আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

অগ্নিযুগের বিপ্লবী আমাদের মাস্টারদা

পাপলু বাঙ্গালী  

মাস্টারদা, আমাদের কাছে অসাধারণ এবং অনন্য মানুষ। আমাদের কৈশোরের নায়ক, যৌবনের সাহস। আমাদের কৈশোরে সুপারম্যান,ব্যাটম্যান কিংবা স্পাইডারম্যানের চেয়েও যিনি জরুরি। সত্যিকারের হিরো। যিনি নিজের মাতৃভূমির জন্য, মা-মাটি-মানুষের জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। সূর্যসেন বা সূর্য কুমার সেন, ডাকনাম কালু, যিনি ‘মাস্টারদা’ নামে সমধিক পরিচিত। স্কুল শিক্ষক ছিলেন। তাই সবাই মাস্টার দা বলে ডাকতেন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটেছিল। মাস্টারদা ছিলেন সেই অভ্যুত্থানের অবিসংবাদী নেতা।
প্রশস্ত কপাল, শীর্ণকায় অতি সাধারণ এক নিরীহ শিক্ষক, চোখে পড়ার মতো কিছুই নয়, অতি সাধারণ চেহারার এই অসাধারণ মানুষটি একদল অসামান্য দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বিপ্লবী তৈরি করেছিলেন। নির্মল সেন, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, অপূর্ব, অনন্ত সিংহ, প্রীতিলতা, কল্পনা দত্তের মতো অসংখ্য মানব বারুদ তাঁর হাতে গড়া। ভারত উপমহাদেশে যে মানুষটি প্রথম ব্রিটিশদের রাজত্বের দাম্ভিকতায় প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছিলেন। তিনি মাস্টারদা সূর্য সেন। পরাধীন ভারতে চট্টগ্রাম সশস্ত্র অভ্যুত্থান, স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগীর নাম।

১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার এক নিম্নবিত্ত পরিবারে সূর্য কুমার সেনের জন্ম। তাঁর পিতার নাম রাজমনি সেন এবং মাতার নাম শশী বালা সেন। ভালো ছাত্র হিসেবে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। পরে বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পাস করেন ১৯১৮ সালে। শৈশবে পিতা মাতাকে হারানো সূর্য সেন কাকা গৌরমনি সেনের কাছে মানুষ হয়েছেন।

সূর্যসেনের শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয়েছে এমন এক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যুগসন্ধিক্ষণে, যার দরুন বিপ্লবী ভাবধারায় দীক্ষিত সূর্যসেন দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগকে একমাত্র তপস্যা হিসেবে নিয়েছিলেন। তখন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারত রক্ষা আইন ১৯১৬, রাউলাট আইন ১৯১৯-এর মতো কালাকানুন তৈরি করে স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছে। রাউলাট আইনের প্রতিবাদে গণবিক্ষোভে গুলি চালিয়েছে, জালিয়ানওয়ালাবাগে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, হাজার হাজার কর্মীকে কারারুদ্ধ করেছে, কিন্তু আন্দোলন স্তব্ধ হওয়ার পরিবর্তে আরো ব্যাপক ও তীব্র রূপ নিয়েছে। নিপীড়ন যত বেড়েছে, মানুষের প্রতিরোধ আন্দোলন তত শক্তিশালী হয়েছে। এ সময়ে বহরমপুর কলেজে পড়ার সময় তাঁর সঙ্গে বিপ্লবীদের সংযোগ ঘটে। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বিপ্লববাদী পথে আত্মনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তাই রাজনৈতিক কাজের সুবিধার্থে চট্টগ্রামে ফিরে শিক্ষকতার জীবন বেছে নেন। ছাত্রদেরকে অঙ্ক শেখানোর পাশাপাশি জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে থাকেন। তিনি বলতেন, ‘তোমাদের বিদ্যার্জন, তোমাদের দৈনন্দিন জীবনধারণ, তোমাদের ভাবী জীবনের স্বপ্ন ও চিন্তার মধ্যে সবকিছুর ঊর্ধ্বে মনে একটি কথাকে কি প্রোজ্জ্বল করে রাখতে পারবে পরাধীনতার অভিশাপ থেকে, ইংরেজের পরাধীনতার পীড়ন থেকে এই দেশকে মুক্ত করাই তোমাদের ব্রত, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য?’ তিনি নিজে তার সারাটি জীবন এই উদ্দেশ্যেই পরিচালিত করেছেন। পিতৃসম দাদা বউদির প্রতিশ্রুতি ও সম্মান রক্ষায় বিয়ে করলেও তিনি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে নিজেকে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রেখেছিলেন।

