আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

নারীবাদ ও সমতার আন্দোলন : বাংলাদেশে সাম্প্রতিক নারীবাদী লেখালেখি প্রসঙ্গে

কাজল দাস  

সকল চিন্তা জগতের মতো, নারীবাদী তত্ত্ব, তাঁর রাজনীতি ও কর্মক্ষেত্র এবং এর পদ্ধতি মিলিয়ে এটিও একটি চিন্তা জগত। এবং তা মোটে ও নতুন নয়। এই চিন্তা চর্চার শতাধিক বছরের বেশি সময়ের একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। রয়েছে তাঁর নানান চরাই উৎরাই। এই চিন্তাগজতের মধ্যেও রয়েছে বিভিন্ন ঘরানা। ক্লাসিক্যাল মার্কসীয় নারীবাদকে ক্রিটিক করে গড়ে উঠেছে সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ, তাও বিপ্লবের পরে সার্বিক নারী মুক্তির প্রশ্নে। উদারবাদী নারীবাদী রাজনীতিকে ক্রিটিক করে গড়ে উঠেছে র‍্যাডিকাল নারীবাদ। উদারবাদীরা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সমতা চাইতেন এই পুঁজিবাদী ও পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোর ভেতর। র‍্যাডিকালদের বক্তব্য ছিল নিজের শরীর, যৌনতা আর সন্তান উৎপাদনের প্রশ্নে তাঁরা আরো কঠোর হতে চান। নারী আর প্রকৃতি একই, এই দুটোকে একই সাথে সুরক্ষা দিতে হবে এই প্রশ্নকে সামনে রেখে গড়ে উঠেছে ইকো ফেমিনিজম।

আরেক দল নারীবাদী মনে করেন, নারীরা আসলে শব্দ, ভাষা আর চিত্রের বর্ণনার জালে আটকে আছেন যুগ যুগ ধরে, তাঁরা হলেন উত্তরাধুনিক নারীবাদ। একইভাবে আরেকদল মনে করেন, নারীবাদী সংস্কৃতিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভেতরে গড়ে তুলতে হবে কারণ নারীর অধস্তন হবার ইতিহাস পুরোপুরিই একটি সাংস্কৃতিক বিষয়, এই নারীরা হলেন সাংস্কৃতিক নারীবাদী। কালো নারীরা অন্যান্য নারীদের থেকে আলাদাভাবে নির্যাতনের শিকার, সেই জন্য গড়ে উঠেছে ব্ল্যাক ফেমিনিজম। এসবের বাইরে একদল মনে করেন, নারীবাদ দিয়ে আলাদা কাজ করার দরকার নেই। সব মিলিয়ে একত্রিত হয়ে কাজ করা যাবে এবং মানবতাবাদের ঐক্যের ভিত্তিতেই নারী মুক্তি ঘটবে। এরা হলেন নারীবাদী তত্ত্বের বিরোধী, যদিও তাঁরা নারীর সমঅধিকার চান।

নারীবাদের এই যে আদর্শিক ভিত্তি, সেটা কোন কাল্পনিক বা অযথার্থ প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেনি কিংবা এটা কারো নিছক মনগড়া ভাবনা-চিন্তা দিয়ে দাঁড়ায়নি। তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। রয়েছে স্বতন্ত্র সামাজিক বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয় বুনিয়াদি। গোটা নারীবাদী চিন্তাজগতকে যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে মোটাদাগে আমরা তার কিছু বিষয় পাবো, যার দ্বারা দীর্ঘকাল থেকে নারীরা পিছিয়ে আছেন একটি কাঠামোগত সংস্কৃতির ভেতরে। এই সংস্কৃতির নাম মূলত পিতৃতন্ত্র, পুরুষতন্ত্র ও পুঁজিবাদ। এই কাঠামোর ভেতরে গড়ে উঠেছে ধর্ম, রাজনীতি, জেন্ডার বিভাজিত কাজের বিভাজন, সাহিত্য, শিল্প, চিত্র, শিক্ষা ব্যবস্থা, সম্পর্ক, বিয়ে, সন্তান জন্মদান, উত্তরাধিকার সহ সকল সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার উপাদান। নারীবাদী আদর্শ এখানে মূল যে কাজটি করে সেটা হলো, বিদ্যমান ব্যবস্থার সকল উপাদানে নারীকে অধস্তন করার যত ধরণের কৌশল আছে তা সেটাকে চিহ্নিত করে এবং তার বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান তুলে ধরে এবং অধিকার বাস্তবায়নের জন্য বাস্তবিক কর্মসূচি প্রণয়ণ করার রাজনীতি চালিয়ে যায়।

