেছে। মৌলবাদীদের প্রচ্ছন্ন হুমকিতে বইমেলায় স্টল বাতিল করেছে, প্রকাশকদেরকে গ্রেফতার করার নৈতিক সমর্থন দিয়েছে। 'মেনে নেয়া' আর 'মনে নেয়া' এক বিষয় নয়। 'পরিস্থিতি বিবেচনায়' বাংলা একাডেমী মেলার বৃহত্তর স্বার্থে কিছু কিছু সিদ্ধান্তে আপোষ করেছে এটা মনে হলেও এক ধরনের সান্ত্বনা থাকত যে ঐ পরিস্থিতিকে উত্তরণে একাডেমী ভবিষ্যতে হয়তো আরো কাজ করবে।

কিন্তু শ্রাবণ প্রকাশনীর নিষিদ্ধকরণের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে বাংলা একাডেমী মৌলবাদী হুমকিকে 'মেনে নিয়ে' কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে না বরং মৌলবাদকে তারা মনের মধ্যে লালন করা শুরু করেছে।

শ্রাবণ প্রকাশনীকে এককভাবে শুধুমাত্র বাংলা একাডেমীর সমালোচনা করার কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এটি বিশ্বাস করা কষ্টকর। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদকে যখন বইমেলা থেকে ফেরার পথে কুপিয়ে প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়, তারপরদিন বইমেলায় এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে যে কয়জন তরুণ উদ্যোগী হোন, শ্রাবণ প্রকাশনীর রবিন আহসান তাঁদের অগ্রভাগে ছিলেন। লেখক ড. অভিজিৎ রায়কে যখন বইমেলার গেটে হত্যা করা হয় তখন যে কয়জন প্রকাশক তাৎক্ষনিক মুহূর্তে চিৎকার করে গলা ফাটিয়েছেন, রবিন আহসান তার সম্মুখ সারির একজন। প্রকাশক দীপন হত্যা কিংবা প্রকাশক টুটুলের প্রাণনাশের চেষ্টার সময় হাসপাতালে সবার আগে পৌঁছেছেন যারা, রবিন আহসান সেই মুষ্টিমেয় প্রকাশকদের একজন। প্রকাশকদের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে রাস্তায় কিংবা মিডিয়ায় যারা প্রতিবাদ করেছেন, রবিন আহসান তার শীর্ষস্থানে।

বাংলা একাডেমী লঘু পাপে গুরুদণ্ড দিতে উদ্যোগী হয়নি, তারা রবিন আহসানের এই প্রতিবাদী কণ্ঠকে, মৌলবাদ বিরোধী তার নিরন্তর অবস্থানকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।

রবিন আহসানের প্রতি এই আঘাত তাই ব্যক্তি রবিন আহসান কিংবা প্রকাশনা সংস্থা শ্রাবণের উপর আঘাত নয়, এটি মৌলবাদ তোষণের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার একটি অংশ বলে সন্দেহ হচ্ছে।

এদেশের সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের তাই উচিত রবিন আহসানের পক্ষে দাঁড়ানো। এবং মৌলবাদীদের প্রশ্রয়দাতাদের হাত থেকে বাংলা একাডেমীকে উদ্ধারে ব্রতী হওয়া। বাংলা একাডেমী কোনো এলেবেলে প্রতিষ্ঠান নয়, বাঙালির রক্তমাখা আবেগে তৈরি প্রতিষ্ঠান, অবারিত কণ্ঠে কথা বলার লড়াইয়ের চেতনা থেকে যার জন্ম। এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানা প্রতিটি বাঙালির, একে মৌলবাদী তোষকদের হাতে ছেড়ে দেয়া যাবে না।

আমি খুবই বিস্মিত ও মর্মাহত যে বাংলা একাডেমীর পরিচালনা পর্ষদে দেশের যে খ্যাতিমান লেখক-বুদ্ধিজীবীরা আছেন তারা রবিন আহসানের উপর চাপিয়ে দেয়া এই অন্যায় অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তকে নৈতিক সমর্থন দিচ্ছেন। কয়েকটা পুরস্কার আর তকমার লোভে কী না জানি না, দেশের বাকি অধিকাংশ কবি সাহিত্যিকদেরকেও সরব হতে দেখলাম না। আর প্রকাশকদের তো সেই সাহসই হবে বলে মনে হয় না।

আজকে রবিন আহসানকে চুপ করিয়ে দেয়ার চেষ্টার মধ্য দিয়ে বাংলা একাডেমী যে ফ্যাসিবাদ আর মৌলবাদের ধ্বজা উড়িয়ে ধরল, সেই পাপ এই পরিচালনা পর্ষদ, দেশের তাবৎ লেখক সাহিত্যিক আর প্রকাশকদের গায়ে লেগে থাকবে। আজ রবিনকে চুপ করিয়ে রাখার প্রচেষ্টা সফল হলে কালকে যে বাকিদের উপর কখনো আক্রমণ আসবে না, সেটা ভেবে আত্মপ্রসাদ পাওয়া হবে  চূড়ান্ত মূর্খতা।

আমাদের সকলকেই সরব হতে হবে। নয়তো সেদিন খুব বেশি দেরি নেই, যেদিন এই দেশে শুধু দিস্তা দিস্তা মলাটবন্দি ছাপা কাগজ বের হবে, 'বই' আর বের হবে না। মৌলবাদী বাংলা একাডেমীর কোপানলের ভয়ে বেঁচে থাকা কাপুরুষরা লিখবে আর ছাপবে বটে, সেটি কখনোই 'বই' হয়ে সমাজকে আলোকিত করতে পারবে না।

আরিফ জেবতিক, ব্লগার ও সাংবাদিক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