১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে ফিরে চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের সঙ্গে মিলে তিনি যুগান্তর দলকে সংগঠিত করতে থাকেন। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, ব্যক্তিগত হত্যা, প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন ব্রিটিশকে হত্যা করলে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে; কিন্তু ভারতবাসীকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানো যাবে না। আবার অহিংস পথে সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়া যাবে না। প্রচণ্ড আন্দোলনের চাপ ও সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমেই কেবল স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব। এ কারণে ধৈর্য আর যত্ন নিয়ে সংগঠন গড়ে তুলেছেন তিনি। ১৯২৩ সালে অর্থ সংগ্রহের জন্য চট্টগ্রামের পাহাড়তলিতে রেল কোম্পানির টাকা লুট করার মামলায় গ্রেফতার হন; কিন্তু প্রমাণের অভাবে কিছুদিন পরে মুক্তি পান। পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার সব বিপ্লবী নেতা ও কর্মীদের বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করতে থাকলে সূর্য সেন দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকেন। ১৯২৬ সালে সূর্য সেন পলাতক অবস্থায় কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রীটের এক মেসে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। প্রথমে মেদিনীপুর, তারপর বোম্বাইয়ের রত্নগিরি ও বেলগাঁও জেলে রাখা হয়। মাস্টারদা যখন রত্নগিরি জেলে আটক, তখন তাঁর স্ত্রীর কঠিন টাইফয়েড রোগ হয়েছিল দেওয়ানবাজারের যে বাসা থেকে মাস্টারদা পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর স্ত্রী সেখানে তখন মৃত্যুশয্যায় ছিলেন। বহু দরখাস্তের পর মাস্টারদাকে যখন পুলিশ পাহারায় রত্নগিরি জেল থেকে ছুটিতে চট্টগ্রাম আনা হয় মুমূর্ষু স্ত্রীকে দেখার জন্য, তাঁর স্ত্রীর আয়ু তখন সম্পূর্ণ নিঃশেষিত। সূর্য সেনের স্ত্রী বিপ্লবী কাজ-কর্মে তাঁকে নেয়ার জন্য মাঝে মাঝে বয়োকনিষ্ঠ সহকর্মীদের কাছে অনুযোগ করতেন। স্বামীর কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা পুষ্প দত্ত এ জীবনে আর এ বিপ্লবী নেতার দেহ-মনের সান্নিধ্যে যেতে পারেন নি। ১৯২৮ সালে বন্দিজীবন অতিবাহিত করে মাস্টারদা জেল থেকে মুক্তি পেয়ে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন।

