আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

গল্প লিখব, রূপকথার!

এনামুল হক এনাম  

আমি আমার সন্তানের জন্য একটি রূপকথার গল্প লিখবো ভাবছি। যে রূপকথার গল্প শুনে ছেলে চোখ বড় বড় করে বার বার বলবে “সত্যি!!!” “এটা কিভাবে সম্ভব!”

গল্পের নায়ক ছোটবেলায় প্রতিদিন সকালে হৈ-চৈ করে বন্ধুবান্ধবের সাথে স্কুলে যেত। স্কুলে যাওয়ার জন্য কখনোই কোন অভিভাবক তাকে এগিয়ে দেয়নি। একই স্কুলে পড়া পাড়াপ্রতিবেশি সহপাঠীরা প্রতিদিন সকালে বাসার সামনে এসে চিৎকার করে তাকে ডাক দিত, সে তখন আনন্দের সাথে তাদের দলে যোগ দিত। এভাবে রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে তারা দলে ভারি হতে থাকতো। স্কুলে যখন প্রবেশ করতো তখন তারা একটি বিশাল বাহিনী। রূপকথার নায়কের স্কুলে সব পেশার লোকজনের সন্তান পড়তো। রিকশাওয়ালার সন্তান থেকে বাড়ির কাজের বুয়ার সন্তান, মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী থেকে চাকুরীজীবীর সন্তান... সবাই ছিলো তার সহপাঠী।

সেই রূপকথার নায়ক স্কুলে যেত যতটা না লেখাপড়ার জন্য তার চেয়ে ঢের বেশি আনন্দ করার জন্য। প্রতিদিন স্কুলে টিফিন টাইমে দৌড়-ঝাপ, ফুটবল, লুকোচুরি, হাডুডু... টিফিন টাইমের শেষে যখন আবার সে ক্লাসে প্রবেশ করতো তখন সারা শরীর ঘামে ভেজা। সে হাইস্কুল পর্যন্ত কখনোই বুঝতে পারেনি স্কুল মূলত লেখাপড়ার স্থান। পরীক্ষার রুটিন দেয়া হলে তারা ভয় পাওয়ার বদলে আনন্দে মেতে উঠতো, কারণ পরীক্ষা শেষ হলেই ছুটি!

স্কুলে থেকে ফিরেই কিছু মুখে দিয়েই সে দৌড় দিত খেলার মাঠে, সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত কাদামাটিতে ফুটবল। মাগরিবের আজান দেয়ার ঠিক পূর্ব মূহুর্তে পুকুরে ঝাঁপ। পুকুরে সাতার কেটে সন্ধ্যার সাথে সাথে ভেজা কাপড়ে গৃহে প্রবেশ।

শীতের পুরোটা সময় নায়কের অন্যতম বিনোদন ছিলো ঘুড়ি। লাল, নীল, বেগুনি... রংবেরঙের কত ঘুড়ি! সারা বছর জমানো ভাল্বগুলো গুড়ো করে সাবু দিয়ে সুতোয় মাঞ্জা দেয়া... সেই মাঞ্জায় আবার কত ধরণের রঙ ব্যবহার করা হত। ছুরির মত ধার করা সেই সুতো দিয়ে উড়নো হত ঘুড়ি, ঘুড়িতে ঘুড়িতে কাটাকাটি। কেটে যাওয়া ঘুড়ির পেছনে দৌড়ে যাওয়া একপাল ছেলের মধ্যে আমার গল্পের নায়কও থাকতো নিয়মিত।

রমজান মাসে লম্বা ছুটি হত, পুরো একমাস। গল্পের নায়কের দুপুরে বাড়ি ফেরার তাড়া ছিলো না, তাই সকালেই খেলায় বেরিয়ে যেত... ফিরতো বিকেল গড়িয়ে। এরমধ্যে দুপুরে চলতো পুকুরে সাঁতার প্রতিযোগিতা। সাঁতার কেটে এপার থেকে ওপারে যাওয়া, ডুব সাঁতারে কে কতক্ষণ পানির নিচে থাকতে পারে... মজার সব পানির খেলা। সেই পুকুরে একটি পুরোনো স্পিডবোট ছিল, নায়ক আর নায়কের বন্ধুরা মিলে প্রতিদিনই সেই স্পিডবোট পানির নিচ থেকে সেঁচে ভাসিয়ে তুলতো, আবার যাবার সময় পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে যেত। সেই স্পিডবোটে চড়ে তারা সারা পুকুর ভেসে বেড়াতো।

ছেলেবেলা নায়কের আরেকটি মজার খেলা ছিলো মার্বেল। বন্ধুদের সাথে মার্বেল খেলে কত বিকেল সন্ধ্যায় করেছে সে। মার্বেল খেলায় নিশানা করার নায়কের একটি বড় দাগা ছিলো, একটু বড় আকারের মার্বেল। আরেকটি খেলা ছিলো যার শুদ্ধ নামই মনে করতে পারছি না, স্থানীয় ভাষায় তাকে ‘গাইয়া গুটি’ বলতো। দুটি কাঠি নেয়া হত, একটি বড় আরেকটি অপেক্ষাকৃত ছোট। একটি দিয়ে আরেকটি বাড়ি মেরে কত দূর নেয়া যায় সেটা মাপ হত।

লেখাপড়ার ব্যাপারে নায়কের সময় ছিলো সন্ধ্যার পর থেকে রাত নয়টা অবধি, মাত্র তিন ঘণ্টা। কখনো কখনো সকালে। বাদবাকি সময় পুরোটাই আনন্দের, হৈ হুল্লোড়ের। পাশ, ফেল... একনম্বর হওয়া, দুই নম্বর হওয়া... এইসবের কোন বালাই ছিলো না নায়কের ছোটবেলায়। অভিভাবকদের কেউও এসব নিয়ে মাথা ঘামাতো না। আনন্দের মধ্যে লেখাপড়া করেই একসময় সব শেখা হয়ে যেত।

