আজ মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

এই কি সেই দেশ: আমার প্রিয় মাতৃভূমি?

রণেশ মৈত্র  

বাঙালি জাতি পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের নির্মম অত্যাচার, অকথ্য নির্যাতন সীমাহীন বৈষম্য ও সম্পদ লন্ঠনের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। তার প্রথম স্ফুরণ ঘটেছিল ১৯৪৮ সালের মার্চে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আমিও সে আন্দোলনের একজন অংশগ্রহণকারী যদিও তখন মাত্র অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম পাবনা গোপাল চন্দ্র ইন্সটিটিউশনের।

আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলন পূর্ববাংলার সর্বত্র সমভাবে পরিব্যাপ্ত হতে পারে নি কারণ পাকিস্তান সম্পর্কে মুসলিম মানস তখনও মোহমুক্ত হতে সক্ষম হন নি। তাই মূলত: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় বামপন্থী ছাত্র নেতার নেতৃত্বেই ঐ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে সঙ্গে সক্রিয়ভাবেই ছিলেন তৎকালীন বাঙালি জাতীয়তাবাদীরাও। শহীদ ধীরেন দত্ত ঐ ভাষা আন্দোলনের অস্ত্রসেনা। আর আন্দোলনটি পুরোপুরিভাবেই তারুণ্যের নবজাগরণ সূচিত করেছিল।

পাবনা, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, রংপুর , যশোর, চট্টগ্রাম সহ কতিপয় জেলা শহরে বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও সাধারণ মানুষের অংশ গ্রহণে ১৯৪৮ এর ভাষা আন্দোলন ২/৩ বছর যাবত অনেকটাই শীতল হয়ে পড়েছিল। তুষের আগুনের মত ধিকধিক জ্বলছিল কিন্তু নিভে যায় নি।

কিন্তু বাহান্ন সালের একুশ সব কিছুকে ছাপিয়ে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর মনে বিরাট কম্পন রেখা এঁকে দিয়েছিল তাদের সিংহাসন তখন থেকেই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। বাহান্নর ধাক্কা তারা শেষ দিন পর্যন্ত সামলে উঠতে পারে নি। আন্দোলনের কাছে বাঙালি জাতির কাছে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল । বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তারা যেমন পরাজয় বরণ করেছিল। তেমনই বাঙালি একটি জাতি হিসেবে সেদিন এক বিশাল তাৎপর্যপূর্ণ বিজয় অর্জনের গৌরব ও অর্জন করেছিল। যার সর্বশেষ পরিণতিতে স্বাধীন, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শোষণমুক্ত, আধুনিক সমাজ গঠনের প্রত্যয় সমৃদ্ধ গণ-চেতনার উন্মেষও ঘটিয়েছিল।

বাহান্নর ভাষা আন্দোলন পরবর্তী পূর্ব বাংলা বাঙালির মনে, তার সংস্কৃতি চেতনায় তার জীবনবোধে বহুমাত্রিক পরিবর্তন এনে দেয়। বাঙালি জাতির জাতীয়তাবোধ নতুন করে জাগ্রত হয়।

পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সৃষ্টি বিষাক্ত আদর্শ ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রত্যাখ্যাত হয় কে হিন্দু ,কে মুসলিম । এমন চিন্তা বর্জন করে পূর্ব বাংলার মানুষ বাঙালিত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐ বহুমাত্রিক পরিবর্তন আনার সংগ্রামে নতুন করে আত্মনিয়োগ করে নতুন নতুন ধারাবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে যেন তারা গণ-আন্দোলনের বিশাল এক মালা গাঁথতে উদ্ধুব্ধ হয়েছিল। ঐ মালার বুননও এমন শৈল্পিক ছিল যে প্রতিটি আন্দোলনে একের পর এক বিজয় সূচিত করে বিজয়ের মালাও গাঁথতে সমভাবে সাফল্য অর্জন করেছিল বাঙালি জাতি।

