আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

মুক্তিযুদ্ধে পাবনা-৫

রণেশ মৈত্র  

ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির পাবনা জেলার কার্যক্রম মূলত: পাবনা সদর ও ঈশ্বরদী থানা এলাকার মধ্যেই সীমিত ছিল পাবনা সদর মহকুমায়। যথেষ্ট সংখ্যক সমর্থক ও সুজানগর থানায়। এই সব এলাকা থেকেই করিমপুর ও জলঙ্গী ক্যাম্প রিক্রুট করা হতো প্রধানত:। অনেকে আবার কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পের মাধ্যমে ভর রাতে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছে ন্যাপ-সিপিবির ক্যাম্পের সন্ধান না পেয়ে।

অপর পক্ষে সিরাজগঞ্জ ছিল পাবনা জেলার বৃহত্তর মহকুমা। সেখানকার মধ্যবিত্তদের মধ্যে যতটা তার চাইতে শ্রমিকদের, বিশেষ করে বিড়ি ও কলেজ টেক্সটাইল মিল শ্রমিকদের মধ্যে ন্যাপের বিশাল সংগঠন ও বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল। ন্যাপের প্রধান নেতা সেখানে ছিলেন সাইফুল ইসলাম। এছাড়াও মুরাদ হোসেন এবং আরও অনেকে। তরুণদের মধ্যে ভূপাল সাহা, আবুল হোসেন, ইসমাইল হোসেন প্রমুখ ছিলেন। সংখ্যায় অনেক। কিন্তু আর কারও নাম স্মরণে আনতে পারছি না।

তবে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে মাওলানা ভাসানী নৌকা পথে আসাম রওনা হয়ে সিরাজগঞ্জ থেকে সাইফুল ইসলাম ও মুরাদ হোসেনকে ঐ নৌকায় তুলে নিয়ে যান। সাইফুল ইসলাম তখন পাবনা জেলা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু মওলানা ভাসানী ভারতে গিয়ে পৌঁছানোর পর তাঁর তৎকালীন চীনপন্থি রাজনীতির কারণে (চীন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে এবং পাকিস্তানকে ও সমর্থন যুগিয়েছিল) তাঁকে পুরো নয় মাস নজরবন্দী করে রাখে। তবে তিনি যখন যেখানে যেতে চাইতেন বিশেষ ব্যবস্থায় তাঁকে সেখানে নেওয়া হতো।

যা হোক জেলা কমিটির সম্পাদকের অনুপস্থিতি জনিত কারণে যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে আমাকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়, তবে আমাকে থাকতে হবে করিমপুরেই এমনই নির্দেশনা তখন দেওয়া হয়েছিল। এই কারণে সিরাজগঞ্জের ন্যাপ কোন ক্যাম্প খুলতে পারেনি তবে নানাভাবে তারা ট্রেনিং নিয়েছে। পাবনা সদরের ঈশ্বরদীতে প্রথম দফায় প্রতিরোধ যুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ নেতারা মিলিতভাবে কাজ করেছেন। এঁদের মধ্যে শামসুর রহমান শরিফ ডিলু, মহীউদ্দিন আহমেদ, ইসহাক আলী, কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডল,শামছুজ্জামান সেলিম, নায়েব আলী বিশ্বাস, কামাল আহমেদ, শহীদুজ্জামান নাসিম প্রমুখের নাম মনে পড়ে। পরবর্তীতে এঁরা ভারতে আশ্রয় নিয়ে নিজ নিজ দলীয় ক্যাম্পের মাধ্যমে গেরিলা বা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে নানামুখী ভূমিকা রাখেন।

বেড়া-সাঁথিয়া অঞ্চল ছিল অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, নিজাম উদ্দিন প্রমুখ আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতাদের পরিচালিত এলাকা। ২৬ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত তারা অন্যান্যদের সাথে নিয়ে ঐ দুই থানার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলেন এবং পরবর্তীতে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণাদি গ্রহণ করে দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন।

