আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

গ্যাং কালচার, আত্মকেন্দ্রিকতা ও কিশোর আদনান

মাসকাওয়াথ আহসান  

রাজধানী ঢাকার উত্তরায় কিশোরদের মাঝে যে গ্যাং কালচার গড়ে উঠেছে; তার নির্মম শিকার হয়েছে নবম শ্রেণীর ছাত্র আদনান। ডিসকো বয়েজ ও নাইনস্টার নামে দুটো গ্যাং-এর দ্বন্দ্বে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে কিশোরটিকে।

এ এমন এক অশনি ঘটনা; যা আমাদের আতংকিত করেছে। এমনিতেই শিশুদের শৈশব আমরা কেড়ে নিয়েছি ভুল শিক্ষাব্যবস্থার সিসিফাসের পাথর তাদের কাঁধে বেঁধে দিয়ে। মহানগরে এপার্টমেন্টে আটকে ফেলা হয়েছে শিশুদের জগতটিকে। তাদের খেলার মাঠ নেই। ব্যালকনির গ্রিলের ফাঁক দিয়ে এক টুকরো আকাশ দেখা ছাড়া; শিশুদের জন্য নিসর্গের কাছে আসার সুযোগ খুবই সীমিত। যে এলাকায় খেলার মাঠ রয়েছে; সেখানে খেলার মাঠে গিয়ে আবার যদি শিশুরা নানারকম গ্যাং-এ জড়িয়ে পড়ে; সেখানেই শুরু হয় ছোট ছোট অপরাধের হাতেখড়ি; এরপর হত্যার মত বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়া অথবা হত্যার শিকার হওয়া; এসব ঘটনা আতংকিত হবার মতো।

ঢাকা মহানগরীতে দেশের নানা জায়গা থেকে নানা প্রকৃতির মানুষজন এসে বসত গড়ে। পৃথিবীর সমস্ত কসমোপলিটান শহরেই তা ঘটে। কিন্তু অন্যান্য কসমোপলিটানের তুলনায় ঢাকায় যেন একটু বেশী বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত বসবাস করে মানুষ। পারস্পরিক চেনাজানা ও মেলামেশার সংস্কৃতি যেন নেই বললেই চলে। অনেকে এটিকে নগরায়নের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য বলে মনে করলেও; আদৌ তা নয়। পশ্চিমের অত্যন্ত ব্যস্ত নগরেও প্রতিবেশীর মাঝে চেনাজানা হয়; একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকে। কেউ কারো প্রাইভেসিতে উঁকি দেয়না; কিন্তু প্রয়োজনে কাজে আসে তারা। অথচ প্রাচ্যের বন্ধনের ঐতিহ্যের মাঝে বসবাস করেও কোত্থেকে নগরায়নের বিশুষ্ক সংস্কৃতি রপ্ত করেছে ঢাকা; যেখানে মানুষ থেকে মানুষের মাঝে এমন দেয়াল।

যে কোন জনপদেই সামাজিকতার বিস্তার না ঘটলে নানারকম বিপর্যয় এগিয়ে আসে। উত্তরায় গ্যাং কালচারের বিস্তার এরকম একটি বিপর্যয়। টিনেজদের মাঝে খুব স্বাভাবিকভাবেই একটু হিরোইজম দেখানোর প্রবণতা থাকে; এর প্রয়োজনও আছে। কিন্তু সেটা বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে এন্টি হিরোইজম তৈরি হলেই বিপত্তি। সেটাই দৃশ্যমান হচ্ছে ঢাকার নানা জায়গায় কিছু কিশোরের মাঝে। এর বড় কারণ হচ্ছে সামাজিক স্নেহ ও শাসনের অনুপস্থিতি। শিশু-কিশোরদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়া কেবল বাবা-মা'র দায়িত্ব নয়; এটি সামাজিক দায়িত্বের মাঝেই পড়ে। কেউ কারো দিকে না তাকিয়ে আত্মকেন্দ্রিক জীবন যাপন করলে; সে জনপদের সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। খুব সম্ভব আত্মকেন্দ্রিকতার তিক্ত ফল পেতে শুরু করেছে ঢাকা নামের মেট্রোপলিটনটি।
উত্তরার যে শিশু-কিশোররা গ্যাং কালচারে অভ্যস্ত হয়েছে; এর উপরে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। উত্তরার কিশোর গ্যাং-গুলো বিভিন্ন এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ বিস্তারের যে খেলা শুরু করেছে; তা আসলে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মত প্রাধান্য বিস্তারের চলে আসা অপসংস্কৃতিরই অনুকরণ। কারণ শিশু-কিশোরেরা অনুকরণপ্রিয়। রাজনৈতিক গ্যাং-গুলোর কথা আগে আমরা শুনতাম; কিছু ভ্যাগাবন্ডকে রাস্তার পাশে জোর করে দখল করা জমিতে পার্টি অফিস তৈরি করে চেয়ারে বসে ঠ্যাং দুলাতে দেখতাম। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আয়নায় তা প্রথম স্পষ্টভাবে চোখে পড়লো। দুটি রাজনৈতিক দলের নানারকম গ্যাং চ-বর্গীয় গালাগাল দিয়ে; হুমকি-ধমকি দিয়ে ফেসবুকের উপর প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করলো কয়েকবছর। এই গ্যাংগুলোর সদস্যরা রাজনৈতিক বড় ভাই ও বুবুদের সঙ্গে সেলফি তুলে; নানাদিবসে কেক-পেস্ট্রি খাওয়ার ছবি দিয়ে; কাল্পনিক ক্ষমতার শোডাউন করে শিশু-কিশোরদের সামনে মেক্সিকোর অনুরূপ গ্যাং-কালচারটি তুলে ধরলো। কেবলমাত্র গালি দেবার গুণে সেলিব্রেটি হয়ে উঠলো কিছু গ্যাং সদস্য। শিশু-কিশোরেরা শিখে নিলো, গ্যাং বানাতে হয়; দলবেঁধে সেলফি তুলতে হয়; এ থেকে সেলিব্রেটিও হওয়া যায়। ফলে উত্তরার এক তালাচাবি মেরামত শিল্পীর ছেলে তালাচাবি রাজু হয়ে উঠলো কিশোরদের গ্যাং-স্টার।