সাময়িকভাবে হলেও অন্ধ সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল পাকিস্তানের মুসলিম লীগ নেতৃত্বাধীন গণ-বিরোধী বিশেষ করে বাঙালি বিরোধী সরকার। মুসলমান, হিন্দু খৃষ্টান, বৌদ্ধ এ জাতীয় বিভেদাত্মক পরিচিতি বাঙালির মনে আসনও গেড়েছিল। কিন্তু আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলন ঐ আসনকে নড়বড়ে করে দেয় অবশেষে বাহান্নতে এসে, মাত্র চার বছরের মাথায় এক অবিশ্বাস্য রূপে বাঙালি ঐ অপচেতনার জোয়াল থেকে মুক্তি অর্জন করে।

শুরু হতে থাকে শহীদ মিনারে প্রতি বছর একুশের ভোরে প্রভাত ফেরী সহকারে পুষ্পার্ঘ্য (অর্পণ থেকে মূর্খ মৌলভীরা পূজা দেওয়া বলে মুসলিম সমাজকে বিভ্রান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টাও করেছিল) নারী পুরুষের যৌথ অংশ গ্রহণে নাটক, থিয়েটার প্রকৃতির মঞ্চায়ন, ঘরে ঘরে মেয়েদের সঙ্গীত শিক্ষার প্রসার নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সফল আয়োজন যাতে মুসলিম তরুণ-তরুণীরা সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন করতো , পহেলা বৈশাখে নববর্ষ উদযাপন, রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জয়ন্তীয় অনুষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে বাৎসরিক সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন প্রভৃতি। এগুলি পাকিস্তানের প্রথম দিনগুলিতে নিষিদ্ধ ছিল কার্যত:। বলা হতো এসব ইসলাম বিরোধী, পাকিস্তান-বিরোধী প্রভৃতি। কিন্তু বাহান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে ঐ বিভ্রান্তিকর মিথ্যা প্রচারের হাত থেকে মুক্ত করে।

কী ভয়াবহ অবস্থারই না সৃষ্টি করেছিল পাকিস্তান আন্দোলন! সবাই হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ-খৃষ্টান পরিচয়ে যেন শাসকগোষ্ঠীর কাছে বিবেককে বন্ধক দিয়ে ফেলেছিল বাঙালি জাতি। হিন্দুরা ছুটছিল যারা কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন ও হিন্দুস্তানের সেগুলিই যেন তাদের আবাসস্থল। মুসলিমরা ছুটছিল ঐ পরিচয়ে মক্কা-মদিনার শুষ্ক মরুপ্রান্তর। যেন ওটাই তাদের মাতৃভূমি। এই বিষাক্ত, অসত্য চিন্তার সমাধি রচনা করে সবাইকে দিব্যি স্বদেশে ফিরিয়ে আনলো বাঙালি পরিচয় নদ-নদী-বন-জঙ্গল-পাহাড়-পর্বত সজ্জিত প্রিয় মাতৃভূমি বাংলার মাটিতে।

অত:পর বন্দিমুক্তি, যুক্তফ্রন্ট গঠন প্রভৃতির মাধ্যমে মুসলিম লীগকে নির্বাচনে হারিয়ে পূর্ববাংলা থেকে তার মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিয়ে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয় এক উৎসব মুখর বাংলাকে দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেছিল এক বিজয় গর্বে গর্বিত বাঙালি জাতি হিসেবে।

অত:পর এক ইউনিট বাতিল, সংখ্যা-সাম্য বাতিল, সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সারা পাকিস্তান ব্যাপী নির্বাচন, ৬-দফা-১১দফা দাবীতে ও সামরিক শাসন প্রত্যাহারের দাবীতে ষাটের দশক জুড়ে ধারাবাহিক আন্দোলন যখন তুলে তখন তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে দেশকে আরও এক দফা অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়ে দ্বিধা করে নি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর জেনারেল আইয়ুব খান। এতে আগুনে ঘৃতাহুতি হলো মাত্র। জনতার রুদ্ররোষ কোথায় এসে গেল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। পশ্চিম পাকিস্তানী বিচারক ও আইনজীবীরা রাতের অন্ধকারে পালিয়ে চলে যান প্রাণ হারানোর ভয়ে। সমগ্র দেশ ঐ প্রহসনের মামলা বাতিল ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবীতে যে জঙ্গি আন্দোলনে মেতে উঠেছিল তার চাপে ঐ মামলাও কোথায় উড়ে গেল জানা যায় না। নি:শর্ত মুক্তি লাভ করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