চাটমোহর ফরিদপুর (তখন ভাঙ্গুড়া থানা বা উপজেলার অস্তিত্ব ছিল না)- ভাঙ্গুড়ার কয়েকটি ইউনিয়ন ছিল ফরিদপুর থানার অধীনে অবশিষ্টগুলি চাটমোহরের অন্তর্ভুক্ত। থানার সমস্যা ছিল ঐ এলাকার সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোজাম্মেল হক দেশের অভ্যন্তরে আটকে পড়ায় এবং ভারতে যেতে না পারায় মুক্তিযুদ্ধের কাজে ভূমিকা রাখতে পারেন নি তবে ঐ থানার বেশ কিছু আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ নেতা দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণাদি নিয়ে দেশে ফিরে যুদ্ধে নিজ নিজ ভূমিকা রাখেন। ন্যাপ-নেতারাও দীর্ঘ দিন দেশের অভ্যন্তরে থেকে কাজ করার পর দেশ ছেড়ে যেয়ে করিমপুরে আমাদের ক্যাম্প ভর্তি হন কিন্তু তখন সম্ভবত: নভেম্বর মাস। তাঁরা ক্যাম্প থাকাবস্থায় ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হওয়ায় রিক্রুটিং ক্যাম্পে অবস্থানরত থেকে দিন কয়েক পর নিজ নিজ অঞ্চলে ফিরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে দেশ গঠনের আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন। ফরিদপুর থানার চিত্রও অনুরূপ।

গোটা পাবনা জেলার (তদানীন্তন) মধ্যে সিরাজগঞ্জ মহকুমার উল্লাপাড়া থানার ছাত্রলীগ নেতা আবদুল লতিফ মীর্জা (পরবর্তীতে জাসদ এবং সবশেষে আওয়ামী লীগ) একটি ইতিহাস রচনা করেছিলো। অসীম সাহসী এই যুবক তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে ঐ থানার অভ্যন্তরেই একটি বিশাল বাহিনী গড়ে তুলে বীরত্বপূর্ণ লড়াই চালিয়েছিল পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে। বাহিনীটি লতিফ-বাহিনীর নামে পরিচিতি অর্জন করে। যেমন টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল কাদেরিয়া বাহিনী। কাদেরিয়া বাহিনী পাক-সেনা ও রাজাকার বাহিনীর কাছে যেমন একটি ভয়াবহ ত্রাসের বাহিনী হয়ে দাঁড়িয়েছিল উল্লাপাড়ার লতিফ বাহিনীও তেমনই।

কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নেতা কমরেড অমূল্য লাহিড়ীও উল্লাপাড়া থানার লাহিড়ী-মোহনপুরের মস্তান। করিমপুরের ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র ইউনিয়নের রিক্রুটিং ক্যাম্প তথা যুব শিবির পরিচালনাকালে ঐ নয় মাসে কয়েকটি বিচিত্র ঘটনা ঘটেছিল। তদার মধ্যেই একটি ঘটে বর্ষাকালে।

বর্ষার সন্ধ্যা। টিপটিপ করে সকাল থেকে সারা দিন সারারাত বিরতিহীন বৃষ্টি। মাঠ-ঘাট-রাস্তা সবই ভেজা। সম্ভবত: কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার সন্ধ্যারাত থেকেই। ঐ সন্ধ্যায় হঠাৎ এক ভদ্রলোক ছাতা মাথায় দিয়ে আমাদের ক্যাম্পের সামনে এসে দাঁড়াল। তখন রাজনৈতিক ক্লাস নিচ্ছিলাম ছেলেদের। একটি ছেলেকে পাঠালাম লোকটা কি বলে তা শুনতে। লোকটি একটি কাগজ ছেলেটির হাতে দিয়ে পাঠায়। তাতে আমার নাম লেখা। আমি তখন লোকটিকে বললাম ঐ নাম তো আমার কি কারণে কোথা থেকে এসেছেন?

উনি জানালেন কোলকাতা থেকে এক ভদ্রলোক এসেছেন আপনার সাথে কথাবার্তা বলতে। আমি ট্যাক্সি ড্রাইভার। বললাম, বৃষ্টির ফলে তো বাইরে গিয়ে কোন আলাপ করা দুরূহ। বরং ওনাকে এখানে নিয়ে আসুন। ভদ্রলোকটি ফিরে এসে বললেন, উনি আপনাকেই যেতে বললেন মিনিট পাঁচেকের জন্য। আমার কাছে ছাতা আছে তাই অসুবিধে হবে না। শেষ পর্যন্ত গেলাম। ওনার পরিচয় জানতে চাইলে বললেন, “আমি লন্ডন থেকে এসেছি। সেখানে চাঁদা তুলে বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কিছু সাহায্য দিতে এসেছি। আমার নাম ফতেহ লোহানী কমিউনিস্ট পার্টি করি।

