আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

তমসাচ্ছন্ন ফেব্রুয়ারি এলো নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে

রণেশ মৈত্র  

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি এসেই গেল। কিন্তু এবারের এই ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও আদর্শে বিশ্বাসীদের কাছে কেমন যেন ঝাপসা, কালো ধোঁয়া ঢাকা, তমসাচ্ছন্ন এক ফেব্রুয়ারি হিসেবেই দেখা দিল যেন। বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার, শাফিউর অকাতরে নিজেরদের প্রাণ বিলিয়ে দিলেন ঢাকার কালো পীচঢালা রাজপথ লালরক্তে রঞ্জিত হলো। গৌরবের ঐ ইতিহাসও যেন এক অসহায় অন্ধকারের আবরণে ঢাকা পড়ে যেতে বসেছে। কিন্তু ফেব্রুয়ারি তো তারুণ্যের এক মহাজাগরণের মহাকাব্য। বাঙালি জাতির গৌরবদীপ্ত পদচারণায় সেদিন তো গোটা দেশের রাজপথ হয়েছিল প্রকাশিত। কেঁপে উঠেছিল করাচী, লাহোর, পিত্তির রাষ্ট্রীয় সিংহাসন আরোহী দ্বিজাতিতত্ত্বের সাম্প্রদায়িক নেতাদের উপেক্ষা করে এলো এর মহাজাগরণের মহোৎসব- যে মহোৎসব একাত্তরের নিশানায় হাঁটতে বাঙালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল দিক নির্দেশনাও দিয়েছিল।

এবারে যে ফেব্রুয়ারি এল সে কি তেমনই একটা ফেব্রুয়ারি? যে ফেব্রুয়ারিতে বাঙালি জাতি জীবন-মরণ পণ করে খালি হাতে হাজারে হাজারে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যে, বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশের পথকে রুদ্ধ করে দেওয়ার তাবৎ পাকিস্তানী ষড়যন্ত্রকে রুখে দেওয়ার জন্য, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-বিদ্যাসাগর-জীবনানন্দ, সুকান্তকে ভুলিয়ে দেওয়ার সকল অপচেষ্টাকে বানচাল করে দিয়ে তাঁদেরকে হৃদয়ে আরও শক্তি-আরও মজবুত করে ধারণ করার জন্যে (সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বকে চিরতরে প্রত্যাখ্যান ও সমাধিস্থ করার লক্ষ্যে ও সকল মানুষের মৌলিক নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ও সকল প্রকার শোষণ নির্যাতন বন্ধ করার লক্ষ্যে, সাম্প্রদায়িকতার কবর রচনা করে ধর্মনিরপেক্ষতার লক্ষকে ধ্রুবতারার মত শিক্ষার সকল পর্যায়ে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে?

সেদিনের সেই ফেব্রুয়ারিতে ঘোর সাম্প্রদায়িক ও বর্বর শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতায় থেকে শুধুমাত্র দেশটা সাম্প্রদায়িকতার উগ্র এক আবহই সৃষ্টির চেষ্টায় মেতে উঠেছিল তাই নয়-বরং তারা ইসলামের নামে কোটি কোটি মুসলমানকে চরম এক বিভ্রান্তির বেড়াজালের আবরণে আটকে রেখে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে দেশটাকে একটি অসভ্য; বর্বর, ধর্মান্ধ, চির-অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ একটি দেশে পরিণত করে বাঙালি জাতিকে তার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সুসমৃদ্ধ পথ থেকে বিচ্যুত করে এক কুপমুণ্ডুক জাতিতে পরিণত করার ষড়যন্ত্র জালের বিস্তার ঘটিয়েছিল।

কিন্তু বাহান্নর ইতিহাস রচনাকারী ফেব্রুয়ারিতে বাঙালি জাতি লৌহদৃঢ় একতা গড়ে তুলে ঐ ষড়যন্ত্র জাল ছিন্ন করে সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষদাঁতকে ভাঙার লক্ষ্যে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করে দেশটিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে বাড়ালি সংস্কৃতির লালন করার মাধ্যমে এক সুখী, সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক ও শোষণ মুক্ত এবং বাংলাদেশ গড়ার চেতনায় ঢাকার ও সমগ্র বাংলাদেশের রাজপথগুলি জনতার সংগ্রামী পদভরে কাঁপিয়ে তুলেছিল।

তরুণ-তরুণীরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে, হাজারে হাজারে কারাজীবন বরণ করে জানিয়ে দিয়েছিল সেদিনের শাসকগোষ্ঠীকে যে “বাঙালি জাতি মাথা নোয়াবার নয়”। শুধুই শিক্ষার্থী তরুণ-তরুণী নয়-স্কুল-কলেজের শিক্ষকরাও - সাংবাদিকরাও নির্বিবাদে কারাবাস বরণ করেছিলেন - অগণিত মিছিলে সামিল হয়েছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

