প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ১১ এপ্রিল, ২০১৭
ডিজিটাল বিশ্বের মানুষের আবেগ, মনোযোগ, আলোচনা, সমালোচনা এখন নিয়ন্ত্রণ করে ইন্টারনেট নামক বায়বীয় ব্যবস্থা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র প্রতিদিন প্রতি ঘন্টায় নির্ধারণ করে দিচ্ছে মানুষের মনোযোগ। বাংলাদেশ বা দেশের মানুষও তার বাইরে নয়। মানুষের আবেগ, অনুভূতি, দিনের মনোযোগ হয়ে গেছে মিডিয়া ভিত্তিক। মিডিয়াই যেন নির্ধারণ করে দিচ্ছে, আজকে মানুষ কোন বিষয় নিয়ে কথা বলবে।
জঙ্গি ইস্যু বাদ দিলে গত সপ্তাহ থেকে যদি একটু দেখি, সামাজিক মাধ্যম ও মিডিয়া ব্যস্ত ছিল মাশরাফির টি-টুয়েন্টি থেকে বিদায়, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর, তিস্তা চুক্তি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ও দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিয়ে। সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে নায়ক শাকিব খান ও নায়িকা অপু বিশ্বাসের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন।
ঠিক তিনদিন পরে বাংলা নববর্ষ। নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নিতে ব্যস্ত হয়ে যাবে আমাদের নাগরিক জীবন। ইতোমধ্যে সরকার ও প্রশাসন পহেলা বৈশাখ উদযাপনের যাবতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন।
অন্যদিকে, যাদের জন্য, যাদেরকে উপলক্ষ্য করে এই উৎসব, সেই খেটে খাওয়া মানুষের আনন্দ-বেদনা একান্তই উপেক্ষিত। গত এক সপ্তাহে অকাল বন্যায় একের পর এক ভেসে গেছে বৃহত্তর সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ সহ ভাঁটি অঞ্চলের বিশাল হাওরের ফসল। ভেসে যাওয়া ফসলের সাথে হাওর অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষের জীবনে যে চক্রবৃদ্ধি দুর্দশা নেমে এসেছে, তা গত সপ্তাহের যেকোন আলোচিত ঘটনার চেয়ে গভীর বেদনার। সেই গভীর বেদনাটুকু ছুঁয়ে দেখার অনুভূতি আমাদের নাগরিক জীবনকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করেনি। আমার মতো যারা কৃষক পরিবার থেকে এসেছেন কিংবা হাওর পাড়ে বেড়ে উঠেছেন, তাঁরা সেই বেদনাটুকু বুঝবেন।
বোরো ধানের এই ভেসে যাওয়া একটি কৃষক পরিবারের সারা বছরের হাড়ভাঙা খাটুনি আর স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা। ধান চাষের পরিকল্পনা ও চাষ চক্রের সাথে শুধু কৃষক নয়, একটি পরিবার জড়িয়ে থাকে পুরো বছর জুড়ে। বৈশাখ মাসে ধান ঘরে তুলে নিলেই কাজ শেষ হয়ে যায় না। বীজ প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ, গো খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ, বর্ষায় হালের বলদের যত্ন নেয়া, কার্তিক মাস এলেই আবার জমি তৈরি, ধানের চারা রোপণ- এসব কাজ সারা বছর জুড়েই আসলে চলতে থাকে। কতো সংস্কার, আচার পালন করে হাওরের মানুষ- হাওর বন্দনা, পীর-ফকিরের দোহাই দিয়ে মানত, পূজা অর্চনা করা হয়। নতুন ধানের ভিতরে যখন দুধ জন্মে, গর্ভবতী নারীর মতোই বাতাসে ফুলে-ফেঁপে ওঠে ধান গাছগুলো। আবার একটু যখন পাঁকে, সোনালী রঙ ধারণ করে। কৃষক প্রতিদিন জমিনে যায় দেখতে সেই ধান, হাত বোলায় পরম মমতায়, আসার সময় কয়েকটা শীষ বাড়িতে নিয়ে আসে, ছেলেমেয়েরা দাঁত দিয়ে খোলে ধান থেকে চাল বের করে, কতোটা শক্ত হলো পরীক্ষা করে। প্রথম যেদিন ধান কাটা হয়, সেদিনও কতো প্রস্তুতি থাকে। অঞ্চলভেদে হয়তো নানা রকম থাকতে পারে।