বললাম, কোনদিন পরিচয় বা দেখা সাক্ষাত না হলেও আপনার নাম আমার জানা। তা বলুন আর একটু পরিষ্কার করে। উনি বললেন, আমি আপনাকে হাজার পঞ্চাশেক ভারতীয় টাকা এখনই দিতে পারি সঙ্গে এসেছি। আর কিছু অস্ত্র। আমি তো । বললাম দেখুন আমি একটি জেলার ক্যাম্পের পরিচালক। ন্যাপ-সি.পি.বি. ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর পাবনা জেলার রিক্রুটিং ক্যাম্প এটা। তাই অস্ত্রের দরকার নেই এখানে। আমি বরং টাকাগুলি এবং অস্ত্র যা-ই থাক, সেগুলি কলকাতায় আমাদের কেন্দ্রীয় অফিসে গিয়ে দলের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বা সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাদ হোসেনের কাছে জমা দিন। দলীয় ও সামরিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ওগুলি আমি নিতে পারি না। অথবা আপনি কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে কমরেড বারিন দত্ত বা মোহাম্মদ ফরহাদের কাছেও দিতে পারেন। কিন্তু ফতেহ লোহানী বললেন,“আপনাকে নামে অনেকদিন থেকে চিনি এবং শ্রদ্ধাও করি। কিন্তু আপনিও তা হলে রুশ সংশোধন বাদীদের পাল্লায় পড়েছেন? যা হোক এনেছি যখন, নিন। আপনাদের কলকাতা অফিসে আমি যাব না। আমি বললাম, ধন্যবাদ কিন্তু আমি আবারও বলছি, নীতিগত এবং দলীয় শৃঙ্খলার কারণে এগুলি নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।” তিনি ফিরে চলে গেলেন।

আর একদিন দেখি বড় একটি রুই মাছ (৮/১০ কেজি ওজনের) পাকা বড় সাইজের চারটি মিষ্টি কুমড়া এবং বেশ কিছু সবজি নিয়ে একজন মুসলিম প্রতিবেশী এসে উপস্থিত। “কি ব্যাপার?” জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, এগুলি আপনাদের ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আমার উপহার। দেখছি তো ছেলেরা কত কষ্ট করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পারলে একদিন দুটি খাসি এনে জবাই করে দেব। প্রতিবেশীটি বিবিসি শোনানোর জন্য তাঁর ৪ ব্যান্ডের রেডিও নিয়ে রোজ সন্ধ্যায় ক্যাম্পে আসতেন। বললাম, আপনাকেও তা হলে খেতে হবে আমাদের সাথে। রাজী হলেন। সেদিন পূরবী রান্না করলেন সম্ভবত: মাছ কেটে দিলেন যিনি এসেছেন তিনিই। আসলেই অনেক দিন পর মুখটা বদলানো গেল ছেলেদের।

এ এক নতুন অভিজ্ঞতা করিমপুর ক্যাম্প জীবনের। বিশেষে করে ওখানকার মুসলিমদেরকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকে পরিণত করতে যে সত্যিই পেরেছি তা প্রমাণ হলো।

একদিন কি কাজে যেন গেলাম রানাঘাট। সেখানে একটি পথিপার্শ্বস্থ রেস্টুরেন্টে দু তিনজন পাবনার লোক বসে এক পেয়ালা করে চায়ের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করা কালে পাকিস্তান বেতার থেকে ঘোষণা করা হলো “এই মুহূর্তে বীর পাকিস্তানী সৈন্যরা পশ্চিম বাংলার রানাঘাটের রেলস্টেশন বাজার ও শহরাঞ্চলে ব্যাপক বোম্বিং করছে। ইতিমধ্যেই পঞ্চাশ জন বিশ্বাস ঘাতক “মুক্তি”র মৃত্যু ঘটেছে।” অথচ আমরা দিব্যি বাজারের রাস্তার ধারের দোকানে বসে চা খাচ্ছি। লোকজন রেলওয়ে ষ্টেশনে যথারীতি যাতায়াত করছে এবং জনজীবনও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কোন পাকিস্তানী বিমানও আকাশে উড়তে দেখা যায় নি। এই ছিল পাকিস্তানী মিথ্যা প্রচারণার ধারা যা প্রতিদিনই তারা করতো।

তাই আকাশ বানীর আর বিবিসিই ছিল বাঙালীর কাছে সত্য খবর জানার প্রধানতম অবলম্বন। আকাশবাণীতে খবর পরিবেশনের পরে পাঁচ মিনিটের যে সংবাদ পর্যালোচনার আমরা কাঁপানো কণ্ঠে ভরাট গলায় যে উচ্চারণ প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় শুনতাম, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সেই কণ্ঠদাতা। আর তা লিখতেন পাবনার সন্তান আমার সহপাঠী প্রণবেশ সেন।

