আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

‘বিগ লাই থিয়োরি’ ও প্রজন্মের বোধ

জুয়েল রাজ  

১৪ ফেব্রুয়ারি আমাদের কাছে শুধুই ভালোবাসার দিন, ২১ ফেব্রুয়ারি হয়ে যাচ্ছে আমাদের উৎসবের দিন। ১৫ আগস্ট আর শোকের দিন নয় হাসি খুশি মোবাইল সেলফির দিন হিসাবেই উদযাপন শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে আমারা ও মানিয়ে নিচ্ছি। পাঠ্যবই বিকৃতি ইতোমধ্যে আমরা মেনে নিয়েছি, কথা উঠেছে, হাইকোর্টের সামনে স্থাপিত হওয়া ভাস্কর্যটিও সরিয়ে ফেলার, অনেকেই আবার এর পক্ষে সমর্থন ও দিয়েছেন দেখলাম। খুব শীঘ্রই হয়তো সেটা সরিয়ে ফেলা হবে। ভোটের রাজনীতিতে আপোষ করতে হয় অনেক কিছুই। এই মেনে নেয়া বা মানিয়ে নেয়ার চর্চা নতুন নয় ।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ, সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা দখল করেন স্বৈরাচার এরশাদ সরকার। সামরিক আইন জারি করে মৌলিক অধিকারের ভূলুণ্ঠন এবং বিরোধী দলীয় কর্মী ধরপাকড়, নির্যাতনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এরশাদ আমল। প্রথম থেকেই তিনি ইসলাম ধর্মকে অত্যাচারের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। এরশাদের শাসনামলে ২১ ফেব্রুয়ারির বিভিন্ন অনুষ্ঠান ইসলাম পরিপন্থী বলে ঘোষণা করা হয় এবং আলপনা অংকনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন তিনি! ১৯৮২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান একটি নতুন শিক্ষানীতির প্রস্তাব পেশ করেন। প্রথম শ্রেণী থেকেই আরবি ও দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব ও শিক্ষার ব্যয়ভার যারা ৫০% বহন করতে পারবে তাদের রেজাল্ট খারাপ হলেও উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়ার কথা বলা হয়- এই শিক্ষানীতিতে।

৬ ফেব্রুয়ারি ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার মূল্যবোধ বিরোধী আপত্তিকর বক্তব্য দেওয়া হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এর বিরোধিতা করলে সংঘর্ষ হয়, আহত হয় অর্ধশত ছাত্র। এই ঘটনার খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও শিবিরের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

গণবিরোধী এই শিক্ষানীতির প্রতিবাদে, তিলে তিলে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন ফুঁসে ওঠে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। মধুর ক্যান্টিনে সকল ছাত্র সংগঠনের সম্মিলিত রূপ, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ -এর উত্থান ঘটে। একই ধারার অবৈতনিক বৈষম্যহীন সেক্যুলার শিক্ষানীতির দাবিতে ‘৮৩ এর ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশাল মিছিলে শামিল হয় শত শত ছাত্র। সারাদেশে প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ, সামরিক আইনের সমালোচনা মানেই সাত বছরের কারাদণ্ড, তখন এরশাদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে ছাত্ররা। পুলিশের গুলিতে নিহত হয় জাফর , জয়নাল দিপালী সাহা নামের নিষ্পাপ শিশু। যার লাশটি পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

সেই দিনটি আমরা আর মনে করিনা, আমাদের কে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। এবং খুব সূক্ষ্মভাবে সেটা করা হয়েছে। গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা ব্যবস্থার দাবীতে যারা রক্ত দিয়ে গেল, ইতিহাসের পাতা নয় শুধু নতুন প্রজন্মের চেতনা থেকে মুছে দেয়া হয়েছে নাম নিশানা।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উদযাপন উৎসব হয়ে গেছে, ত্রিশ লাখ শহীদের বিনিময়ে কেউ কেউ ২১ শে ফেব্রুয়ারি অর্জন করেছেন, কেউ দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পেয়েছেন ভাষার অধিকার। সেই সব ব্যানার পোস্টার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। শহীদ দিবস, না শহিদ দিবস হবে ই-কার না ঈ-কার এই নিয়ে ব্যস্ত কেউ কেউ! ইসলামী ছাত্রলীগ, তরীকত লীগ, আওয়ামী পরিবার লীগ সহ অসংখ্য লীগের বন্যায় ভাসছে বাংলাদেশ।