সে আন্দোলন দমানো যায় নি, দমাতে পারে নি হাজারো নির্যাতনে লাঠি-গ্যাস-টিয়ারশেলে বা মুসলিম লীগের গুণ্ডাবাহিনীর লাঠ্যাঘাতেও। ভাষা আন্দোলনকারীদের যতই বলা হয়েছে “এরা মুসলমান নয়-হিন্দু”, “এরা পাকিস্তানের দুশমন,” “এরা ইসলাম বিরোধী” বা “এরা ভারতের দালাল,” “ধুতি পরে এরা ঢাকার রাস্তায় রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” বলে শ্লোগান দিয়েছে”-ততই বেশী বেশী করে মুসলিম সন্তান এ আন্দোলনে যোগদান করেছে-আন্দোলনকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে।

এমন কি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীরাও দলে দলে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে আন্দোলনকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছেন। সমগ্র হিন্দু সমাজের সমর্থন তো এ আন্দোলনের পেছনে-ছিলই তবে সক্রিয় আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করতে সাহসী হয়েছেন তাঁদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যকই। এভাবেই এটি একটি জাতীয় দাবীতে পরিণত হয়। সার্বজনীন রূপ পেতে সমর্থ হয়। জাতীয় নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এই পরিষদে বামপন্থী দলগুলির নেতৃবৃন্দও ছিলেন।

তেমনই আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হয়েছিল,“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ”। এই পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন আবদুল মতিন (যিনি পরবর্তীতে ভাষা-মতিন হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেন), অলি আহাদ, তোয়াহা, গাজীউল হক প্রমুখ বামপন্থী ছাত্রনেতাবৃন্দ যাঁদের নেতৃত্বেই একুশে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা অমান্য করার সিদ্ধান্ত নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সমগ্র ঢাকা শহরের ছাত্র সমাজ। ছাত্র-ছাত্রী নির্বিশেষে সে মিছিলে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল কয়েক হাজার। এতে সাধারণ কর্মচারী-দোকানদার-রিক্সা শ্রমিকের মত দরিদ্র পেশাজীবীরাও অংশগ্রহণ করেন।

মিছিলে গুলিবর্ষণের ফলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর সহ নাম- না জানা আরও অনেকে শহীদ হন, আহত হন শতাধিক, গ্রেফতার হন অনেকেই।

খবর দ্রুতই পৌঁছে যায় নিকটবর্তী প্রাদেশিক আইন সভার অধিবেশন। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের প্রবীণ নেতা মওলানা আব্দুর রশিদ অধিবেশনে ছিলেন। খবর পাওয়া মাত্র তিনি উঠে দাঁড়িয়ে স্পীকারকে লক্ষ্য করে বলেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে বের হওয়ার মিছিলে পুলিশ বেধড়ক গুলি চালিয়েছে, লাঠিচার্জ করেছে। ফলে আমাদের সন্তানেরা মৃত্যুবরণ করেছে, আহত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে কারও পক্ষে বসে অধিবেশন চালানো উচিত নয়। অধিবেশন স্থগিত করে চলুন, আহত নিহতদের দেখে আসি। প্রস্তাব নাকচ হয়। তর্কবাগীশ বেরিয়ে চলে আসেন ঘটনাস্থলে-সংহতি জানান আন্দোলনের সাথে। এভাবে সেদিন মুসলিম লীগের অভ্যন্তরেও বিভক্তি আসে। তর্কবাগীশ মুসলিম থেকে পদত্যাগ করেন প্রতিবাদ স্বরূপ।

আসলে সেদিনটি ও তখনকার ঘটনাবলী এমনই ছিল যাকে প্রকৃতই স্মৃতি-জাগানিয়া বলে মনে করা হয়। আবেগও ঘিরে ধরে মনকে। তবে উপরের কথাগুলি কিছুটা যদিও দীর্ঘ হলো তবুও বলে নিতে চাই, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখবার জন্য আমি নতুন করে কলম ধরি নি। বই-পুস্তকে সে ইতিহাস ও তার পর্যালোচনা বিস্তর হয়েছে। এই নিবন্ধের খতিরে দিনটি যে কত উজ্জ্বল ছিল তারই কিছুটা ছবি ফুটিয়ে তুলতেই খানিকটা প্রয়াস পাচ্ছি মাত্র।

বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বলে স্বীকার না করে পারে নি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। দিনটিকে অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারী ছুটির দিন বলে ঘোষণা করেন তৎকালীন প্রাদেশিক সরকার ১৯৬৫ সালে।

ভাষা আন্দোলনের সীমাহীন তাৎপর্য ও প্রতিক্রিয়া বাঙালির জাতীয় জীবনে পড়তে শুরু করে। গড়ে ওঠে শহীদ মিনার এবং দেশের সর্বত্র বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে শহীদ মিনার গড়ে তোলার হিড়িক পড়ে যায়। একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতিবছর ভোরে ঘুম থেকে উঠে ছেলে-মেয়েরা এক সাথে মিছিল করে (প্রভাত ফেরী) শহীদ মিনারে গিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা বাৎসরিক এবং স্বতঃ:স্ফূর্ত রেওয়াজে পরিণত হয়।

ধীরে ধীরে শহীদ মিনারের পাদদেশে আলোচনা সভা, সংগীত-নৃত্যানুষ্ঠান-প্রভৃতি চালু হয় এবং এগুলি আজও দীর্ঘ প্রায় ৭০ বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে।

ভাষা আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা ঘোষণা দিলেন, সকল সাইনবোর্ড নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে বাংলায় লিখতে হবে। তখন বেশীরভাগ সাইনবোর্ড লেখা হতো ইংরেজিতে, কিছু কিছু আরবিতে এবং সামান্য কিছু বাংলায়। কিন্তু ছাত্র নেতারা ঐ আহ্বান জানানোর পর ধীরে ধীরে সব দোকান-পাট-অফিস আদালত ব্যাংক-বীমা প্রভৃতির সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা হলো।

মেয়েরা একুশে ফেব্রুয়ারির ২/১ দিন আগে থেকেই শহীদ মিনারের চারিদিকে এবং রাজপথগুলিতে আলপনা আঁকতে শুরু করে।

বাঙালি সংস্কৃতি, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী যার অপমৃত্যু ঘটাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল, তা যেন বহুগুণ শক্তি অর্জন করে তীব্র গতিসম্পন্ন হয়ে এক রেনেসাঁর আবির্ভাব ঘটালো। বাঙালি সংস্কৃতি নতুন করে তার প্রাণ ফিরে পেলো। বিয়ে বাড়ীর সাজ সজ্জায় কলাগাছ পুঁতে মাটির হাঁড়িরে ওপর আম পাতার পল্লব, নানাবিধ আলপনা ও আলোকমালার সাজানো, গেটে শুভ বিবাহ এবং (বর ও বরযাত্রীদের উদ্দেশ্যে স্বাগতম) লেখা শুরু হলো শাদী মোবারক প্রভৃতির স্থলে। অর্থাৎ আরবি বা ইংরেজি নয়-বাংলার প্রচলন নতুন মাত্রা পেল যেন।

সাম্প্রদায়িকতা সকল ক্ষেত্র থেকেই অপসারিত হতে শুরু করে দ্রুতই। পূর্ব পাকিস্তান প্রথম অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন হিসেবে জন্ম নেয় বামপন্থী প্রগতিশীল চেতনার ধারক “পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ১৯৫২ সালেই। ১৯৫৩ সালে জন্ম নেয় পাকিস্তানোত্তর প্রথম অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল “পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল” নামে (বর্তমানের “গণতন্ত্রী পার্টি” নয় ধীরে ধীরে এই ঢেউ আঘাত করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগেও। এ দুটি সংগঠনই ক্রমে তাদের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি তুলে নেয়-অত:পর আর কোন সাম্প্রদায়িকতার চিহ্ন ধারণ করে রাজনৈতিক দলের জন্ম হয় নি। ১৯৪৮ এই গঠিত হয় অসাম্প্রদায়িক পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ।

ব্যাংক, ইনসিওরেন্স, রেলগাড়ি, বাস, লঞ্চ, ষ্টীমার এবং সংবাদপত্রগুলিও বাংলা নাম ধারণ করতে শুরু করে। ইত্তেফাক ও ইনকিলাব ছাড়া আর কোন বাংলা সংবাদপত্রের নাম বাংলা ভাষা ছাড়া আরবি-উর্দু বা অন্য কোন বিদেশী ভাষায় রাখা হয় নি- বা হচ্ছে না। চারিদিকে শুরু হয় বাংলা ভাষার জয়জয়কার স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী শঙ্কিত ও ভীত হয়ে পড়ে। ষাটের দশকে তারা নতুন ভাবে আঘাত হানতে উদ্যত হয় রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার মাধ্যমে। কিন্তু ঐ সিদ্ধান্ত কাগজেই থেকে যায়। বাস্তবে জনগণ বা বাঙালি জাতি এই আদেশকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে বহুগুণ উৎসাহ নিয়ে ১৯৬১ তে রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী মহাসমারোহে সারা কোথাও তিন দিন, কোথাও সাত দিন, কোথাও বা মাসব্যাপী নাচ, গান, আলোচনা সভা, আবৃত্তি নাটক, প্রভৃতির মাধ্যমে উদযাপন করেন। রবীন্দ্র চর্চা বেড়ে যায় বহুগুণ। কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত যেন একটি বুমেরাং হয়ে তাদেরকেই আঘাত করে আর জনগণকে নতুনভাবে রবীন্দ্র প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে।