নারীবাদের এই রাজনীতি মূলত যে জায়গা দিয়ে পরিচালিত হয়, তার মূল কথাই হল- সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। এই সমতার প্রশ্নেই নারীরা কাজ করেন। শুধু নারীই নয়, পুরুষেরাও এই সমতার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এখানে সমতার জন্য আন্দোলন করাও যেমন একটি প্রয়োজনীয় বিষয়, সেই সাথে সমতার সংস্কৃতি নির্মাণের জন্য চিন্তা-তত্ত্ব ও সাহিত্য নির্মাণের কাজটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটো দিকেই এগিয়ে যেতে হয় নারীবাদকে। প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য পর্যন্ত আমরা সেজন্য দেখতে পাই, নারীরা একদিকে যেমন লেখালেখির কাজ করেছেন, তেমনি কাজও করে গেছেন। আমাদের দেশে বেগম রোকেয়া কিংবা সুফিয়া কামাল যা করেছেন, একই কাজ করেছেন ক্লারা জেৎকিন বা রোজা লুক্সেমবার্গরাও। আবার অনেকে শুধু লেখালেখিই করে গেছেন ধারাবাহিকভাবে। এই লেখালেখিটাও কিন্তু নারীবাদী রাজনীতির একটি কাজ। এখন পর্যন্ত নারীবাদের অর্জিত অমূল্য সম্পদের একটি হল তার লেখালেখি।

নারীবাদী রাজনীতিতে বাস্তবিক কাজের পাশাপাশি লেখালেখিটাও সমাজের পরিবর্তনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বেগম রোকেয়ার সাহিত্য আজো যেমন প্রাসঙ্গিক, একইভাবে প্রাসঙ্গিক মেরী ওলস্টোনক্রাফট বা সিমোন দ্য বুভোয়ারের লেখালেখিও। নারীবাদে লেখালেখি করাটা গুরুত্বপূর্ণ, তার বড় কারণ কেবল শুধুই সামাজিক সচেতনতা তৈরি করা- এভাবে দেখলে আমাদের কাছে পুরোটা বিষয় পরিষ্কার হবে না। এটাকে দেখতে হবে সংস্কৃতি নির্মাণের প্রেক্ষাপটের ভেতর দিয়ে। সমাজে প্রচলিত সকল ধরণের প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় একটি পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ দিয়ে, এখানে নারীর সকল প্রকার গড়ন তৈরি হয় পুরুষতন্ত্রের ভাষ্য দিয়ে। সেজন্য তার বিপরীতে নারীবাদী চিন্তা ও চর্চার একটি চলমান প্রবাহ বজায় রাখার জন্য অধস্তন কাঠামোর বিপরীতে লিখে যাওয়াটা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। চারদিক থেকে নির্যাতনের কাঠামোকে ক্রমাগত আঘাত করে যাওয়া এখানে জারি রাখা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কয়েক হাজার বছরের পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর বিশাল হিমশৈলকে ভাঙার জন্য আন্দোলনের সাথে সাথে তার রূপ উন্মোচিত করে যেতে হবে, সেই সাথে বিকল্প চিন্তা ও ভাবনার সংস্কৃতি নির্মাণের একটি প্রবাহমান স্রোত বজায় রাখতে হবে। সমতার চেতনা নির্মাণের জন্য নারীবাদী লেখালেখিটা একটি প্রবাহমান স্রোতের মত। এক ধরণের আন্দোলন করে কিছুটা অধিকার অর্জিত হয়, আবার নতুন সমস্যা উদ্ভূত হয়, পুরনো ভাবনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে নতুন চিন্তা, নতুন আন্দোলন। নারীবাদ এভাবে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলে চিন্তা ও কর্মের সমন্বয়ে।

