আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

মায়ের কোন জাত নেই

জুয়েল রাজ  

আমরা আসলে কতদিন বাঙালি ছিলাম? এই প্রশ্নটা যদি আপনি কাউকে করেন, দেখবেন উত্তরে কেউ বলবেন, মহান মুক্তি সংগ্রামের ৯ মাস বাঙালি ছিল, আবার কেউ বলবেন, বঙ্গবন্ধু যতোদিন বেঁচে ছিলেন, সেই সময়টুকু আমরা বাঙালি ছিলাম। কেউ বলবেন আমরা তো বাঙালিই আছি। এই প্রশ্নটা আসলেই আপেক্ষিক। জাতি সত্ত্বা বা জাতীয় পরিচয় নিয়ে এক ধরণের ভ্রান্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। নৃ-জাতিগোষ্ঠী নয়, ধর্মীয় পরিচয়ে জাতি পরিচয়ের এক ধরণের পরিচিতি গড়ে তুলছি আমরা।

বাঙালি জাতি সম্পর্কে নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা, এটি একটি মিশ্রিত জাতি এবং এ অঞ্চলে বসবাসকারী আদিতম মানবগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর বহু জাতি বাংলায় অনুপ্রবেশ করেছে, অনেকে আবার বেরিয়েও গেছে। তবে পেছনে রেখে গেছে তাদের আগমনের অকাট্য প্রমাণ। বৃহত্তর বাঙালির রক্তে মিশ্রিত আছে বহু এবং বিচিত্র সব নরগোষ্ঠীর অস্তিত্ব।

সেই মিশ্রিত জাতি সত্ত্বাই হাজার হাজার বছরে বাঙালি জাতিসত্ত্বায় রূপ নিয়েছে। নিজের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, আবেগ নিয়ে একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ড করেছেন এর সাধারণ মানুষ। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মূল ভিত্তিই ছিল বাঙালি জাতিসত্ত্বা। রক্তের কালিতে লেখা বাঙালির প্রথম সংবিধানেও সন্নেবেশিত ছিল সেই আত্মপরিচয়।

এরশাদের সংবিধান কাটাছেড়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইসলামীকরণের শুরু। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এমনকি জামায়াত পর্যন্ত সে সময় এই সংবিধান সংশোধনীর বিরোধীতা করেছিল। সাধারণ মানুষের মাঝে বাঙালি জাতিসত্ত্বাই প্রকট ছিল তখন।

তসলিমা নাসরীনের বিরোধিতার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের রাজপথে প্রথম ধর্মীয় উন্মত্ততা দেখা যায়। তারও অনেক পরে শুরু হয় হালাল-হারাম প্রক্রিয়া। পহেলা বৈশাখ উদযাপন হারাম, গান-বাজনা হারাম, মেলা হারাম, শহীদ মিনারে ফুল দেয়া শিরক- এইসব নানা রকম ফতোয়া। অনেকেই তা মেনেও নিচ্ছেন। আর এভাবেই ধীরে ধীরে বাঙালি সত্ত্বা থেকে ধর্মীয় সত্ত্বাতে বিলীন হয়েছে বাংলাদেশ। সংবিধান, আইন, শিক্ষা ব্যবস্থা সবকিছুতেই ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বলে জাস্টিফাই করা হয়। কেউ বলেন না শতভাগ বাঙালির দেশ।

লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে গত ২ এপ্রিল উদযাপন করা হয় স্বাধীনতা দিবস ও মুক্তিযোদ্ধা সন্মাননা অনুষ্ঠান। লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের তিন মুক্তিযোদ্ধা সদস্য আবু মুসা হাসান, সুজা মাহামুদ ও ইসহাক কাজলকে সেখানে সম্মাননা জানানো হয়। মুক্তিযোদ্ধাগণ ৭১-এ তাঁদের যুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতিচারণ করছিলেন। ইসহাক কাজলের স্মৃতিচারণা থেকেই এই লেখার শিরোনামটা নেয়া। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, দুই-তিনদিন অভুক্ত থাকার পরে তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা দলটি একটি গ্রামে যায়। সেখানে এক হিন্দু নারীর বাড়িতে আশ্রয় নেন তাঁরা। নারীটির ঘরে একপাশে তাঁর দেবতার মূর্তি রাখা। তিনি সেখানে একটা কাপড় দিয়ে ঘিরে মুক্তিযোদ্ধা দলটিকে খেতে দেন এবং বলেন, তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে তোমরা যা আছে তাই একটু মুখে দিতে পারো। মায়ের কোন জাত নাইরে বাবা। তোমরা নিশ্চিন্তে খাও।

দুর্ভাগ্যজনক হলো, এতো সহজ একটি সত্য আমরা ধারণ করতে পারিনি। মায়ের যেমন জাত হয়না, তেমনি জাতি সত্ত্বারও কোন ভাগ হয়না, জাত হয়না। একটাই সত্ত্বা হয়।

জঙ্গিবাদ নিয়ে এখন অনেকেই মাথা কুটে মরছেন। জঙ্গিবাদ রোধের বিভিন্ন পথ খোঁজার চেষ্টা করছেন। আমরাও বলছি- বাংলাদেশের হাজার হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য আছে। এই দেশে জঙ্গিবাদ কখনও মাথা তুলতে পারবে না। কিন্তু এর উল্টো উদাহরণও আমাদের হাতের কাছেই আছে। পাকিস্থান, আফগানিস্থান, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, দেশগুলো আমাদের চোখের সামনেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। ইরাকের ব্যবিলন সভ্যতা তো হাজার বছরেরও প্রাচীন ছিল। ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়া আরেক ট্র্যাজেডি হবে বাংলাদেশের জন্যও। সেই ক্ষেত্রে অনেকেই বলেন, এদের ধ্বংসের মূল হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব। অনেকেই আবার জঙ্গিদের কোন ধর্ম নেই বলে এক ধরণের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ধর্ম নেই বলে পাশ কাটিয়ে গিয়ে ৯০ ভাগ মুসলমানের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রের কাঠামো গঠিত হলে ধর্মের বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে উগ্রবাদী গোষ্ঠী। যারা বাঙালি জাতিসত্ত্বায় বিশ্বাস করে না। খিলাফতে বিশ্বাস করে। ব্যাখা বা অপব্যাখা হোক, জিহাদে বিশ্বাস করে।
প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত জঙ্গীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন, আর্থিক পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। ঠিক কতজন জঙ্গি এই পর্যন্ত ফিরে এসেছে জানি না।

পহেলা বৈশাখে নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে ৭ জনকে আটক করেছে পুলিশ। সিলেটের আতিয়া মহল, মৌলভীবাজার, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ সহ দেশের প্রতিটা অঞ্চলে বিস্তৃত জঙ্গিবাদের থাবা। একদিকে হেফাজত, ওলামী লীগ ঐক্যজোটের মতামতকে প্রাধান্য দিবেন, অন্যদিকে জঙ্গিবাদ নির্মূলে সর্বশক্তি প্রয়োগ করবেন। তাতে হবে না। বরং লাশের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হবে। যারা প্রাণ হারাচ্ছে, তারা দেশের নাগরিক, কারও না কারও আত্মীয়, ভাই, বন্ধু, সন্তান। জঙ্গির লাশের ভার মুক্তিযোদ্ধার রক্তে ভেজা মাটিকেই বইতে হচ্ছে। কাউকে বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে না।

১৯৭২ সালের ৭ জুনে দেয়া রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অংশটুকু আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই। বাংলাদেশ হবে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্ম নিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্ম নিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আল বদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না।

যতদিন পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে না, কোনভাবেই জঙ্গিবাদ রোধ করা সম্ভব হবে না।

জুয়েল রাজ, সম্পাদক, ব্রিকলেন; যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি, দৈনিক কালেরকন্ঠ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