প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
সাইফুর মিশু | ১৫ মার্চ, ২০১৭
কিছু ইতিহাস রটে, কিছু ইতিহাস বটে। যা রটে তা সবসময় সঠিক এবং গ্রহণযোগ্য হয় না, গ্রহণযোগ্য হয় যা বটে তথা দলিল এবং প্রাতিষ্ঠানিক দলিলের ভিত্তিতে। কিছুদিন যাবত অনেকেই ৭ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উল্লেখ করছেন তাদের নানা রকম উদ্ধৃতিতে। তাদের আবেগের প্রতি সম্মান রেখেই কিছুটা জানার চেষ্টা করেছি দলিল এবং প্রমাণকে ভিত্তি করে।
প্রথমেই সংক্ষেপে ১৯৭১ সালের মার্চের ঘটনাপ্রবাহ থেকে জেনে নিই উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী। যদিও ঐ মাসের কোন ঘটনাই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবুও শুধুমাত্র স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীনতা দিবসের সমর্থন কিংবা অসমর্থনের সাথে সম্পৃক্ত ঘটনাবলীকে অধিকতর আলোকপাত করে জানার চেষ্টা করবো।
১ মার্চ ১৯৭১, ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একে ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল আহ্বান করেন। ২ মার্চ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে বটতলায় প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরদিন অর্থাৎ ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতেই উত্তোলিত হয় এবং জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। সেদিনই বঙ্গবন্ধু সারাদেশে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ২৩ মার্চ।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু কি বলেছিলেন তা নতুন করে উল্লেখ করার কোন প্রয়োজন নেই। তবে উক্ত ভাষণে তিনি “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম” বলার পাশাপাশি আরো কিছু কথা বলেছেন। তিনি উক্ত ভাষণে তিনটি শর্ত সাপেক্ষে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান।
শর্তসমূহ:
তার মানে দাঁড়ায়, বঙ্গবন্ধু উক্ত ভাষণের মাধ্যমে জনগণকে স্বাধীনতার দিকে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকার কথা বললেও সেটিই স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা ছিল না। অর্থাৎ, ৭ মার্চ এই কথার মাধ্যমে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে গণ্য হয় না।
এবার আসি ৭ মার্চ এবং ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী ঘটনাবলীতে। ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের শাসনভার নিজ হাতে নেয়ার ঘোষণা দেন। যদি ৭ মার্চেই বাংলাদেশ স্বাধীন হতো তবে ১৫ মার্চে বঙ্গবন্ধু নতুন করে শাসনভার নেয়ার কোন প্রয়োজন পড়ে না।
৭ মার্চ থেকেই মূলত মার্চের শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই সারাদেশ চলছিল, তবুও একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যতক্ষণ না ঘোষণা দিচ্ছেন ততক্ষণ দেশকে স্বাধীন বলাটা ভুল। পরদিন অর্থাৎ ১৬ মার্চ প্রথম দফায় বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানের সাথে বৈঠক করেন যার ব্যাপ্তি ছিল আড়াই ঘণ্টা।
এখানে প্রশ্ন আসে, ৭ মার্চকেই স্বাধীনতা দিবস দাবী করলে উক্ত বৈঠক কেন? এবং ২০ মার্চ পর্যন্ত চার দফায় ইয়াহিয়া খানের সাথে নির্বাচিত অন্য সদস্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক কেন? ৭ মার্চকেই আবেগের বশে স্বাধীনতা দিবস দাবী করলে কি বঙ্গবন্ধু উক্ত বৈঠকের কারণে তাঁকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় না?
এবার একটু জেনে দেখি ২৬ মার্চে সেই ওয়্যারলেস বার্তায় বঙ্গবন্ধু কি বলেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন,
“এটি হয়তো আমার সর্বশেষ বার্তা। আজ হতে বাংলাদেশ স্বাধীন।”
উপরোক্ত বাক্যে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করেই বলেছেন, “আজ হতে...” অর্থাৎ ২৬ মার্চ মধ্যরাতে গ্রেপ্তারের পূর্বে যখন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাই শুধুমাত্র মৌখিক ঘোষণা দিয়েই তিনি তাঁর দায়িত্ব শেষ করেননি। তিনি একটি কাগজে লিখিত ঘোষণাও দিয়েছিলেন যাতে তাঁর নিজ হাতে দেয়া সাক্ষর রয়েছে।
স্বাধীনতার ঘোষণা
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ছাড়াও দেখে নিতে পারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র যাতে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা আছে ২৬ মার্চেই স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র
৭ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস দাবী করলে অস্বীকার করা হয় এই ঘোষণাপত্রকে। মনে রাখা উচিত তৎকালীন সরকারের অধীনেই পরিচালিত হয়েছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। আর তাই উক্ত সরকারের ঘোষণাপত্রকে আংশিক কিংবা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা উক্ত সরকারকেই পরোক্ষভাবে অস্বীকার করার শামিল।
হয়তো এতটুকু তথ্যতে সন্তুষ্টি আসবে না অনেকেরই। এরপরেও যদি আমরা শুধুমাত্র আবেগের বশীভূত হয়ে ৭ মার্চকেই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে দাবী করি তবে একটু কষ্ট করে বাংলাদেশের প্রথম বর্ষপূর্তি উৎসবে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি শুনে নিতে হবে।
উক্ত বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু নিজ মুখে ২৬ মার্চকে বাংলাদেশের প্রথম বর্ষপূর্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অতএব ৭ মার্চ কিংবা ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জন্ম হয়নি, হয়েছে ২৬ মার্চ ১৯৭১ইং। এবং ২৬ মার্চই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস তথা জন্মদিন। নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু জীবিত অবস্থায় বলা কথাকে আমরা আবেগ বলে উড়িয়ে দিবো না। নিশ্চয়ই তাঁর নিজ মুখে দেয়া বক্তব্যের চেয়ে বড় কোন দলিল হতে পারে না আমাদের কাছে।
এবার দলিলের বাইরে কিছু কথা উল্লেখ করি। প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের একটি সাক্ষাৎকারে তিনি উল্লেখ করেন, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সালে শেখ মনি সহ কয়েকজন যুব ও ছাত্রনেতার সাথে মিলে তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন তাঁর বাসায়। বঙ্গবন্ধু সেদিন তাদেরকে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। এরপর ২৫ মার্চের সন্ধ্যায় যখন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যান তখন তিনি আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, শেখ মনি এবং সিরাজুল আলম খানকে বলেন রাজেন্দ্র রোডের সেই বাড়ির কথা। বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন সেখানে গেলে সকল রকমের সহযোগিতা তারা পাবে।
৭ মার্চকে আবেগের জোরে আমরা স্বাধীনতা দিবস বলাটা ভীষণ রকমের ঐতিহাসিক ভুল। বলা যেতে পারে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু পুরো জাতিকে কৌশলে জানিয়ে দিয়েছেন কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে সবকিছু। যেখানে ৩ মার্চের বঙ্গবন্ধুর সামনেই একটি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে জাতীয় সংগীত গেয়ে সেখানে ধরা যায় ৭ মার্চ নয় অনেক আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু বুঝে গিয়েছিলেন সময় হয়ে গেছে চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়ার। তবে একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে কিছু প্রাতিষ্ঠানিকতা রক্ষা না করলে বরং নানা ভাবে বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ডগুলোই প্রশ্নবিদ্ধ হতো।
তাই আবেগের ইতিহাস বাদ দিয়ে আসুন দালিলিক ইতিহাসকে হ্যাঁ বলি।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য