দেশের রাজনীতিতে তখন ভীষণ উত্তেজনা। কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে সুভাষ চন্দ্র বোসের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি আর গান্ধী নেহরুর Dominion status বা ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে কেন্দ্র করে তীব্র মতবিরোধ, বিপ্লবী নেতাদের সুভাষ চন্দ্রের প্রতি সমর্থন। সূর্য সেন তখন চট্টগ্রাম কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক।  ১৯২৯ সালে ১৩ সেপ্টেম্বর লাহোর জেলে একটানা ৬৩ দিন অনশন করে বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মারা যান। এর প্রতিক্রিয়ায় সারা বাংলায় প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দেয়। বিক্ষোভ মিছিল ও সভায় নেতা সূর্য সেন বিপ্লবের পরবর্তী কার্যক্রমের পরিকল্পনা সদস্যদের সামনে তুলে ধরেন। বিপ্লবীরা স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করার শপথ নেন। এ জন্য তারা ‘মৃত্যুর কর্মসূচি’ ঘোষণা করেন। ১৯৩০ সালের শুরু থেকে আসকার খাঁর দিঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত কংগ্রেস অফিসে সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী ভবিষ্যতের সশস্ত্র বিপ্লবের রূপরেখা নিয়ে বিভিন্ন নেতাকর্মীদের সাথে আলোচনার পর ঠিক করেন শুধু শহর না, বরং বিভিন্ন গ্রাম এবং কক্সবাজার থেকেও বিপ্লবীদের নেয়া হবে। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চিটাগাং ব্রাঞ্চ”। বাংলায় “ভারতীয় প্রজা তান্ত্রিক বাহিনী, চট্টগ্রাম শাখা”। যার সদস্যা সংখ্যা ছিলো প্রায় ৬০-এর অধিক। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিলো, এই সংখ্যার মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ ছিলো ১৪ থেকে ১৯ বছরের তরুণ। আইরিশ বিপ্লবের ধাঁচে একটা পরিকল্পনা তৈরি করা হয়।

মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে জালালাবাদ যুদ্ধ,  পাহাড়তলি ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ইত্যাদি সহ সকল অপারেশনে এই দল গড়ে তোলা হয়েছিল একটি সুসংগঠিত সেনাবাহিনীর আদলে কিন্তু তার সাথে ছিল মৃত্যুপণ দেশপ্রেমে পাগল প্রজন্ম। এমন অবস্থায় ১৯৩০ সালের ১৬ এপ্রিল চট্টগ্রামে প্রকাশ্য রাস্তায় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক সূর্য সেন স্বাক্ষরিত ইশতেহার ছড়ানো হলো। ‘দেশের দিকে দিকে স্বাধীনতার তুর্য ধ্বনি শোনা যাইতেছে, সর্বত্র আইন অমান্য সংগ্রামের আরম্ভ হইয়াছে। ১৯২১ সালে যেই চট্টগ্রাম ছিল সবার পুরোভাগে, আজ সেই চট্টগ্রাম পশ্চাতে পড়িয়া থাকিবে, ইহা ক্ষোভ ও লজ্জার কথা । কালবিলম্ব না করিয়া আমরাও ২২ এপ্রিল হইতে আইন অমান্য করিব স্থির করিয়াছি। ইহার জন্য সর্বসাধারণের সহানুভূতি চাই, সত্যাগ্রহী সেনা চাই, লোক ও টাকা চাই।’ এ ইশতেহার ছিল সূর্য সেনের ব্রিটিশ সরকারকে বিভ্রান্ত করার এক কৌশল। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে তিনি ধীরে ধীরে যে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, চট্টগ্রাম বিদ্রোহ, অস্ত্রাগার দখলের, তার তারিখ ঠিক করে রেখেছিলেন ১৮ এপ্রিল। চূড়ান্ত গোপনীয়তা, কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে অল্প কিছু কিশোর তরুণকে নিয়ে গঠিত বিপ্লবী বাহিনীর সাহায্যে ঝড়ের গতিতে তাঁরা দখল করেন অস্ত্রাগার। রেল ও টেলিফোন, টেলিগ্রাফ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। পুলিশ প্রশাসন এই অভিযানের বিন্দুমাত্র আঁচ করতে না পেরে হতভম্ব হয়ে পড়ে। এই অভিযানের সর্বাধিনায়ক ছিলেন সূর্য সেন। ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিপ্লবীরা তাদের দায়িত্ব শেষ করে ফিরে এলে পুলিশ অস্ত্রাগারকে হেড কোয়ার্টারস বানিয়ে সেখানে ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। চট্টগ্রাম সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত ছিল চারদিন। পরবর্তীতে অতিরিক্ত সৈন্য এনে ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড় যুদ্ধের মাধ্যমে যুব বিদ্রোহের অবসান ঘটায় ব্রিটিশরা। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল বিপ্লবীরা যখন জালালাবাদ পাহাড়ে (চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পাহাড়) অবস্থান করছিল সে সময় সশস্ত্র ইংরেজ সৈন্যরা তাঁদের আক্রমণ করে। দুই ঘণ্টার প্রচণ্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০ থেকে ১০০ জন এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন নিহত হয়। এই বিদ্রোহ আপাত অর্থে ব্যর্থ হলেও স্বাধীনতার স্পৃহাকে আরো তীব্র করে তোলে ভারতবাসীর মধ্যে। পরবর্তীতে একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে তিনি ব্রিটিশ সরকারকে অস্থির করে রাখেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিল, প্রীতিলতার নেতৃত্বে পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ। প্রীতিলতার পূর্বে স্বদেশী সশস্ত্র আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল না। নারীদেরকে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত ছিল সূর্যসেনের প্রথাবিরোধী এক সাহসী পদক্ষেপ।

