আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে

লীনা পারভীন  

বাংলাদেশের অতীত রাজনৈতিক ইতিহাস আজ কেবল ইতিহাসেই আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। সামনে এগুনোর প্রেরণা যেন আর পাচ্ছিনা আমরা। আবার তৈরি হচ্ছেনা নতুন ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থা, নারী-পুরুষের সমান অধিকার- এ সবকিছুই যেন আজ গল্পের বিষয়। ঠিক যেমনটা আমরা ছোটবেলায় বইয়ে পড়তাম- আমাদের দেশে একসময় ছিলো গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ।

চারদিকে চলছে অস্থিরতার হাওয়া। ক্রমেই আমরা অসহিষ্ণু থেকে অসহিষ্ণুতর হয়ে উঠছি। যুক্তি-তর্কের বদলে চলছে আক্রমন প্রতি-আক্রমনের খেলা। ইস্যুর পর ইস্যু আসছে আর আমরা বিভক্ত হচ্ছি, আরো ছোট হচ্ছে আমাদের কথা বলার মানুষদের লাইন। জানিনা এমন দিন আসবে, যখন হয়তো আমরা কেবল নিজের সাথেই নিজে কথা বলতে পছন্দ করবো।

সেইদিন একজনের অনুভুতি পড়লাম। তিনি লিখেছেন, তার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হচ্ছে কারো সাথে তর্কে না জড়ানো। এই অনুভুতি থেকে হয়তো তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিবেন। আর কখনো নিজের মতামত দেয়ার উৎসাহ বোধ করবেন না।
কী ভয়ংকর! সমাজ আছে, কিন্তু সামাজিকতা নেই। ভাবা যায়? মানুষ আছে, কিন্তু সৌজন্যবোধ নাই। মত আছে, কিন্তু প্রকাশ নেই।

যে বিষয়ে কথা বলা দরকার সে বিষয়ে কথা বলছি খুব অল্প, কিন্তু যে বিষয়ে কথা না বললেও চলে সে বিষয়ে আমরা বাক্য ব্যয় করেই চলেছি। নিজেদের মধ্যে ব্যবধান কেবল বেড়েই চলেছে।

১। সমাজে দিনে দিনে বেড়ে চলেছে হানাহানি, মানুষের প্রতি মানুষের অসম্মান। নারীর মর্যাদা আজ সংকটের মুখে। যদিও আপাতঃ অর্থে আমরা নারীর অগ্রগতি হয়েছে বলেই জানি। কিন্তু আজো নারীরাই সবচেয়ে সহজলভ্য। যখন ইচ্ছা তখন তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া যায় যে কোন সিদ্ধান্ত, যখন মনে চাইলো কেউ অপমান করে পার পেয়ে যাচ্ছে। নেই কোন সংগঠিত প্রতিবাদ। এ যেন নারীর হবারই কথা ছিলো।

২। আমাদের সামনে গড়ে উঠছে না কোন অনুসরণীয় চরিত্র। সৃষ্টি হচ্ছেনা কোন নতুন কবিতা, গল্প বা গান যা শুনে শরীর শিউরে উঠবে, রক্ত টগবগ করে উঠবে। নিজেকে তার মত দেখতে চাইবে পরবর্তী প্রজন্ম। সে নিয়ে আমরা কজনই বা ভাবছি বলেন?

৩। শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রতিটা সেক্টরে আজ অবক্ষয়ের প্রতিযোগীতা। পাঠ্যবই পরিবর্তন হয়ে যায় আমরা কেউ সচেতন নই সে ব্যপারে। আশার বাণী শুনানো হয়, পরবর্তীতে ঠিক হয়ে যাবে। এ যেন মায়ের ছেলে ভুলানো গল্পের মতো। নেই কোন ধারাবাহিক প্রতিবাদ বা কর্মসূচি। আমরা কিছুদিন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করলাম, পত্রিকার পাতায়, ফেইসবুকে চিৎকার করলাম। সরকার সান্ত্বনার বাণী শুনালো আর আমরাও ঘুমিয়ে পড়ছি। এ যেন মান্নাদের গানের সেই লাইনের মতো ‘যে ক্ষতি আমি নিয়েছিলাম মেনে’।

৪। গাইবান্ধায় মেয়েদের একটি স্কুল পুড়িয়ে দেয়া হলো, যেখানে অন্তত ৫০০ ছাত্রী পড়ালেখা করতো। এলাকাবাসীর বর্ণনা অনুযায়ী, সে স্কুলটির রয়েছে দারুন প্রভাব। এখানে থেকে পড়াশুনা করে মেয়েরা অনেকেই আজ সচেতন। এর প্রভাবে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহের মতো সামাজিক ব্যধিগুলো সেই এলাকায় অনেক কম। তাহলে কী বলা যায়- এই সচেতনতা তৈরি করাই সেই স্কুলটির অপরাধ? শিক্ষা ব্যবস্থায় যে মৌলবাদীকরণ চলছে, তার থেকে এই ঘটনাটিকে আলাদা ভাবার কোন অবকাশ আছে? এ নিয়ে খুব বেশি উচ্চবাচ্য দেখলাম না আমরা। অনেকটা নিরবেই হজম হয়ে যাবে ঘটনাটি। শুনেছি মেয়েরা আর শিক্ষকরা স্কুলটিকে আবার দাঁড় করানোর শপথ নিয়েছেন। সাধুবাদ জানাই সেসব লড়াকুদের।