পরে আরও এক দফা আন্দোলন আমরা যাকে বলি ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। এতও বাঙালির বিজয় সূচিত হলো। সমস্ত রাজবন্দী মুক্তি পেলেন। দেশ পৌঁছালো সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনের মুখে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির অসাধারণ বিজয় অর্জিত হলো। বঙ্গবন্ধু হলেন সারা পাকিস্তানের অবিসংবাদিত জননেতা প্রধানমন্ত্রীত্বের বৈধ দাবীদার। ভোটের ফলাফলে দেখা গেল পঁচিশটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত পাকিস্তানের মোট আসনগুলির মধ্যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ শুধুমাত্র পূর্ববাংলা থেকে জেতা আসনগুলির জোরেই। নির্বাচনী বিধান অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর হাতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা। ঐক্যবদ্ধ বাঙালির এ এক বিশাল বিজয়।

কিন্তু প্রাক-নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি কার্যকর করতে এগিয়ে না এসে পাকিস্তানের গণবিরোধী শাসক গোষ্ঠী অস্ত্রের মাধ্যমে বাঙালি জাতকে “উচিত শিক্ষা” দেওয়ার ষড়যন্ত্র আঁটতে থাকে। সে অনুযায়ী তারা একদিকে সংসদ অধিবেশন আহ্বান করার পর পাঞ্জাবের নির্বাচিত নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে দিয়ে বলায় যে,‘সংসদ অধিবেশন ঢাকাতে নয়-তা পশ্চিম পাকিস্তানে হতে হবে নিরাপত্তার স্বার্থে,কারণ ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী সংসদদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই।

অত:পর শাসকগোষ্ঠী সংলাপের আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর ঢাকাতেই অধিবেশন অনুষ্ঠানের দাবী না মেনে আহুত অধিবেশনের তারিখটি বাতিল করে উভয় অঞ্চলের নেতৃবৃন্দর মধ্যে সংলাপের আহ্বান জানালে বিস্তর মতানৈক্য সত্বেও বঙ্গবন্ধু সংলাপের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্র অনুযায়ী ইয়াহিয়া সরকার সময় ক্ষেপণের কৌশল নিয়ে দ্রুত গোপনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র আনতে থাকে পূর্ব বাংলায়। সংলাপও যেমন চলছিল তেমনি আবার অস্ত্র গোলাবারুদ ও সৈন্যও আসছিল ব্যাপকভাবে কিন্তু নেপথ্যে।

হঠাৎ করে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় কোন ঘোষণা না দিয়েই পাকিস্তানি নেতারা গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন সংলাপ ত্যাগ করে আর সাথে সাথে ঢাকায় শুরু হয় “অপারেশন সার্চ লাইট” নামক ভয়াবহ সশস্ত্র আকস্মিক আক্রমণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার আবাসিক হলগুলিতে, পিলখানার ই-পি আর (বর্তমানে বিজিবি নামে অভিহিত) হেডকেয়ার্টার রাজারবাগে পুলিশ হেড কোয়ার্টার সহ নানা স্থানে যাতে বাঙালি কি রাজনৈতিক ভাবে কি সাময়িকভাবে প্রত্যাঘাত হানতে না পাবে। বঙ্গবন্ধুকেও গ্রেফতার করা হয় একই লক্ষ্যে।

পরিকল্পিত গণহত্যার মুখে ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে। কারাগারে নিয়ে যাওয়া হলো বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের ছোট্ট দোতলা নিজস্ব বাসভবন থেকে। আটককৃত বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব বাংলার কোন কারাগারে রাখারও সাহস হয় নি সামরিক শাসকগোষ্ঠীর। তারা তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে একটি নিঃসঙ্গ সেলে আটকে রাখে - না ছিল সেখানে টেলিফোন- না টেলিভিশন-না দেশী -বিদেশী সংবাদপত্র।

অপরদিকে সেনাবাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ সমেত পাঠানো হলো প্রতিটি জেলা শহরে। দখল করে নেওয়া হলো বেতার ও টেলিভিশন ভবনগুলিকে। বাঙালি সৈন্যদেরকে সরিয়ে দেওয়া হলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে অনেককে পাঠানো হলো পশ্চিম পাকিস্তানের নানা ক্যান্টনমেন্টে অত্যন্ত গোপনে। সেখানেও তাদেরকে একত্র থাকতে দেওয়া হয় নি। এক এক জনকে এক এক ব্যাটেলিয়নের পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারদের অধীনে। ঢাকার সকল গণমাধ্যমে প্রি-সেন্সরশিপ আয়োজন করা হলো। পূর্ব বাংলার সমগ্রটাই যেন একটা বন্দী শিবিরে পরিণত হলো। সরকারী-বেসরকারি সকল টেলিফোন সংযোগ পূর্ববাংলায় বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলো। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হল অতর্কিতে।

চললো ব্যাপক গণহত্যা। পাক-বাহিনীর বিশ্বস্ত দোসরে পরিণত হলো প্রাথমিকভাবে বিহারীরা যারা নানা শহরে ও গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে জংশন ষ্টেশনে গুরুত্বপূর্ণ পদে আগে থেকেই অধিষ্ঠিত ছিল। পাক-সেনারা ঐ বিহারীদের মাধ্যমে নেতৃস্থানীয় বাঙালি রাজনীতিক, ছাত্র নেতা, ব্যবসায়ী, অধ্যাপক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, যুবতী নারীদের (বিবাহিত-অবিবাহিত নির্বিশেষে) তথ্যাদি সংগ্রহ করতো। বিহারীরাও তা দিব্যি সরবরাহ করতো তারা ভাবতো বাঙালি আর বাঁচবে না। তাই তাদের হত্যা করা, হত্যায় সহায়তা করা, তাদের বাড়িঘর, সহায় সম্পদ লুটপাট করা ও নারীদেরকে যৌন উপভোগে সহায়তা করা এগুলি তাদের পবিত্র “ইসলামিক” দায়িত্ব। পরে একই লক্ষ্যে বাঙালিদের ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে গঠিত হলো শান্তিকমিটি, আলবদর, রাজাকার বাহিনী সমূহ।

নানা জায়গায় গণহত্যা, সন্ত্রাস, সশস্ত্র আক্রমণকে থোরাই পরোয়া করে বাঙালি প্রত্যাঘাত হানতে সুরু করলো যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে। পুলিশ, অবসর প্রাপ্ত সৈন্য প্রভৃতির কাছে অস্ত্র প্রশিক্ষণও চলতে থাকলো। জেলায় জেলায় তা ছড়িয়ে পড়লো। “বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো” শ্লোগানটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো।

পাবনা, কুষ্টিয়া সহ কতিপয় জেলা প্রথম দফাতেই পাক-সেনাদেরকে খতম করে স্বাধীন হলো ২৯-৩০-৩১ মার্চের মধ্যেই। ঐ জেলাগুলিতে জেলা ভিত্তিক স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নতুন করে উত্তোলন করাই শুধু নয় স্বাধীন প্রশাসনও গড়ে তোলা হয় যদিও তা দ্বিতীয় দফা প্রচণ্ড আক্রমণে এপ্রিলের মাঝামাঝি ভেঙ্গে পড়ে।

এবারে বাঙালি যোদ্ধারা, যুবক তরুণ-তরুণীকে ছুটতে বাধ্য হতে হয় প্রতিবেশী ভারতে। তাজউদ্দিন আহমেদ সহ নেতৃবৃন্দও পূর্ব সিদ্ধান্ত মত সেখানে যান। গঠিত হয় যথারীতি প্রবাসী এবং অস্থায়ী যুদ্ধ কালীন বাংলাদেশ সরকার তাজ উদ্দিন আহমেদের সুযোগ্য প্রধানমন্ত্রীত্বে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের অকৃত্রিম সহৃদয় শ্রীমান ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন বাংলাদেশ সরকার। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে ঐ তরুণ-তরুণীরা অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে অস্ত্র হাতে দেশে প্রবেশ করে বীরে মত লড়াই করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালী জাতির সম্পদ বাস্তবে রূপ দেয় - এ ইতিহাস সবারই জানা। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বও এগিয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে।

কিন্তু এই ঐতিহাসিক বিজয় অর্জিত হয়েছিল কতিপয় মহান আদর্শের ভিত্তিতে যে আদর্শগুলি লালন করতো পাকিস্তান তাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে।

শত সহস্র সংগ্রামের (যার মাত্র কিছুটা অংশের উল্লেখ উপরে করেছি) মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার সুমহান আদর্শগুলি হলো গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র। ১৯৭২ সালের সংবিধানেরও এই আদর্শগুলিকে মৌলনীতি হিসেবে সংসদে সর্ব সম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এই আদর্শের বাস্তবরূপ হিসেবে সাম্প্রদায়িক দল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি ঐ সংবিধানে নিষিদ্ধই শুধু করা হয় নি, বলা হয়েছিল বাংলাদেশে ধর্মের নামে কোন দল গঠন বা তার নামে কোন প্রকার রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ থাকবে।

বলা হয়েছিল, নারী-পুরুষ জাতীয় অর্থনৈতিক ও সামরিক জীবনে সম-অধিকারের অধিকারী হবেন। সম-অধিকার একটি মৌলিক ও জন্মগত অধিকার বাংলাদেশের সকল সুনাগরিকের জন্য -লিঙ্গ, ধর্মীয় বিশ্বাস, গাত্র বর্ণ প্রভৃতি কোনটার জন্যই সমানাধিকার হরণ করা যাবে না।

আরও বলা হয়েছিল, অর্থনৈতিক বৈষম্য যা পাকিস্তান আমলে মানুষে মানুষে লালিত হয়েছিল তারও অবসান ঘটিয়ে সে ক্ষেত্রেও বৈষম্য দূর করা হবে।

দেশকে শিক্ষায়-দীক্ষায়, কৃষিতে, শিল্পে, সামাজিক ব্যবস্থাদিতে আধুনিকতার প্রচলন করা হবে।

অশিক্ষা-কুশিক্ষা-নিরপেক্ষতা, বেকারত্ব প্রভৃতির অবসান ঘটানো হবে।

কিন্তু আজ এই ৪৭ তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে একটি বার দেশের সামগ্রিক অর্জন সমূহের দিকে বা মৌলিক অঙ্গীকারগুলি বাস্তবায়নের দিকে তাকালে যে বিবর্ণ চিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাকে স্পষ্টত: দেখা যায় আমরা অঙ্গীকারগুলির অতি সামান্যই অর্জন করতে পেরেছি বরং সেগুলির ক্ষেত্রে ব্যর্থতা আকাশ প্রমাণ।

আর আদর্শের দিকে তাকালে দিব্য দেখা যায় সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের অবাধ পুনরুজ্জীবন ব্যাপকভাবে ঘটেছে , সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার নামমাত্র উল্লেখ থাকলেও রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম, সংবিধানের শুরুতে“বিসমিল্লাহ্‌” ও ধর্মের নামে দলগুলিকে বৈধতা দিয়ে আমরা লঙ্ঘন করে চলেছি মৌলিক আদর্শের প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারকে।

নারী-পুরুষের সম-অধিকার আজও অর্জিত হয় নি-তা কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ।

তেমনই আবার আইনের শাসনের মূল বিষয়টিও পরিত্যক্ত। ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন দৈনন্দিন ব্যাপারে পরিণত হলেও আইন সেক্ষেত্রে আদৌ হস্তক্ষেপ করে না - ফলে অপরাধীরা দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সংখ্যালঘুরা হাজার হাজার দেশত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে রাষ্ট্র সেক্ষেত্রে নির্বিকার।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে কিন্তু পুঁজিবাদী কায়দায় যার সুফল মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণীই পাচ্ছে ,নির্মম শোষণ অব্যাহত থাকছে বিত্তহীন শ্রমজীবীদের উপর।

সে কারণেই আজকের প্রশ্ন এই কি সেই দেশ?

রণেশ মৈত্র, লেখক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক; মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ইমেইল : [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