যা আমরা অনেকেই হেসে উড়য়ে দিচ্ছি। যেমন হয়েছে ৭৫ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, বঙ্গবন্ধুর সন্তানদের দিয়ে। বহু মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করার চেষ্টা করা হয়েছে। যার জন্য এখনো বহু মিথ্যার সাথে প্রতিনিয়ত বিতর্ক করতে হচ্ছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যেমন করে ভাবেন নি রাজাকার আলবদর রা স্বাধীন দেশে আর মাথা তুলবে না, হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন সেই সম্ভাবনা। ঠিক এখন যখন ধর্মের নামে দেশর মৌলিক ভিত্তি থেকে একটি সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়া হচ্ছে, আমরা হেসে উড়িয়ে দিচ্ছি। বাংলাদেশে কখনো সেটা হবে না বলে।

একুশের সাজ, একুশের আপ্যায়ন নিয়ে আমাদের পত্রিকাগুলো বিশেষ সংখ্যা করছে, ভাবগাম্ভীর্য পূর্ণভাবে পালনের দিন শেষ। ভাষা শহীদদের স্মরণ নয়, নিজেদের পেশী শক্তি দেখাতে নেতাদের নজরে পড়তে, শহীদ মিনারে দলীয় নেতা নেত্রীদের নামে চলে শ্লোগান। সার্বিক বিষয়গুলো আসলে হেসে উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। ছাত্রলীগের মতো প্রগতিশীল সংগঠনের পোষ্টারেও একটি ধর্মের প্রতিফলন থাকে, তখন ভাবতে হয়।

সুরঞ্জিত সেনের প্রয়াণ পরবর্তী, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের শোক সভা শুরু হয় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে। ব্যক্তিগতভাবে যদিও নেতারা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, জাতীয় চার নেতার একজন এএইচ এম কামরুজ্জামানের স্ত্রীর মৃত্যু ও সিলেটে অঞ্চলের সাবেক ছাত্রনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা শোয়েব চৌধুরীর স্মরণে কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে আসলে সভা শুরু করা হয়েছিল। এই ঘটনা শোনে কথা সাহিত্যিক, সাংবাদিক গাফফার চৌধুরী আওয়ামী লীগের নেতাকে বলেছিলেন, তাহলে আর গায়েবানা জানাজাটা বাকি রাখলেন কেন?

গোয়েবলসের "বিগ লাই থিয়োরি " বা প্রোপাগান্ডা থিয়োরি আমরা সবাই জানি , যার সারমর্ম হচ্ছে একটা মিথ্যাকে যদি বার বার ব্যাপক ভাবে, সরকারি সকল প্রশাসন যন্ত্রকে বা এক কথায় মিডিয়া উইং দিয়ে প্রচার করা হয় তখন সেটি সত্যের মত শুনায় এবং মানুষ আর আসল সত্যটা খুঁজে পায় না। সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দেয়া অথবা সত্যের সাথে মিথ্যা কিংবা মিথ্যার সাথে সত্যকে মিশ্রিত করে ফেলে সত্যকে আর ‘সত্য’ না রাখা। সত্যকে বদলে ফেলা। বাংলাদেশে সেই চর্চাটাই হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে চেতনা থেকে, দেশপ্রেম থেকে প্রজন্মকে বিচ্ছিন্ন করার এক ধরণের বোধের মিথ্যাচার চলছে। সব কিছুকে বাণিজ্যিক করণ বা উৎসবে রূপ দিয়ে।

অন্যদিকে আরেকপক্ষ সব কিছুর বিচার বিশ্লেষণের মাঝখানে ধর্মকে নিয়ে আসেন । সেই ফাঁদে আমাদের নেতারা ধরে পড়ে গেছেন। এর থেকে আর বের হয়ে আসতে পারছেন না, বা বিশ্বাস না করলে ও ভোটের জন্য সেই বৃত্ত ছেড়ে নিজেরাই বের হয়ে আসতে চাইছেন না।

একুশ, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধু নিয়ে যারা বিভ্রান্তি ছড়ায় তাদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। প্রযুক্তির এই যুগে নতুন প্রজন্মের বোধের জায়গাটুকু তৈরি করে দিতে হবে। নতুবা এক সময় মিথ্যাকেই সত্য বলে বিশ্বাস করবে।

সর্বশেষ শেষ করতে চাই, আওয়ামী লীগের সদ্যপ্রয়াত নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত চমৎকার একটা কথা দিয়ে, ধর্মীয় উন্মাদনা ও জঙ্গিবাদ বিষয়ে চমৎকার একটা কথা বলেছিলেন তিনি বাংলাদেশের সমস্যা সাধারণ মানুষের না, এইটা একটা রাজনৈতিক সমস্যা । রাজনীতি দিয়েই এর মোকাবেলা করতে হবে।

আর সেই রাজনীতির জায়গাতেই ব্যর্থ হচ্ছেন আমাদের নেতা নেত্রীরা। রাজনৈতিক নেতৃত্বই শুধু পারেন দেশটাকে বদলে দিতে।
(তথ্যসূত্র: অনলাইন)

জুয়েল রাজ, সম্পাদক, ব্রিকলেন; যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি, দৈনিক কালেরকন্ঠ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