যা হোক এবার পাবনার আওয়ামী লীগ নেতারা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে বিশাল অবদানে রেখেছেন তাঁদেরকে স্মরণ করি ক্যাপ্টেন মনসুর আলী (মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী), ওয়াজি উদ্দিন, এডভোকেট গোলাম হাসায়েন, এডভোকেট আমজাদ হোসেন, রফিকুল ইসলাম বকুল, বেবী ইসলাম, জহুরুল ইসলাম বিশÍ প্রমুখ। তরুণদের সকলেই প্রায় মুজিব বাহিনী ভুক্ত।

মুক্তিবাহিনী (এফ এফ) ছিল মুজিবনগর সরকারের এবং ভারতের ইন্দিরা গান্ধী সরকারের স্বীকৃতি বাহিনী। ন্যাপ-সি.পি.বি ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীও ছিল। পাবনা জেলায় মুক্তি বাহিনীর কম্যান্ডার ছিলেন মকবুল হোসেন সন্টু এবং ডেপুটি কম্যান্ডার পাকশীর এডভোকেট বদরুল হক সুধা (বর্তমানে ঢাকা হাইকোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত)। পার্ক সার্কাসে ছিল ন্যাপ ও সি.পি.টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়।

ন্যাপ অফিস থেকে খবর পেলাম ১৪ ডিসেম্বর অফিসে দলীয় সভাপতি। সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাতের। কিন্তু পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচীর শেষ করে সন্ধ্যায় রওনা হলাম করিমপুর থেকে কলকাতা পৌঁছাতে রাত- ১১টা হয়ে গেল তাই সেদিন আর অফিসে যাওয়া সম্ভব হলো না।

পরদিন বেলা ১১ টার দিকে অফিসে গিয়ে দেখি ভাল সংখ্যক কলকাতা-কেন্দ্রিক সাংবাদিক নেতাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। তাঁরা এসে জানালেন ১৬ ডিসেম্বর যশোর টাউন হল ময়দানে (শত্রু মুক্ত যশোর) ন্যাপের জনসভা। তাঁরা অফিসে সকাল ৮ টার মধ্যে এলে দলের ব্যবস্থাপনায় বাসে করে তাঁরা যেতে পারবেন। আমাকে বললেন আরও কিছু আগে আসতে-ন্যাপের অপরাপর নেতা-কর্মীরাও বাসে যাবেন।

খবরটা রীতিমত চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলো। অনেকেই যেতে উৎসাহিত হলেন। এটাও ধরে নেওয়া হয়েছিল যে কোন মুহূর্তে পাক-বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে।

যা হোক ১৬ ডিসেম্বর সকালে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই অফিসে পৌঁছে দেখি ১০/১২ জন সাংবাদিক এবং বিপুল সংখ্যক ন্যাপ, নেতা কর্মী নিয়ে যাবার জন্য দুটি বড় বাস দাঁড়িয়ে আছে। আসলে ৮.৩০ মিনিটে গাড়ীগুলো ছাড়লো যশোরের দিকে। সে এক অপূর্ব শিহরণ। সেই পহেলা এপ্রিল তারিখে ছেড়ে আসা বাংলাদেশে একদিনের বা কয়েক ঘণ্টা জন্য ডুকলো অবরোধমুক্ত বাংলাদেশের যশোরে। কতই না বন্ধু বান্ধবকে দেখতে পাব অথবা হয়তো অনেককে পাবই না।

ইতিমধ্যে হাতে হাতে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সেদিনকার টাটকা দৈনিক পত্রিকা। পত্রিকাগুলি মর্মান্তিক খবর পরিবেশন করেছে বড় বড় হেডিং দিয়ে। তাতে একদিকে আছে পাক বাহিনীকে অবিলম্বে আত্মসমর্পণের আহ্বান সম্বলিত যুদ্ধের প্রায় শেষ মূহুর্তের খবর অন্যদিকে প্রায় অনুরূপ শিরোনামে ঢাকায় বুদ্ধিজীবীদের নিধনের মর্মান্তিক খবর। আনন্দ-বেদনার এমন সংমিশ্রণ খুব একটা সহসা মেলে না। এই আনন্দ-বেদনা মিশ্রিত মন নিয়েই বেশ তিনটের দিকে আমরা যশোর গিয়ে পৌঁছোলাম। পথে পথে থামতে হয়েছে চা-নাস্তা এবং পরে দুপুরের খাবার খেয়ে নেওয়ার জন্য। আমার হাতে ছিল এক ব্যান্ডের একটি ট্রানজিস্টার রেডিও। ওটাই সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধুর মত সবশেষের খবরগুলি জানাচ্ছিল।