রূপকথার নায়কের ছেলেবেলা যখন ফলমূলের মৌসুম আসতো তখন তারা দলবেঁধে গাছে গাছে চড়ে বেড়াতো। গাছে চড়ে কাঁচা-পাকা আম খাওয়ার মজাই আলাদা। জাম গাছে উঠলে যতক্ষণ পর্যন্ত জিহ্বার স্বাদ ভোতা হয়ে গেছে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা জাম খেয়েই যেত। কূল গাছে তারা উঠতো লবণ মরিচ নিয়ে, গাছ থেকে কূল পেড়ে গাছে বসেই লবণ মরিচ লাগিয়ে চলতো খাওয়া পর্ব।

রূপকথার নায়ক কৈশোরে খেলাধুলার ফাঁকে আড্ডাও মারতো। তবে তা কোন গাছে চড়ে বা দেয়ালে বসে বন্ধুদের সাথে। গল্পগুজবে কত দিন তারা গাছে বসেই পার করে দিয়েছে!

নায়কের শৈশবে তারা কার্টুনও দেখতো, বিকেলে ঘড়ি ধরে পাঁচ থেকে সাত মিনিট। সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন টিভিতে নাটক হত, নায়ক পরিবারের সবার সাথে মিলে সেই নাটক উপভোগ করতো।

বলতে ভুলে গেছি, নায়কের একটি গুলতিও ছিলো। সেই গুলতি নিয়ে নায়ক পাখি শিকারে বের হত। কখনো সে পাখি মারতে পারেনি, কিন্তু উৎসাহে কখনোই ভাটা পড়েনি। নায়ক যখন নানা বাড়িতে যেত তখন ছোট মামার সাথে কুস্তি লড়তো, শক্তি পরীক্ষা করে দেখা হত... শহুরে ভাতের শক্তি বেশি নাকি গ্রামের ভাতের। ছোট মামাকে নিয়ে নায়ক বড়শি বাইতো, পুঁটিমাছের বড়শি। ভাত লাগিয়ে ফেললেই দুই মিনিটেই একটি পুঁটিমাছ বড়শিতে আটকাতো। খলুই ভর্তি করে কতদিন পুঁটিমাছ মিয়ে ফিরতো নায়ক, সেই পুঁটিমাছ ভাজা হত, ভাজা মাছের সাথে গরম ভাত আর গাওয়া ঘি, নায়কের কাছে ছিলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আহার।

বিয়ারিং-এর চাকা দিয়ে তিন চাকার গাড়ি বানানো হত। বিশাল কারিগরি ব্যাপার-স্যাপার। তবে তিনটা বিয়ারিং একত্রে যোগাড় করাই ছিলো দুঃসাধ্য। যার কাছে তিনটি বিয়ারিং ছিল সেতো রীতিমত রাজা। সাইকেল বা রিকশার পুরাতন রিং দিয়ে বানানো গাড়ি চালিয়ে নায়ক কতদিন পাড়ি দিয়েছে স্বপ্নের দেশে।

নায়কের পাড়াপ্রতিবেশি বন্ধু-বান্ধবীরা মিলে চড়ুইভাতি করতো। বিশাল খানাপিনার আয়োজন। না, না, কোন টাকা পয়সা লাগতো না... এরবাড়ি থেকে চাল, ওর বাড়ি থেকে মুরগি, আরেকজনের পুকুর থেকে মাছ, কারও কাছ থেকে চাল, ডিম। আর যার কিছুই দেয়ার নেই সে কাঠ কুড়িয়ে আনতো রান্নার জন্য। সারাদিন হৈচৈ করে রান্নার যোগাড়যন্ত, চিৎকার চেঁচামেচিতে রান্নাবান্না শেষ করে খেতে বসা। কখনো লবণ কম, কখনও বেশি... কেউ কখনোই কোন অভিযোগ করেনি। নায়ক আর বন্ধুরা স্বাদ নিয়ে পেটপুরে খেয়েছে।

নায়ক আর তার বন্ধুদের মধ্যে কেউ কখনো জানতো না… এ ছেলে... ও মেয়ে, এ হিন্দু… ও মুসলিম, এ সাদা ও কালো, ও ধনী... এ গরিব। সবাই জানতো তারা বন্ধু... আনন্দের রাজ্যের প্রতিবেশি।

আমার ছেলে গাড়িতে চড়ে ইংলিশ স্কুলে যাবে, ভাব ধরে বন্ধুদের সাথে চলবে। ট্যাব ছাড়া তার এক মূহুর্তও চলবে না, তার খেলার মাঠ... তার বন্ধুবান্ধব, তার হৈচৈ, তার পুকুরে মাছ ধরা, তার আনন্দ, তার উৎসব সবই হবে ভার্চুয়াল। আমার গল্পে ছেলে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বিস্ময় প্রকাশ করবে নিশ্চয়ই। জানতে চাইবে রূপকথার নায়কের নাম কি। আমি বলবো, দিয়ে দাও নাম একটা ইচ্ছেমত তোমার, এটা-তো রূপকথা, সত্যি কোন কাহিনী নয়।

আমাদের আবেগের গল্প... আমাদের রূপকথা, তোমাদের জন্য। ভাল থেকো তোমরা, আমাদের আগামী..., তোমাদের জন্য আমরা রেখে যাচ্ছি কঠিন প্রতিযোগিতার, বসবাস অযোগ্য... অসমতল, অসম এক পৃথিবী।

এনামুল হক এনাম, কলামিস্ট, সাহিত্যিক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