কিন্তু দিন পেরোয়, বছর পেরোয় - ভাষা আন্দোলনের তাপ-দগ্ধ বাংলা বিপুল প্রেরণার অপ্রতিরোধ্য শক্তি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বান ১৯৭১ এ সমগ্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই শক্তি আরও শক্তিশালী হয় বিদেশের তথা ভারত, সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব এবং গোটা পৃথিবীর স্বাধীনতাকামী মানুষের অতুলনীয় নৈতিক ও বৈষয়িক সহযোগিতা ও সমর্থনে। পরিণতিতে নয় মাসের মধ্যেই অর্জিত হয় গৌরবোজ্জ্বল বিজয় - যা বাহান্নর ফেব্রুয়ারিতে সূচীত হয়েছিল। গৃহীত হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই নতুন দেশটির মৌলনীতি হিসেবে।

কিন্তু শত্রুরা ওত পেতেই ছিল। তারা অকস্মাৎ রাতের অন্ধকারে ৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে, এবং একই বছরের ও নভেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের অপর চার নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করে। ধীরে ধীরে মেঘ জমতে থাকে অর্জিত বিজয়গুলি একে একে ছিনতাই হতে থাকে। হতে থাকে ইতিহাস ও আদর্শের বিকৃতি।

তারই জের চলছে বিকৃতি এবং আদর্শ বদল হাত ধরাধরি করে বাংলার আকাশকে পুনরায় মেঘাচ্ছন্ন করে তুলেছে। তমসায় আবৃত করে চলেছে চতুর্দিক। পরিত্যক্ত হচ্ছে মহান আদর্শমালা।

চার মৌল নীতি অপসৃত। জিয়ার বিসমিল্লাহ সহ বে-আইনি পঞ্চম সংশোধনী এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সম্বলিত এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নবতর উৎসাহে ১০১২ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার পুন: সন্নিবেশিত করে কলঙ্কিত করেছে আমাদের আদর্শিক বিজয়কে।

অত:পর সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে “মদিনা সনদ” অনুসারে দেশ চলবে বলে সদম্ভ ঘোষণাও অবাক বিস্ময়ে শুনলো বাঙালি জাতি।

পর পর হত্যালীলা ঘটতে থাকলো “নাস্তিক” অভিযোগ এনে আইনকে নিজ হাতে তুলে নিয়ে পুরোহিত, ইমাম, শিক্ষাবিদ, প্রকাশক একের পর খুন হতে থাকলো। রাষ্ট্রের নিষ্পৃহতা খুনিদেরকে প্রশ্রয় দিল-তারা উৎসাহিত হলো।

সেই উৎসাহে ঘটতে থাকলো নাসিরনগর, গাইবান্ধা, যশোর, দিনাজপুর সহ সারা দেশে অজস্র সাম্প্রদায়িক একতরফা আক্রমণ হত্যা, লুট, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি মারাত্মক অপরাধ। বিচার নেই কোনটারই শাস্তিও নেই কারও। গড়ে উঠলো বিচারহীনতা নামক এক অপসংস্কৃতি।

শেষ পেরেকটি ঠুকে দেওয়া হলো শিশু কিশোরদের পাঠবইতে। হিন্দু ও প্রগতিশীল খ্যাতনামা লেখক, কবি-সাহিত্যিকদের কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ পাঠ্যসূচী থেকে তুলে দিয়ে বইগুলিরও ইসলামী বা পাকিস্তানীকরণ করার মাধ্যমে। তাই এ মেঘ মুক্তিযুদ্ধের আবরণে আসা তাই বিভ্রান্তিতে ভুগছেন অনেকে।

বিভ্রান্তি কাটিয়ে আদর্শ বাঁচাতে, নীতি বাঁচাতে, মুক্তিযুদ্ধ বাঁচাতে বাহান্নকে বাঁচাতে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পুনরায় দাঁড়ানোর বিকল্প নেই।

রণেশ মৈত্র, লেখক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক; মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ইমেইল : [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