অল্পক্ষণের মধ্যেই যশোরের মাঠ আধাআধি ভরে গেল হাড় জিরজিরে দেহ নিয়ে। দেখা হলো যাদের সাথে তাদের মনে একদিকে মনে আনন্দ তেমনি শঙ্কা তখনও পুরোপুরি কাটেনি। খুলনা থেকে আবার না আমি এসে পড়ে আবার না পালাতে হয়।

জনসভার শুরু হলো যশোরের ন্যাপ সভাপতি প্রবীণ জননেতা এডভোকেট আবদুর রাজ্জাকের সভাপতিত্বে। প্রধান বক্তা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, বেগম মতিয়া চৌধুরী প্রমুখ। মাঠে দাঁড়িয়ে নেতাদের বক্তব্য শুনছি এক কানে অপর কানে রেডিও। পাঁচটার পর পরই ঘোষিত হলো বিশেষ খবর এই মুহূর্তে পাক-বাহিনী ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করলো। খবরটি বার বার প্রচার করা হচ্ছিল। ছুটে মঞ্চের কাছে গিয়ে মতিয়া চৌধুরীকে খবরটি দিয়ে রেডিওটি তাঁর হাতে দিতেই তিনি আবার বক্তৃতারত অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদকে কথাটা বলে রেডিও তাঁর হাতে দিলেন। তিনি শুনেই তা মাইকে ঘোষণা দিয়ে বললেন সভার কাজ এখানেই শেষ আপনারা আনন্দ উল্লাস করুন। সে কী উল্লাস।

আমরা সহসাই কলকাতার পথে রওনা হলাম। পরদিন মাননীয় মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সাথে যেন দেখা করি এমন খবর পেয়ে দেখা করলাম ১৭ ডিসেম্বর। তিনি জানালেন, এক সপ্তাহ পরে যেন আমরা পাবনা রওনা হই-অর্থাৎ যেন একটু খবর নিয়ে রওনা হই কারণ পাবনা তখনও বিপদ মুক্ত হতে পারে নি নকশালদের হাতে বিপদমুক্ত হতে পারে নি নকশালদের হাতে হাতে পাক বাহিনীর অস্ত্র থাকার কারণে। রাজাকার আলবদরও পাবনাতে ঠাসা নিজামীদের কল্যাণে। পাক-বাহিনীও তখন পর্যন্ত সারেন্ডার করে নি।

ফিরে এসে নদীয়ার জেলা প্রশাসকের সাথে যোগাযোগ করে একটা ট্রাকের ব্যবস্থা করলাম। তিনি বললেন, ২৫ ডিসেম্বরে নিন। আমরা তাতেই রাজী হলাম-মনসুর সাহেবকেও জানালাম। তাঁরা অবশ্য আগেই বিমানযোগে চলে যাবেন ঢাকায়। মন্ত্রণালয় সাজাবেন সেখানে।

পাবনাতে সরাসরি চলে যাবেন ট্রাকটি আমাদের ক্যাম্পের সকল কিছু নিয়ে। জমেও ছিল চাল ডাল তেল নুন প্রভৃতি অনেক কিছুই। রিক্তহস্ত জনা পঞ্চাশেক অপেক্ষমাণ গেরিলা প্রশিক্ষণার্থীকেও সঙ্গে নিলাম। যেমন ক্যাম্পে রোজ সকালে ফাইল দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত সবাই মিলে গাইতাম।

চললাম সব গান গাইতে গাইতে। বিজয়ের গান। নানা গণসংগীত। কবিতা আবৃত্তি আর কণ্ঠে জয়বাংলা ধ্বনি।

বিজয়ীর বেশে পাবনা পৌঁছে গেলাম ২৬ ডিসেম্বর পাবনা শহরে সে এক ভিন্ন পাবনা। অচেনা এক পাবনা যেন। আগুনে পোড়া, ভাঙাচোরা সব ঘর বাড়ী। কিন্তু পাবনার পাক আর্মি ডাক-বাংলোতে তখনও আত্মসমর্পণ করে নি। তারা মুক্তিবাহিনীর কাছে তা তা করতে রাজী নয় করবে ভারতীয় বাহিনীর কাছে। মুক্তিবাহিনী হয়তো জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী চলবে কিনা এ সন্দেহে।

১৮ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনী এলো পাক-বাহিনী আত্মসমর্পণ করলো। পাবনা মুক্ত হলো। তবে মুক্তিযুদ্ধ চেতনার ন্যায় সি.পি.বির অবদানের কাহিনীর এখানেই শেষ নয় অবশিষ্টাংশ দেশে ফিরে লিখব।

রণেশ মৈত্র, লেখক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক; মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ইমেইল : [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