জালালাবাদ যুদ্ধের পর বিপ্লবীরা বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে আত্মগোপন করে ছিলেন। সূর্য সেন ১৬ জন বিপ্লবীকে নিয়ে ২৪ এপ্রিল রাতে বাড়িতে আসেন। এর মধ্যে অনন্ত সিং পুলিশের কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দেন এবং কয়েকজনকে পুলিশ আটক করে এবং এদের বিরুদ্ধে ‘অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলা’ শুরু হয়। এ মামলা শুরু হওয়ার পর অসুস্থ অম্বিকা চক্রবর্তী পটিয়া থানার চক্রশালা গ্রামে গ্রেপ্তার হন। অম্বিকা চক্রবর্তী এবং সেসময় গ্রেপ্তার হওয়া অন্য বিপ্লবীদের নিয়ে ‘দ্বিতীয় অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলা’ শুরু হয়। প্রায় ১৯ মাস বিচারের পর ১৯৩২ সালের ১ মার্চ ‘অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার’ রায়ে অনন্ত সিং, লোকনাথ বল এবং গণেশ ঘোষসহ ১২ জনকে দ্বীপান্তর বাসের আদেশ দেয়া হয়।

পরবর্তীতে অপর মামলায় অম্বিকা চক্রবর্তীর প্রাণদণ্ডের আদেশ হয়, পরে হাইকোর্টে আপিলের রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। এ রায়ের পর সূর্য সেনকে গ্রেফতার করার জন্য পটিয়া এবং গোমদণ্ডীতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সরকার ৫০০০ টাকার পরিবর্তে ১০,০০০ পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯৩২ সালের ১৩ জুন রাত ৯টায় পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী চক্রবর্তীর বাড়িতে তাঁকে ধরার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ক্যামেরনকে গুলি করে সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত নিরাপদে সরে যেতে সক্ষম হলেও নির্মল সেন গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিলের অন্যতম একটি পরিকল্পনা ছিল পাহাড়তলি ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ। কিন্তু গুড ফ্রাইডে থাকায় সেদিন ঐ ক্লাবে কেউ ছিল না। মাস্টার’দা সূর্য সেন স্থির করেন ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ সাল ইউরোপীয় ক্লাবে প্রীতিলতার নেতৃত্বে হামলা করা হবে। এ প্রসঙ্গে মাস্টার’দা লিখেছেন: “বাংলায় বীর যুবকের আজ অভাব নাই। বালেশ্বর থেকে জালালাবাদ, কালারপোল পর্যন্ত দৃপ্ত অভিযানে দেশের মাটি বারে বারে বীর যুবকের রক্তে সিক্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও যে শক্তির খেলায় মেতেছে, ইতিহাসে সে অধ্যায় আজও অলিখিত রয়ে গেছে। মেয়েদের আত্মদানে সে অধ্যায় রচিত হোক এই-ই আমি চাই। ইংরেজ জানুক, বিশ্বজগৎ জানুক, এদেশের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে পিছিয়ে নেই”।

