আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

Advertise

মুক্তিযুদ্ধে পাবনা-২

রণেশ মৈত্র  

জেলা প্রশাসক নূরুল কাদের খান যখন আমাদের দু‘জনকে কলকাতা রওনা হতে বলেন, তখন পুরাতন টেকনিক্যাল স্কুলের দোতলায় স্থাপিত হয়েছিল পাবনার মুক্তিযুদ্ধের কন্ট্রোল রুম। হঠাৎ তিনি দুজনকে পাশের ছোট্ট এক কামরায় নিয়ে গিয়ে আমজাদ সাহেব ও আমাকে একটি করে পাকিস্তানী ৫০ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এই দিতে পারা গেল তবে এতে কুলোবে না। বাকীটা দু‘জন ম্যানেজ করে নেবেন।

তাই নিয়েই আমরা রওনা হয়েছিলাম। তবে যেহেতু সরকারী জীপ আমাদেরকে ভেড়ামারা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়-তাই সে পর্যন্ত যেতে এক কপর্দকও ভাড়া লাগে নি। অত:পর সেখানকার এম.পি. একজন প্রাইভেট কার মালিককে বলে লিকারপুর পর্যন্ত আমাদেরকে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তারপর একটি ছোট নদী। নদীটিই সীমান্ত দু‘দেশের কিন্তু তা খুলে দেওয়া হয়েছে তাই পাসপোর্ট, ভিসার ঝামেলাও পোহাতে হয় নি তখন কাউকেই।

হেঁটে নদী পার হয়ে উঠলাম বাসে যাব কৃষ্ণ নগর। কিন্তু আমরা দু‘জনই শুধু নই অনেকেই পূর্ব বাংলা থেকে গিয়েছি তা জানতেই বাসের কন্ট্রাক্টর বললেন, ‘জয় বাংলা’ থেকে এসেছে? টিকিট লাগবে না। টিকেট কৃষ্ণনগর থেকে ট্রেনে কলকাতা যেতেও লাগল না। তাই বিনে খরচায় দিব্যি পৌঁছে গেলাম কলকাতায়। বাসেই খবর পেলাম রাজশাহী জেলা ন্যাপের সর্বজন শ্রদ্ধেয় সভাপতি এডভোকেট বীরেন সরকারকে পাকবাহিনী হত্যা করেছে এবং আতাউর রহমান সহ অপরাপর ন্যাপ নেতা আত্মগোপনে চলে গেছেন সপরিবারে।

আমরা অপেক্ষা করছিলাম মুখ্যমন্ত্রীর খবরের জন্যে। ইতোমধ্যে ১০ এপ্রিল আকাশবাণীতে পাবনার পতনের খবর পেয়েছি-আর পেলাম আওয়ামীলীগ নেতা আমজাদ হোসেন এম.এন.এর আকস্মিক মৃত্যু সংবাদ। তিনি মারা যান ৬ এপ্রিল আকাশবাণীতে পাবনার পতনের পাবনার পতনের খবর পেয়েছি-আর পেলাম আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ হোসেন এম.এন.এর আকস্মিক মৃত্যু সংবাদ। তিনি মারা যান ৬ এপ্রিল হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। পাবনার পদ্মার চরে।

দ্বিতীয় দফা পতনের পর হাই-কম্যান্ডের পক্ষে পাবনায় অবস্থান করা নিরাপদ ছিল না-তাই তাঁরা চুয়াডাঙ্গা হয়ে পশ্চিমবাংলার পথে রওনা দেন জেলা প্রশাসক নূরুল কাদেরের নেতৃত্বে (আইউব ইয়াহিয়ার প্রতি ঘৃণাবশত: তিনি ঐ সময় তাঁর ‘খান’উপাধি ত্যাগ করেন)।

পাবনার রাজপথ কাঁপানো ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রী শিরীন বানু মিতিল প্রতিরোধ যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে অল্প-স্বল্প-বন্দুক চালানো শিক্ষা নিয়েই তাকে পুরুষের বেশ ধরে এই যুদ্ধে অংশ নিতে হয়। সাহসী এই ছাত্র নেতা তখন সকলের শ্রদ্ধার আসন জয় করে নেয়। কিন্তু তাকেও দেশ ছাড়তে হয় দ্বিতীয় দফা পাবনা পতনের পর ন্যাপ নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা সহ।