৫। সমাজে আজ চলছে ‘মুল্যবোধের’ মেরুদন্ড ভেঙ্গে ফেলার চক্রান্ত। আমরা কী সেটা বুঝতে পারছি? হয়তো পারছি, হয়তো পারছি না। আবার কেউবা বুঝতে পেরেও চুপ করে থাকার পণ করেছে। কী দরকার অত ঝামেলায় জড়িয়ে?

৬। আমার পরিচিত কিছু কিছু মানুষ আছেন, যারা এক সময় জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় পার করেছিলেন দেশ ও সমাজের কথা চিন্তা করে। তারা আজ নিজেকে বড় অপাংক্তেয় মনে করছেন। ভাবছেন- 'এই দেশের আর কিছু হবে না। অনেক বলেছি কিছুই হয়নি, মাঝখানে নিজের জীবন নষ্ট।' নষ্ট ভাবার কারণ তারা নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবেননি। নিজেকে দেখেছেন একজন সমাজ পরিবর্তনের সৈনিক হিসাবে। কিন্তু একটা সময় গিয়ে অনুভব করলেন তাঁর চাওয়া অনুযায়ী আর কিছুই হচ্ছে না। তখন আর ফিরে তাকানোর সময় ছিলো না। নিজেকে গুছানোর মত বাস্তবতা ছিলো না। সামনে যে কাজ পেয়েছেন, বেছে নিয়েছেন সেই কাজ। জীবনতো বাঁচাতে হবে আগে। কিন্তু আজ জীবনযুদ্ধের কাছে ক্রমশঃ হয়ে পড়ছেন আহত পাখি। কেবল ছটফটানি আছে, কিন্তু উড়বার ক্ষমতা নেই।

৭। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রীর ভ্যানে চড়া নিয়ে আমরা ঠাট্টা মশকরায় ব্যস্ত আছি। বুঝতে পারছি আমাদের আন্দোলনের ইস্যুর ঘাটতি পড়েছে। না হয় এত হালকা একটা বিষয়ে এত টাইম কেন অপচয় করবো আমরা? প্রধানমন্ত্রী ভ্যানে চড়ে বেড়িয়েছেন- এটা অবশ্যই একটা খবর সাধারণ মানুষের কাছে। কারণ একজন রাষ্ট্রপ্রধানের জীবন সারাক্ষণ নিরাপত্তায় ঘেরা থাকে। ইচ্ছা থাকলেও তারা সাধারণ মানুষের কাতারে নেমে আসতে পারেন না। এই সুন্দর একটি মুহুর্তকে আমরা উপভোগ করতে না পারি, সমালোচনায় কেন মিছিল নিয়ে নামতে হবে বুঝতে পারিনা। ভ্যান চালকের চাকরি হয়েছে, এটাও আমাদের কাছে হাস্যকর ঠেকছে। একজন হতদরিদ্র ভ্যানচালক, যে নিজের মনের কথা প্রকাশ করেছে যে সে একটি চাকরি চায়। এ চাওয়া যদি বাস্তবে ফলে যায়, এতে আমাদের এত জ্বালা কেন করবে? দেশের বেকার সমস্যা একটি জাতীয় সমস্যা। এর সমাধানের সাথে একজন ব্যক্তির কাজ হবার ইস্যুকে মিলিয়ে ফেলা আমাদের রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাব বলেই মনে করি।

বর্তমান অবস্থা থেকে মনে হচ্ছে আমরা ইস্যুতে ইস্যুতে দিশেহারা হয়ে বুঝতেই পারছিনা কোন ইস্যুতে প্রতিবাদ করবো আর কোন ইস্যুকে সাইডে রেখে দিতে হবে। ছাত্ররা লড়ে যাচ্ছে বিচ্ছিন্নভাবে। তারুণ্যের ধর্মই হচ্ছে প্রতিবাদ করা। তবে প্রতিবাদের জন্যও যে শিক্ষাটা দরকার, তার ভিত্তি রচনা করে জাতীয় রাজনীতি। আমাদের দেশে আজকে রাজনৈতিক দলই হারিয়ে যাচ্ছে। তাই সবাই রোমান্টিক প্রতিবাদী হয়ে উঠছি। যে কোন ইস্যু পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছি। কিন্তু কী তার আদর্শ, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য- কিছুই স্থির করছি না। লং টার্ম অবজেকটিভ না থাকলে শর্ট টার্ম কিছু অর্জন করা যায় না। তা সাস্টেইনেবল হয়না। কিন্তু আমরা যেন প্রতিদিন ছুটছি সেই শর্ট টার্ম লক্ষ্যের পিছনেই।

লীনা পারভীন, কলাম লেখক ও সাবেক ছাত্রনেতা

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