২৩ সেপ্টেম্বর রাতে প্রীতিলতা সূর্যসেন-এর নির্দেশে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। হামলায় ৫৩ জন ইংরেজ হতাহত হয়েছিল। গুলিতে আহত প্রীতিলতা দৈহিকভাবে অত্যাচারিত হওয়ার চাইতে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নিলেন। তিনি পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।

ইংরেজ প্রশাসন সূর্য সেনকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় বন্দি করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখে। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পটিয়ার গইরলা গ্রামের ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়ি থেকে ব্রিটিশ সৈন্যদের হাতে বন্দি হন সূর্যসেন। সূর্য সেন গৈরলা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে আত্মগোপন করে ছিলেন। ব্রজেন সেনের সহোদর পুরস্কারের লোভে নেত্র সেন বিশ্বাসঘাতকতা করে সূর্য সেনের উপস্থিতির খবর পুলিশকে জানিয়ে দেয়। রাত ২টার দিকে অস্ত্রসহ সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেন ধরা পড়েন। পরবর্তীতে সেই নেত্র সেনের আর অর্থ পুরস্কার পাওয়া হয়নি কারণ মাস্টারদার অনুগামী এক বিপ্লবী তাকে হত্যা করে। যার নাম আজও আমরা জানিনা। শুধু সে বিপ্লবীর নাম জানতেন একমাত্র নেত্র সেন এর স্ত্রী, যিনি কোনোদিন সেই নাম প্রকাশ করেননি। কারণ তিনি মাস্টারদার আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন ৷ বিশ্বাস করতেন দেশ প্রেমের কাছে বাকি সব তুচ্ছ ৷

এক বছর জেলহাজতে অমানুষিক নির্যাতন শেষে ব্রিটিশ সরকার তার ফাঁসির সময় নির্ধারণ করে ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি গভীর রাতে। মৃত্যুর পর তার দেহটা দেশের মাটিতে সত্কার করাবার সাহস পায়নি ব্রিটিশ সরকার। তার মরদেহ ফেলে দিয়ে আসে গভীর সমুদ্রে। যে দেশের মাটি ও মানুষকে মুক্ত করার জন্য লড়েছিলেন তিনি, সে দেশের মাটিতে ও জনগণের কাছে সূর্যসেনকে রাখতে ভয় পেয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। মৃত্যুর আগে সূর্যসেনের শেষ বাণী তাই আজো আমাদের শোষণ লুণ্ঠনবিরোধী আন্দোলনের সামনে একদিক নিশানার মতো। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সাথিদের উদ্দেশে সূর্য সেন লিখে গেলেন, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো। সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত। যদি লক্ষ্যে পৌঁছাবার আগে মৃত্যুর শীতল হাতে তোমাকেও স্পর্শ করে তবে আরদ্ধ কাজের দায়িত্ব তোমার উত্তরসূরিদের হাতে অর্পণ করো।’’ তাঁর লাশ বস্তাবন্দী করে দূর-সমুদ্রে ফেলে দেয়া হলো। বাংলার মাটিতে কোথাও যেন তাঁর চিহ্ন না থাকে। কিন্তু বিপ্লবী আত্মার যে মৃত্যু নেই। সূর্য সেন এ দেশের নির্যাতিত মানুষের হৃদয়ে তাই আজও অমর। তাঁর দেখানো পথে বছরের পর বছর অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এ দেশের মানুষ।

মাস্টারদা সূর্যসেনের স্বপ্ন ও সাধনার কথা আমরা যেন ভুলে না যাই।

পাপলু বাঙ্গালী, প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কর্মী। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