উত্তরার কিশোরদের গ্যাং গড়ে তোলার পেছনে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী তাদের অভিভাবকেরা। এতো অল্পবয়সী শিশু-কিশোরদের বাইক কিনে দেয়া; কিংবা গাড়ি কিনে দেয়া আত্মঘাতী হয়েছে। তালাচাবি মেরামত শিল্পী থেকে রাজনৈতিক দলের তৈলব্রতশিল্পী হয়ে কিংবা অন্যান্য অশুভ পথে দুটো কাঁচা পয়সা হাতে এলেই তা দিয়ে নিজের শিশু-কিশোরকে বিগড়ে দেয়া অনুচিত। ঢাকায় সামাজিক গতিশীলতা খুবই অস্বাভাবিক। মানুষের জীবনে পর্যায়ক্রমে সচ্ছলতা ও সুখ অর্জনের যে স্বাভাবিক চেষ্টা থাকে; ঢাকায় তা ফিল্মের প্রথম দৃশ্যে বাই-সাইকেলে তালাচাবি সেরে বেড়ানো, দ্বিতীয় দৃশ্যে বাইকে তালাচাবি বিক্রি, তৃতীয় দৃশ্যে গাড়িতে চড়ে নিজের বিশাল তালাচাবি ফ্যাক্টরিতে প্রবেশের মত অস্বাভাবিক দ্রুতগতির অপচেষ্টা। ফলে শিক্ষা-অর্থ-সংস্কৃতির সুষম মনন গড়ে পর্যায়ক্রমে সম্পূর্ণ মানুষ-পরিবার-সমাজ গড়ে উঠতে পারছে না।

দুর্নীতি শিল্প-বিপ্লবোত্তর সমাজে দ্রুত বড়লোক হওয়া, দ্রুত স্ট্যাটাস অর্জন, দ্রুত জাতে ওঠার আত্মঘাতী চেষ্টায় সচ্ছলতার পরিবর্তে প্রাচুর্য অর্জন করছে সমাজের অনেক লোক। এই উপচে পড়া সম্পদের বলি হচ্ছে তাদের সন্তানেরাই। সম্পদ বিষয়টিকে মানসিকভাবে হজম করার জন্য সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। শিক্ষা-সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি ছাড়া সম্পদ অর্জন করলে; সমাজকে দেখতে ময়ূরপুচ্ছ পরা কাকের মতো লাগে।

শিশু-কিশোরদের প্রতি তাদের অভিভাবক ও সমাজকে অত্যন্ত মনোযোগী হতে হবে। তাদের শিক্ষাকে আনন্দময় করার চেষ্টা করতে হবে শিক্ষক সমাজকে। অভিভাবক, এলাকার প্রবীণ মানুষ সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে শিশু-কিশোরদের পরিচর্যায়। সময় পেলেই রাজনৈতিক বিষয়ে চর্বিত-চর্বণে সময় নষ্ট না করে; শিশু-কিশোরদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাদেরকে পড়ালেখার পাশাপাশি ব্যস্ত রাখতে হবে নানা সৃজনশীল জগতে। শিশুদের সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ না পেলে তাদের মস্তিষ্ক সমাজের খল-নায়কদের অনুকরণ করবে। প্রত্যেকটি মানুষই সৃজনশীলতার সম্ভাবনা নিয়ে জন্মে। যাদের সৃজনশীলতা বিকাশের পথ খুঁজে পায়, তাদের মাঝে তৈরি হয় ইতিবাচকতা। নেতিবাচকতা ভর করে সৃজনশীলতা বিকাশের পথ খুঁজে না পেলে।

সমাজের প্রতিটি শিশু-কিশোরের সৃজনশীলতা বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করা না গেলে; অসংখ্য নেতিবাচক খবর প্রতিদিন ভেসে আসবে। শিশু-কিশোরদের সমাজের অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে নিয়ে আসতে হবে আসন্ন ভয়াবহ বিপর্যয় এড়াতে।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