বাংলাদেশেও বর্তমান সময়ে এসে নারী আন্দোলনের পাশাপাশি নারীবাদ বিষয়ক লেখালেখি একটি প্রতিষ্ঠিত জায়গা নিয়েছে। প্রতিষ্ঠিত জায়গা নিয়েছে বিষয়টা এখানে যে অর্থে বলা সেটা হলো- এই লেখালেখি সাধারণী একটা রূপ লাভ করেছে। একটা সময় পর্যন্ত আমাদের দেশে নারীবাদ বিষয়ক লেখালেখি সীমাবদ্ধ ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অরাজনৈতিক সংগঠনের মুখপত্র হিসেবে, বিভিন্ন স্বতন্ত্র নারী বিষয়ক ম্যাগাজিন হিসেবে, বিভিন্ন দাতা সংস্থার অনুদানে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানের সচেতনতা ভিত্তিক সাময়িকী হিসেবে এবং বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের নারী বিষয়ক সুনির্দিষ্ট পাতার মধ্যে। আর দুঃখজনক হলেও যে বিষয়টি সত্য তা হলো, এই দেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস শতাধিক বছর হলেও সেখানে নারী ও জেন্ডার বিষয়ক অধ্যয়ন সাম্প্রতিককালে শুরু হওয়াতে তারাও অবদান রাখছেন বিভিন্ন চিন্তাভাবনা প্রকাশে। কিন্তু এখন এই লেখালেখির ব্যাপারটায় আগের থেকে একটি সাধারণচিত্র দেখা যায়। আগের ওইসব পত্রিকাগুলোতে যারা লিখতেন, তাঁরা ছিলেন সংখ্যায় খুব অল্প, সমাজের প্রতিষ্ঠা লাভের সাথে সম্পর্কিত ও পরিচিত। আগের লেখালেখির ধরণ যেহেতু একটি বিধিবদ্ধ উপায়ে ছিল, সেজন্য তার লেখার ভাষা, লেখার বিষয়বস্তু এইসব ক্ষেত্রেও ছিল সীমিত।

কিন্তু বর্তমান সময়ে সামাজিক গণমাধ্যম বিকশিত হবার কারণে ব্যক্তি নারীরা আগের থেকে অনেক বেশি করে নিজের ভাবনাকে লিখার সুযোগ পাচ্ছেন। লিখছেন নারীবাদী পুরুষেরাও। তাঁরা অনেকেই হয়তো প্রথাগত বা প্রতিষ্ঠিত লেখক নন, তাঁদের লেখা হয়তো তাঁরা নিজেরাও মনে করেন অমর অজর কিছু নয়। তাঁরা হয়তো সমাজের এগিয়ে থাকা সুবিধাভোগী অংশ, তাঁরা মধ্যবিত্ত, তাঁরা শহুরে, তাঁদের বর্ণনায় ব্যক্তিগত রাগ-ক্ষোভ-বিদ্বেষ আছে, ভাষা প্রকাশের মার্জিত–অমার্জিত ভঙ্গি আছে, আছে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ, রয়েছে আন্তঃব্যক্তিক আবেগ, অনুভূতির প্রকাশ। এসবই যাই থাকুক না কেন, বড় কথা হল নারীরা এখন লিখছেন। লিখছেন মানে নিজেকে প্রকাশ করছেন। এই প্রকাশ করার মাত্রাটা আগের থেকে বহুগুণে বেশি। আর লেখার মাধ্যমটার কারণে তাঁর স্বাধীনতার বিষয়টি সুরক্ষিত থাকায় নিজের নারী হয়ে ওঠার বঞ্চনাকে তাঁরা প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছেন আরো বেশি মাত্রায় । তাঁরা নিজের ফেসবুকে ওয়ালে যেমন লিখছেন, তেমনি লিখছেন ব্লগেও, আবার গড়ে উঠছে অনেক নারী বিষয়ক পোর্টাল। সেখানেও লিখতে পারছেন স্বাধীনভাবে। সম্পাদকের কাঁচি চালানোর বিখ্যাত ‘গেইট কিপিং’ তাঁকে এখন পেরোতে হয় না। গেইট কিপিং থিওরি এখন অনেকটা সংকুচিত। এছাড়াও অনেক অনলাইন পত্রিকায় নারী বিষয়ক কলামেও তাঁরা সুনির্দিষ্ট করে লিখার জায়গা পাচ্ছেন। আগের মত তাঁকে নানাবিধ বাধ্য-বাধকতা দিয়ে লিখতে হচ্ছে না। এই বাধ্য-বাধকতা না থাকার জন্য বলার শক্তিটাও জোরালো এবং স্পষ্ট। যদিও অনেক ক্ষেত্রে এই জোর ও স্পষ্টতা যৌক্তিক সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। এই যে প্রকাশ, এটাও কিন্ত একটি ব্যক্তি নারীর জেগে ওঠা, সমস্বরে মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টা। এটা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।