একদম প্রান্তিক কৃষক পরিবারে আমার জন্ম। ছোটবেলা গ্রামেই কেটেছে, তাই প্রতিটি বিষয়ের সাথে আমি পরিচিত। এই বোরো ধানের উপর নির্ভর করে প্রতিটা পরিবারের, ভরণ-পোষণ, ছেলেমেয়ের পড়ালেখা, বিয়ে, সামাজিক নানাবিধ আচার-অনুষ্ঠান-আনন্দ সব । এক বছর ধান না হওয়া একটি স্বনির্ভর কৃষক পরিবারে স্থায়ী দারিদ্রতা নিয়ে আসতে পারে।
গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান। তাও একটা নয় তিন তিনটা গোলা। শুধু নিজের গ্রামে নয়, আশেপাশের কয়েক গ্রামের মাঝেই ধনাঢ্য আমাদের পরিবার। দাদার আমল থেকেই ২০/৩০ জন লোক কাজ করত। এলাকায় বড়বাড়ি নামে এখনো চেনে লোকে। পৃথক হওয়ার পরেও সেই নাম-ডাক, জমি-জিরাত কোন পরিবারেই কমেনি। কিন্তু ৮৮, ৯০ এবং ৯১ সালে পরপর টানা কয়েক বছর এভাবেই অকাল বাণে ডুবে গিয়েছিল হাওর। জমি বিক্রি করে কাজের লোকের বেতন পরিশোধ করতে হয়েছে। জমি কেনারও লোক খুঁজে পাওয়া যায়না তখন, বলতে গেলে হাতে-পায়ে ধরে জমি বিক্রি করতে হয়। স্থানীয় পরিষদে রেশন আসে, এই পরিবারগুলো সেখানে লাইনে দাঁড়াতে পারেনা সম্মানের ভয়ে। গরু বিক্রি করে, বাড়ির গাছ বিক্রি করে, পুকুরের মাছ বিক্রি করে, জমি বন্ধক দিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা ঠিক রাখা, কখনো মহাজনের কাছ থেকে চক্রবৃদ্ধি সুদে টাকা ধার নিয়েও চলতে হয়েছে। দারিদ্রের দুষ্টচক্র গ্রাস করে ফেলে। এই কয়েক বছরে বাড়ির প্রতিটি পরিবারই কম-বেশি অভাবগ্রস্থ হয়ে পড়ে। কোন গল্প নয়, এটি চরম বাস্তবতা। আমি সেই ঘটনার বাস্তব স্বাক্ষী। প্রায় এক যুগ গেছে এই চক্র ভেদ করে বেরিয়ে আসতে।
বাংলাদেশের আজকের যে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা, তার মূল চালিকা শক্তি বাংলাদেশের কৃষি। প্রতি বছরই আমরা বাজেটে দেখি কৃষিখাতে সরকারি বরাদ্ধ বাড়ে, সার, বীজ, কিটনাশক কখনো স্বল্প মূল্যে কখনও বিনামূল্যে দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু বছর শেষে হাওর রক্ষা বাঁধ ভেঙে সারা বছরের সরকারি বরাদ্ধ ডুবে যায়। সেই সাথে ডুবিয়ে দিয়ে যায় কোটি মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন।
শুরুতে মিডিয়ার কথা উল্লেখ করেছিলাম। কারণ ফসল হারানো মানুষের বেদনাটুকু বোঝার চেষ্টা করুন। আপনাদের নাগরিক জীবনে হাওরের মানুষগুলো বেমানান। আপনার প্রোফাইল পিকচারে আইফেল টাওয়ার, লন্ডন ব্রীজ, সিরিয়া, ফিলিস্তিন জায়গা পাওয়ার আগে হাওরকে প্রাধান্য দিন। হ্যাশট্যাগ হাওর রক্ষা শুরু করুন। প্রতি বছর যেন হাওর রক্ষা বাঁধ না ভাঙে- এই নিশ্চয়তা আদায় করুন। পানি উন্নয়ন বোর্ড নামে একটা সরকারি তিমি আছে। এদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করার জন্য সরব হোন।
বাসন্তি রঙ শাড়ি, লাল পাঞ্জাবী পরে সেলফি দেয়ার আগে একবার চোখ বন্ধ করে একটা পরিবারের কথা ভাবুন- অনেকগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে মা বসে আছে। ঘরে এক মুঠো চাল নেই। বাবা গেছে চালের সন্ধানে কিন্তু পকেটে কোন টাকা নেই। রাত বাড়ছে কিন্তু বাবা ফিরছে না। মা অপেক্ষায়। বাচ্চাগুলো না খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে ...
সেই বেদনাটুকু রমনার বটমূলে, টিএসসিতে কিংবা ঝাঁকড়া চুলের বাউল গানে খুঁজে পাবেন না। এই মানুষগুলো ভিক্ষার হাত বাড়াতে পারে না, ফেইসবুকে ইভেন্ট খুলতে পারে না, হ্যাশট্যাগ বোঝে না। বছর জুড়ে হাড় ভাঙা খাটুনী আর গোলাভরা ধান বোঝে। হিরো আলম মিডিয়াতে বহাল তবিয়তে রাজত্ব করে। ঘামে ভেজা কৃষকের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য