১১ কিংবা ১২ এপ্রিল খবর পেলাম মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জী আমাদের ডেকেছেন। তৎক্ষণাৎ কমরেড ইলা মিত্রের স্বামী কমরেড রমেন মিত্র ও সি.পি.বি. সম্পাদক বিশ্বনাথ মুখার্জীর যোগাযোগ করে মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ে দ্বিতীয় দফা সাক্ষাত করতে গেলাম। তিনি জানালেন,“প্রধানমন্ত্রী আমাদের সাথে দেখা করতে আগ্রহী। আপনারা চাইলে দুজনের জন্যই দিল্লী যাতায়াতের জন্য প্লেনের টিকেট সংগ্রহ করে দেবো।”

অজয় মুখার্জী আরও জানালেন, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আপনাদের জন্যে আরও একটি বিকল্প পথ বলেছেন। ২/১ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের একজন বিশেষ প্রতিনিধি কলকাতা আসবেন তাজউদ্দীন আহমেদের সাথে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে। ঐ প্রতিনিধির সাথেও দেখা করে আপনাদের কথাগুলি জানাতে পারেন। দু‘দিনই আলোচনার সময় প্রবীণ একজন নেতা কংগ্রেস বিজয় কৃষ্ণ নাহারও যিনি ছিলেন প্রাদেশিক সরকারের ডেপুটি মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন।

আমাদের চিন্তায় এলো যেহেতু তাজউদ্দীন সাহেবে ঢাকা পৌঁছে গেছেন এবং যেহেতু পাবনারও ইতিমধ্যে পতন ঘটে গেছে তখন দিল্লী গিয়ে সময় নষ্ট না করে বরং তাজউদ্দীন সাহেবকেই সব বলা ভাল। অত:পর তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধির সাথে বৈঠকে আমাদেরকেও সঙ্গে নেবেন কি না বা তার প্রয়োজন হবে কি না। মুখ্য মন্ত্রীকে সেই অভিমতই জানিয়ে আমরা দিল্লী যাওয়া থেকে বিরত থাকলাম।

অত:পর আমজাদ সাহেব গেলেন তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে। আমি গেলাম আগের সিদ্ধান্তমত কমরেড ইলা মিত্রের বাসায়। সেখানে পাবনার ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী শিরীন বানু মিতিলের সাথে দেখা। মিতিল জানালেন পাবনা ত্যাগের কয়েক দিন আগে কলকাতার প্রখ্যাত ইংরেজি দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকার ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিশেষ প্রতিনিধি প্রখ্যাত সাংবাদিক মানস ঘোষ পাবনা গিয়ে তার একটি বিরাট সাক্ষাতকার নিয়েছিল যা দিন কয়েক আগে ঐ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। পুরুষ বেশে কাঁধে রাইফেল সহ মিতিলের ছবিও সাক্ষাতকারের সাথে ছাপা হয়েছে। কিন্তু ওর কাছে তার কপি না থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে তা দেখা সম্ভব হলো না।

যা হোক মিতিল তার কাজ শেষ করে চলে যেতেই কমরেড মনি সিংহ এসে উপস্থিত। ইলা মিত্র তো তাঁকে দেখে যেন চাঁদ হাতে পেলেন। আমাদেরও প্রায় তেমনই অবস্থা। কারণ মনি সিংহ রাজশাহী জেলে নিরাপত্তা আইনে বিনা বিচারে আটক থাকাকালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে। ঐ সময় কয়েদীদেরসহ জেল ভেঙ্গে মনি সিংহ বেরিয়ে আসেন এবং পদ্মা পার হয়ে ঘুরতে ঘুরতে চলে যান আগরতলা। কিন্তু অনেকদিন তাঁর খোঁজ যাচ্ছিলাম না।

যা হোক, মনি সিংহ (গোপন নাম বড় ভাই)বললেন, পাবনার খবর কি? সে সব শুনে তিনি বললেন, আমি তো জেল থেকে বের হয়েই শুনতে পাই আমাদের কমরেডরা ঢাকা থেকে নদীপথে এবং অন্যান্যভাবে আগরতলা গিয়ে পৌঁছেছেন। সেখানে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভা করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় পার্টি মুক্তিযুদ্ধের কাজে তার সর্বশক্তি নিয়ে নেমে পড়বে। বহু জেলা থেকে কমরেডরা নানা পথে পশ্চিম বাংলার নানা সীমান্তে এসে পৌঁছাচ্ছেন। এঁরা প্রায় সবাই তরুণ। ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী ও ন্যাপ ও সি.পি.বির নেতা-কর্মী।

আগরতলার তাঁদের সাথে ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফরের সাথেও কথা হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে প্রতিটি জেলার নিকটস্থ ভারত সীমান্ত এলাকায় যতগুলি রিক্রুটিং ক্যাম্প সম্ভব গড়ে তোলা হবে। আমরা তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রেশনিং এর মাধ্যমে নিজ নিজ ক্যাম্পেই করবো। সেখানে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সামরিক, বিশেষ করে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণে পাঠানো হবে। এ ব্যাপারে শীঘ্রই ভারত সরকারের সাথে আমাদের কথাবার্তা হবে। সুতরাং সবাই নিজ নিজ জেলার সীমান্ত এলাকায় গিয়ে রিক্রুটিং ক্যাম্প যত সত্বর সম্ভব গড়ে তুলুন। তখনও কলকাতায় ন্যাপ বা সি.পি.বির অফিস খোলা হয় নি তবে চেষ্টা চলছে।

কমরেড মনি বর্ণিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঈশ্বরদীর ছাত্র ইউনিয়ন নেতা সদ্য আসা সামছুজ্জামান সেলিম ও কামাল আহম্মেদসহ আমরা চলে যাই নদীয়া জেলায় করিমপুরে। সেখানে সি.পি.আই নেতা একটি ঘর ভাড়া নিয়ে দেন। আমাদের অস্থায়ী ভাবে থাকার ব্যবস্থা সেখানে হয়। কিন্তু সেখানে কর্মীদের থাকার বা অন্যান্য কাজের মত জায়গা না থাকায় আমরা অনেক খোঁজাখুঁজির পর করিমপুর কৃষ্ণনগর সড়কের ধারে একটা কাঁচাপাকা ভাড়া নেই। ওটাই হয় ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর রিক্রুটিং ক্যাম্প বা যুব শিবির এবং নয়টি মাস আমরা ওখান থেকেই কাজ চালাই। ঐ ক্যাম্পের পরিচালক হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই ভাবে শুরু হয়ে যায় পৃথকভাবে ন্যাপ-সি.পি.বি ছাত্র ইউনিয়নের মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র কার্যক্রম।

এই পর্যায়ে ধীরে ধীরে করিমপুরে আমাদের ছেলেরা আসতে থাকে। ক্যাম্পটিও জমজমাট হয়ে উঠতে থাকে। কলকাতায় পার্ক সার্কাসে ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি নিজ নিজ পৃথক কেন্দ্রীয় কার্যালয় গড়ে তুলেছে এমন খবর পেয়ে কলকাতা গিয়ে দুদিন থেকে উভয় দলের নেতাদের সাথে কথাবার্তা বলে করিমপুরের ঠিকানা জানিয়ে আসি। ন্যাপ করিমপুর ক্যাম্পের বাবদে মাসিক ১৫০০দেড় হাজার এবং আমার ব্যক্তিগত নানাবিধ খরচ বাবদ মাসিক ১৫০ টাকা বরাদ্দ করেছে বলে জানায়। ন্যাপ ওখানে ‘নতুন বাংলা’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতে সুরু করে। তখন ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ আলতাফ হোসেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড বারিন দত্ত (গোপন নাম সালাম ভাই)। সালাম ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম করিমপুর ক্যাম্পের জন্য আপনারা একজনকে দিলে সুবিধা হয়। ক্যাম্প পরিচালনা একজনের পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ। বিষয়টা স্বীকার করে তিনি বললেন, পাবনা জেলার অমুল্যদা বৃদ্ধ তাই তাঁকে আমরা বিশ্রাম দিয়েছি। আর কেউ তো নেই। আপনিই চালান। পাবনার কাউকে যদি পাওয়া যায় তখন দেখব।

মাসিক দেড় হাজার টাকায় তো একটা ক্যাম্প কোনভাবেই চলতে পারে না বিদেশের মাটিতে। বাড়ী ভাড়া, সব কিছু কেনা কাটা, রান্না-বাড়ি- সাবান-সোডা থেকে সুরু করে যাবতীয় ব্যয়ের জন্য ঐ টাকা নেহায়েতই অনুল্লেখযোগ্য। তবে সুবিধার মধ্যে ছিল - চাল-ডাল-তেল-নুন-আটা এবং লাকড়ি বিনে পয়সায় রেশন কার্ডে যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যেত। রেশন কার্ড রিফিউজি হিসেবে দিয়েছিল। তবে অত্যন্ত নিয়মিত এবং পরিমাণেও যথেষ্ট। ক্যাম্পের ছেলেরাই মাথায় করে বয়ে আনতো। সব কিছুই পেতাম বিনামূল্যে।

ভারত সরকারের সাথে কথাবার্তা হয়ে যাওয়ায় ন্যাপ-সি.পি.বি-ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের ভারতে সেনা শিবিরগুলিতে গেরিলা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও ইতোমধ্যে হয়ে যাওয়ার ফলে আমরাও প্রশিক্ষণে পাঠাতে সুরু করেছি। শামছুজ্জামান সেলিম, কামাল আহমেদ, জাহিদ হাসান উদ্দিন প্রমুখ পাবনার প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য সামরিক বাহিনীর জীপে চলে যায়। পরে আরও বেশী সংখ্যায় দফায় দফায় এমন প্রশিক্ষণে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।

এদিকে ক্যাম্পের চার পাশে ছিল শুধুমাত্র মুসলিম বসতি। পশ্চিম বাংলার মুসলিম সম্প্রদায় ছিলেন সাধারণভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী। তাঁরা একদিন বলেই ফেললেন। আপনারা যদি সত্যিই বাংলাদেশকে স্বাধীন করে ফেলেন তাহলে বিপদে আপদে ভারতের মুসলিমদের যাওয়ার তো বিকল্প কোন জায়গা থাকবে না। আমরা কোথায় স্থান পাব?

ক্যাম্পের পাশে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী পরিবারগুলিকে মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্কে ভালভাবে বুঝিয়ে আনাটা তখন হয়ে দাঁড়ালো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক রাজনৈতিক দায়িত্ব। তখন তাঁদেরকে রোজ সন্ধ্যায় বা ভোরে তাঁদের ৩/৪ ব্যান্ডের রেডিও সঙ্গে নিয়ে আনতে অনুরোধ জানালাম। রাজী হলেন তাঁরা। তখন তাঁদেরকে ঐ রেডিও থেকে আকাশ বাণীর খরব, বিবিসির খবর, পাকিস্তানের বেতারের খবর, যারা প্রায় প্রতিদিনই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আমাদের ক্যাম্পে আসছিলেন তাদের জীবনীতে দেশের অভ্যন্তরের ঘটনাগুলি কিছুদিন শুনানোর পর তাঁরা ঘোরতর পাকিস্তান বিরোধী এবং মুক্তিযুদ্ধ সমর্থক হয়ে পড়েন। তখন দেখতাম বাড়ী থেকে তরিতরকারি এবং নানাবিধ খাবার মাঝে মধ্যেই ক্যাম্পের তরুণদের জন্য তাঁরা নিয়ে আসতেন। এভাবে তাঁদের সাথে আমাদের গভীর মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁরা হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দৃঢ় সমর্থক। বুঝে ওঠেন বাঙালিরা সাম্প্রদায়িকতা ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ পৃথিবীর সকল নির্যাতিত ও শোষিত মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবেই থাকবে।

আমরা ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর জন্য রিক্রুটিং ক্যাম্প যেটা নদীয়া জেলার করিমপুরে গড়ে তুলেছিলাম সেটা ছিল পাবনা জেলার প্রথম ও প্রধান ক্যাম্প বা যুব-শিবির। এটাতে ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী-সমর্থকেরা প্রথম থেকেই ভিড় জমাচ্ছিলেন গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য। এখানে প্রত্যেকের জন্য ন্যূনতম তিন সপ্তাহের সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ, একই সাথে তাদের চলাফেরা পর্যবেক্ষণ, ক্যাম্পের নানা দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতা, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সাহসিকতা, কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্তের প্রতি মমত্ববোধ প্রভৃতি পর্যালোচনা করে গেরিলা প্রশিক্ষণে পাঠানো উপযুক্ততা নিরীক্ষণ করে তার তালিকা প্রণয়ন - (সকলের ক্যাম্প ডিসিপ্লিন মেনে চলার ক্ষেত্রে নিষ্ঠাবোধ সহ) ক্যাম্প পরিচালক হিসেবে এককভাবেই করতে হতো-যা অত্যন্ত দুরূহ।

সমস্যাটা জানালাম পুনরায় কমিউনিস্ট পার্টিকে। তাঁরা কলকাতায় ডেকে পাঠালেন এবং সমাধানের ব্যাপারে আমার মতামত জানতে চাইলেন স্বয়ং কমরেড বারিন দত্ত (সালাম ভাই)। বললাম, কমরেড অমূল লাহিড়ী তো মাঝে-মধ্যে যান এবং গিয়ে দেখে আসেন তাঁর কাছে থেক ওটুকুই যথেষ্ট। কমরেড জসীম মণ্ডল জানমত গঠনের কাজে নানা জায়গায় ভারতীয় শ্রমিকদের সমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছেন এটাও গুরুত্বপূর্ণ। কমরেড আমিনুল ইসলাম বাদশা কোলকাতায় অবস্থান করে রিফিউজিদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণে ভারত-বাংলাদেশ সহায়তা সমিতির সাতে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করছেন-এ প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য তবে ঘাটতি পড়ে যাচ্ছে ক্যাম্পে রিক্রুটমেন্ট-প্রশিক্ষণ দেশের ভেতরে অস্ত্রসহ পাঠানো খবরাখবর সংগ্রহ ও প্রচারের ব্যবস্থা করার মত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজটি।

বললাম, এ কাজে সর্বাধিক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন কমরেড প্রসাদ রায়। ওনাকে পেলে দু‘জনে মিলে আমরা চালিয়ে যেতে পারব। সালাম ভাই জিজ্ঞেস করলেন তিনি কোথায়? বললাম, সঠিক জানি না-তবে শুনেছি ৩/৪ মাস হলো তিনি আগরপাড়ায় তাঁর দাদার বাড়ীতে স্ত্রী-সন্তান সহ অবস্থান করছেন। তদুপরি তিনি তো দু’তিন বছর আগে পার্টির জেলা সম্মেলনের সিদ্ধান্তের সাথে একমত না হওয়াতে সদস্যপদ স্থগিত রাখার আবেদন জানিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন। সালাম ভাই বললেন, এগুলি সবই জানি। তবু আপনিই তাঁর সাথে কষ্ট করে দেখা করে অফিসে নিয়ে আসুন। দেখি চেষ্টা করে।

ঐ বাড়ীতে আমিও কোনদিন যাই নি। তাই বেশ খুঁজে খুঁজে বের করে দেখা করতেই সকল কিছু জানতে চাইলেন। বললাম বিস্তারিত। অত:পর কেন এসেছি তা বলতে তিনি সালাম ভাই এর সাথে দেখা করতে এখুনই আমার সাথে রওনা হলে ভাল হয়-এ কথা বললাম। রাজী হলেন। অত:পর চা-নাস্তা খেয়ে উঠেই কলকাতা রওনা হলাম।

সালাম ভাই প্রসাদ দাকে বললেন, সব তো শুনেছেন এখন আপনি বলুন করিমপুর ক্যাম্পে রণেশ বাবুর সাথে দায়িত্ব পালন করতে সম্মত আছেন কি না। তিনি সম্মতি জানালে সালাম ভাই বললেন সেক্ষেত্রে আপনাকে পার্টি সদস্যপদ পুনরুজ্জীবনের জন্য দরখাস্ত করতে হবে। তাও তিনি তৎক্ষণাৎ করে তাতে তিনি লিখলেন সম্মেলনে ভিন্নমত থাকলেও “দলীয় সদস্যপদ স্থগিত রাখার আবেদন জানিয়ে এতদিন নিষ্ক্রিয় থেকে ভুল করেছি।”

সালাম ভাই হেসে বললেন,“দাদা-আপনারা প্রবীণ। তাই ভুল সংশোধনী তো কঠিন হবে না। যত দ্রুত সম্ভব করিমপুর চলে যান।” প্রসাদ দা পরদিন সকালেই যাবেন বললেন। একসাথেই পরদিন চলে গেলাম করিমপুর। সেই থেকে দু‘জন মিলে করিমপুর ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব পালন করল ডিসেম্বর অবধি।

অপরদিকে করিমপুর থেকে মাইল দশেক দূরে মুর্শিদাবাদ জেলার জলঙ্গী। পদ্মার তীরবর্তী একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম্য শহর। সেখানে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের একটি রিক্রুটিং ক্যাম্প স্থাপন করেছেন এবং পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা আজকের ভূমি মন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলু। দেখা হলো-কথাবার্তা হলো তাঁর ক্যাম্পে বসে। অনেকক্ষণ।

পাবনা জেলা ন্যাপের অন্যতম নেতা ঈশ্বরদীর আবদুল হালিম চৌধুরী জানালেন তিনিও জলঙ্গীতে ন্যাপের একটি রিক্রুটিং ক্যাম্প unofficially খুলেছেন। এটাকে officially recourse করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা চাইলেন। বললাম শুধুমাত্র ন্যাপের নয়-এটাকে হতে হবে পাবনা জেলার ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনী রিক্রুটমেন্টের দুই নম্বর ক্যাম্প। হালিম চৌধুরী হলে সুযোগ মত কলকাতা গিয়ে সে ব্যবস্থাও করা সম্ভব হলো।
ক্রমশ :

রণেশ মৈত্র, লেখক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক; মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ইমেইল : [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