তাঁদের এই লেখালেখির সময়টা যদিও খুবই কম। এক দশকও পেরোয়নি। তবুও আগের থেকে অনেক বিষয় খুব স্পষ্ট করেই উঠে আসছে তাঁদের চিন্তা ভাবনায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানাবিধ প্রথা ভাঙার শক্তিটা এখানে তাঁদের লেখালেখিতে দৃশ্যমান। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যা কিছু প্রতিবন্ধকতা, তার সব বিষয়েই লিখতে পারছেন তাঁরা। নারীদের মাসিক রজবৃত্তিকে কেন্দ্র করে এই সমাজের যে বিশাল ট্যাবু ছিল, এই জায়গাটিকে অনলাইনের লেখালেখি খুব কার্যকরীভাবে ভাঙতে সচেষ্ট হয়েছে, যা এতোদিন প্রথা আর ধর্মের কাছে ভয়ের কারণ ছিল। এটা এখন অহরহ তাঁরা বলে যাচ্ছেন। তাঁরা বলে যাচ্ছেন নিজেদের ব্যক্তিগত যৌন সম্পর্কের পছন্দ বা অপছন্দ নিয়ে। বিয়ে নামক কাঠামোতে কিভাবে তাঁদের ব্যক্তি ইচ্ছাকে বলিদান করে অন্য কারো কাছে তুলে দেয়া হয়েছে, এই সব যন্ত্রণার ডালপালা সমাজের রক্ষনশীলতার বাতাবরণ ভেঙে বেরিয়ে আসছে ক্রমাগত তাঁদের বয়ান। একজন নারী কিভাবে পোশাক পরবেন, কি পরবেন, তাঁর ব্রা'র ফিতা দেখা গেলে কি আসে যায়, সেও একা চলতে চায় বাসে ভীড়ে, সেও গর্জে উঠতে চায় তাঁর গায়ে কালো হাত উঠালেই- এই সব চিত্র আগের সময়ের থেকে অনেক বেশি প্রকাশিত হচ্ছে। এবং এখানে প্রকাশের ধরণটা যতই ব্যক্তিক হোক না কেন, লক্ষনীয় বিষয় হলো সীমিত সংখ্যায় হলেও নারীরা সমাজের ধর্ম, প্রথা ও সংস্কৃতির ভিত্তিমূলে কড়াঘাত করতে পারছেন সজোরে। কেবল তসলিমা নাসরীনের লেখা ছাড়া এইসব মজ্জাগত পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো নিয়ে এর আগে এতোটা লেখা হয়নি। নারীর যন্ত্রণা যেহেতু বিবিধ ও বিচিত্র, সেজন্য তাঁর সকল প্রকারের বলার ভাষাকেই স্থান দিতে হবে। তাঁরা একইভাবে বিয়েতে নিজের ইচ্ছার প্রাধান্য দেয়া, সম্পত্তিতে সমান অধিকার না দেয়া, শিক্ষানীতিতে নারীর অবমাননা নিয়েও সোচ্চার। প্রবল সোচ্চার পুরুষতান্ত্রিক বর্বরতা ধর্ষণের বিরুদ্ধেও। একটি বিশাল সংখ্যক নারীদের এই লিখতে আসাটা ইতিবাচক পদক্ষেপ।

যদিও এইসব লেখালেখি এখনো দীর্ঘ সময় পার করেনি, তবুও আমাদেরকে এটির একটি মূল্যায়ন বা পর্যালোচনা করা দরকার। কতদূর এগোচ্ছে এইসব লেখালেখি, কতজন লিখছেন, এইসব লেখার সামাজিক প্রভাবটা কতদূর? এগুলোও আমাদের বিবেচনায় আনা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জরুরী। এই লেখালেখির মধ্যে কতজন লেখক পেশাদারিত্ব লাভ করছেন বা নারীদের বাস্তবিক সমস্যা সমাধানের জন্য এই সব লেখা কোন কাজে আসছে কিনা? শুধু অনলাইনের সুবিধাভোগী নারী নয়, প্রান্তিক নারীসহ সকল শ্রেণি-পেশার নারীদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য এই সব লেখালেখির যাত্রা কতটা সহায়ক হচ্ছে, কতটা ভূমিকা রাখছে নারী আন্দোলনের জন্য- এটা ভাবা দরকার ।

প্রথমত, এই সব লেখা যারা লিখছেন, তাঁরা সংখ্যায় এখনো যে বিশাল সংখ্যক তা বলা যাবে না। কারণ লেখার জন্য যে সকল পোর্টাল ইতিমধ্যে আমাদের সামনে আছে, যেমন উইমেন চ্যাপ্টার, জাগরনীয়া, উইমেনস ওয়ার্ড, ফেমিনিজম বাংলা, ঠোঁটকাটা কিংবা বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকার নারী কলাম, সেটা এখনো এই দেশের বিশাল অংশের নারীর কাছে যাচ্ছে না। এখানে আরো বেশি বেশি নারী অধিকারের প্রতিনিধিত্ব করা পোর্টাল যেমন দরকার, তেমনি দরকার আরো বেশি লেখকদের উঠে আসা। এবারের বই মেলায় ইত্তেফাক কর্তৃক প্রকাশিত এক রিপোর্টে তারা ৫টি নারীবাদী বই প্রকাশিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে। এতো বড় মেলায় বই বের হয়েছে হাজার হাজার, অথচ অল্প কয়টি নারীবাদী লেখা! অন্য কোন পত্রিকায় আর কোন আলাদা সংখ্যা প্রকাশিত হয়নি বলেই মনে হচ্ছে। আমরা সব মিলিয়ে ধরে নিতে পারি, এই সংখ্যা খুবই নগণ্য। এটা আর কতোটা বৃদ্ধি পাওয়া দরকার তা এই চিত্র থেকেই বোঝা যাচ্ছে।

তাঁদের এই লেখালেখির একটি সামাজিক প্রভাব অবশ্যই আছে, তবে তা প্রচলিত মূল্যবোধকে এখনো শক্তিশালী ধাক্কা দিতে সামর্থ রাখে না। অধিকন্তু, নারীবাদী লেখালেখির জন্য অনেক লেখক ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছেন বলেও জানা যায়। জানা যায়, পরিবারে তাঁদের এই লেখালেখি মেনে নিচ্ছেন না। তবে এর বিপরীত চিত্রও আছে। কর্মক্ষেত্রে এই নারীরা এখন সমীহ পাওয়ার মতো অবস্থান তৈরি করেছেন। তাদেরকে যেভাবেই দেখা হোক, কিন্ত লেখার কারণে তাঁদের চাওয়াটা দিন দিন রূপ পাচ্ছে। যদিও সামাজিক মাধ্যমে চরম প্রতিক্রিয়াশীল মন্তব্য তাঁদের বিরুদ্ধে দেখা যায়। স্বভাবতই এই শক্তিটাই বেশি। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে, হাতে হাত ধরে অনেক নারীরা লিখছেন। তরুণীরা যেমন লিখছেন, তেমনি লিখছেন অনেক জীবন ভারে অভিজ্ঞ নারীরা, বিভিন্ন পেশার নারীরাও। একটি মেল বন্ধনের রূপ নিতে আরো সময় যে লাগবে, তা বোঝাই যায়, কিন্তু প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে জোরেশোরে। এর সাথে এটাও বলার দাবি রাখে যে এইসব লেখিকাদের নারীবাদ বিষয়ক লেখা নিয়ে সমালোচনাও যেমন জরুরী, তেমনি দরকার আন্তঃসংহতি বাড়ানো। বৃদ্ধি করা দরকার নিজেদের নেটওয়ার্ক।

এখানে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট থাকা দরকার, পুরুষতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্র একটি শক্তিশালী কাঠামো। এই সমাজের চেতনাও তাঁর, সেই চেতনা প্রকাশের মাধ্যমগুলোও তাঁর। সব কিছুই গড়ে উঠেছে নারীদের প্রতিকূলে। এখন সময় বিনির্মাণের। এটার জন্য যে লড়াই দরকার, তার জন্য এখনো বড় কোন প্রস্তুতি আমাদের নেই। এই দেশে এখনো বাল্য বিয়ের মত আইনকে প্রতিহত করার জন্যও শক্তিশালী নারী আন্দোলন গড়ে তোলা যায়নি। তৈরি হয়নি নারীনীতি। শ্রম অধিকার ও নিরাপত্তা এখনো অনিশ্চিত। শিক্ষায় এখনো নারীর অধস্তন অবস্থান বিদ্যমান। সম্পত্তির ক্ষেত্রে সমানাধিকারের মত মৌলিক বিষয় এখনো বাকি। যে সময়ে সরকার মেয়েদের জন্য বাল্য বিবাহের আইন পাশ করে, যে সময়ে সুপ্রীম কোর্ট থেকে নারী ভাস্কর্য সরাতে মৌলবাদী আস্ফালন গর্জে উঠে, যে সময়ে নারীনীতি আটকে যায়, যে সময়ে পাঠ্য পুস্তকে নারীর অধিকার থাকে না, সেই সময়ে নারীবাদী আদর্শ ও তার রাজনৈতিক চেতনা নিয়ে আরো গভীরে কাজ করা প্রয়োজন। ব্যক্তিগত রাগ, ক্ষোভ আর ভালো লাগা মন্দ লাগা দিয়ে নারীবাদ চর্চা এই সময়ে খুবই ক্ষতিকর। আমাদেরকে সূদুরপ্রসারী ভাবনা থেকেই কাজ করে যেতে হবে একটি সত্যিকারের সমতার সংস্কৃতি নির্মাণের জন্য।

আমরা কিছুদিন আগে আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেক্সিজম, রেসিজম, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নারী সমাবেশ দেখেছি। প্রায় ২৯ লাখ নারীর সমাবেশ হয়েছে সেখানে। ৫০টি দেশের শহরে এই প্রতিবাদ করেছেন নারীরা। অথচ আমাদের দেশে বাল্য বিয়ের আইন পাশ হয়ে গেল অবলীলায়, আমরা কিছুই করতে পারিনি। আমাদের এরকম আরো বড় নারী আন্দোলন গড়ে তুলতে অনেক এগোতে হবে। আজকে আমরা পাশ্চাত্য সমাজে নারীর স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের যে প্রতিষ্ঠা দেখি, ভাবার দরকার নেই সেটা এমনি এমনি এসেছে। তার পথে বিশ্বের নারী আন্দোলনকে অনেক দূর হাঁটতে হয়েছে। অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। এই দেশেও তা করতে হবে। সেটা করার জন্য বর্তমান সময়ের নারীবাদী লেখালেখি একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ মাত্র। কিন্তু সম্ভাবনার কথা হলো আমরা এটা শুরু করতে পেরেছি। এটা এখন আরো এগিয়ে নেয়া দরকার। চিন্তার প্রকাশ ও অধিকারের বাস্তবায়নের জন্য আরো বেশি ‘বোল্ড’ হওয়া দরকার আমাদের। পরিবর্তনের জন্য লেখাটা একটি শক্তিশালী নিয়ামক। নারীবাদী কর্মীদের এটি আরো এগিয়ে নিতে চ্যালেঞ্জ নেয়া, আত্মবিশ্বাসী হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। ঠিক যেমন পুরুষতন্ত্র, পিতৃতান্ত্রিকতা ও পুঁজিবাদী অধস্তন অবস্থা হতে মুক্তি পাওয়া ছাড়া নারীর আর কোন মুক্তি নেই।

বাংলাদেশের নারীর সত্যিকারের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমাদেরকে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ নেয়ার কাজটি খুব ভাল করে পালন করতে পারে অনলাইনের নারীবাদী লেখকদের সমঅধিকার বিষয়ক লেখালেখি। আমাদের এই চর্চা সমতা অর্জনের লড়াইয়ের জন্য আরো সুদূর প্রসারী হয়ে উঠুক।

কাজল দাস, অনলাইন এক্টিভিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