প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ১২ জুন, ২০১৭
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে দীর্ঘদিন “ইসলাম ধর্ম”-কে রাজনীতিতে ব্যবহার করেছে; বাঙালির রক্ত-ঘাম-সম্ভ্রমের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের ষড়যন্ত্র বলে একটি ফেইক নিউজ প্রচার করেছে দীর্ঘকাল। এসবই ছিলো উগ্রজাতীয়তাবাদের চাষবাস করে শাসকগোষ্ঠীর নিয়মিত ঘৃণা চর্চার অপকৌশল; নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ইসলাম ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা হেফাজতের অঙ্গুলি হেলনে পাঠ্যপুস্তকের কট্টরিকরণ, হাইকোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়া; ধারাবাহিকভাবে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন-উচ্ছেদ; সর্বশেষ পার্বত্য চট্টগ্রামের লংদুতে আদিবাসীদের ওপর চালানো শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতনের ধুসর প্রেক্ষাপটে; আওয়ামী লীগের আদর্শিক ক্ষয় স্পষ্ট হয়ে উঠলে; সমুদয় অপকর্ম ধামাচাপা দিতে সেই পাকিস্তান মডেলে ক্রিকেট আফিমে বুঁদ করে দেয়া হয় তরুণ প্রজন্মকে।
ক্রিকেট যেহেতু তরুণদের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে; তাই "পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান বাংলাদেশ ক্রিকেট দল নিয়ে কটু মন্তব্য করেছেন"-এমন একটি ফেইক নিউজ একটি বাংলা ওয়েব পোর্টালে ছেড়ে দেয়া হয়। এই একই ওয়েব পোর্টালে সাম্প্রতিক সময়ে "ভাস্কর্য" ইস্যুতে হেফাজতের তোপের মুখে পড়া সুলতানা কামালকে নিয়েও ফেইক নিউজ প্রকাশিত হয়েছিলো।
দেশের কোন ফেইক নিউজ যাচাই করা একটু সময়সাধ্য হলেও; বিদেশের কোন ফেইক নিউজ যাচাই করা সহজ। গুগল সার্চ করলেই বোঝা যায় এটি ফেইক নিউজ। কিন্তু অনেক আপাত দৃষ্টিতে ইংরেজি জানা লোকজনকেও দেখা গেলো একটি ফেইক নিউজ ঘাড়ে করে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। আর যারা হেফাজতের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে নিন্দিত; তাদের জন্য পাকিস্তানের ইমরান খানকে নিয়ে রুটিন গালাগাল করে "দেশপ্রেমিক" হিসেবে লোকসমাজে ফিরে আসার অন্তিম সুযোগ। ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরবেই।
যেসব ক্রেডিবিলিটি সম্পন্ন মানুষ একটা ফেইক নিউজ যাচাই না করেই; একটা ছদ্ম উত্তেজনা সৃষ্টি করে কিছু লাইক কিছু দেশপ্রেম-এর কৃতিত্ব গ্রহণের লোভ সামলাতে পারলেন না; তাদের জন্য দুঃসংবাদ হচ্ছে; এরপর খুব প্রয়োজনীয় বিষয়ে অভিমত প্রকাশ করলেও পাঠক আর আস্থা রাখতে পারবে না তাদের ওপর। মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের মতো ক্রেডিবিলিটিহীন হয়ে পড়লেন তারা।
ফেইক নিউজের যুগে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত সমাজ ও রাষ্ট্রগুলো। কারণ সঠিক সংবাদ যাচাই করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা অনগ্রসর সমাজে থাকে না।
পাকিস্তানের অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত সমাজ তাদের শাসকগোষ্ঠীর ফেইক নিউজের আর ধর্মের আফিম খেয়ে আজ প্রায় মরণাপন্ন। নিজেদের অপরাধ ঢাকতে মিথ্যা প্রচারণা চালানো পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সন্তানাদি পশ্চিমের সেকেন্ড হোমে আরামে বসবাস করে; আর মিথ্যার ওপর গড়ে ওঠা অসভ্যতার আগুনে পুড়ে পাকিস্তান। অপরাধ অস্বীকার আর অপরাধের যৌক্তিকতা দিতে দিতে আজ পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকের কাছে সবচেয়ে ঘৃণার পাত্র শাসকগোষ্ঠী আর তাদের দলদাসেরা।
বাংলাদেশেও হুবহু পাকিস্তান মডেলের অপরাধপ্রবণ শাসকগোষ্ঠী সক্রিয়। সক্রিয় তাদের অপরাধ অস্বীকার ও অপরাধের যৌক্তিকতা দেয়া দলদাসেরা। হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এই "কলেরার দিনগুলোতে ভালবাসাবাসিতে" "মুক্তিযুদ্ধের চেতনার" মত পবিত্র শপথ আজ প্রায় বিলীয়মান। "রোজা রক্ষা কমিটি" নামে সামাজিক পুলিশ মাঠে নেমেছে খাবার হোটেল বন্ধ করতে; বাল্যবিবাহ আইনটি "বাস্তবতার প্রেক্ষিতে" প্রচলিত হওয়ায় ধর্ষণ ছড়িয়ে পড়েছে সংক্রামক ব্যাধির মতো। দুর্নীতি-লুণ্ঠন-মানবাধিকার লঙ্ঘনের কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে অপরাধ ধামাচাপা দিতে "ফেইক নিউজ"-এর আঁচল ধরে ইমরান খানের ওপর ঘৃণা উগরে দিয়ে; এটা কী প্রমাণ করা সম্ভব "পাকিস্তানের চেয়ে উৎকৃষ্ট" কোন রাজনীতি চর্চা চলছে বাংলাদেশে।
এখন "ইমরান খানকে" নিয়ে ফেইক নিউজ প্রচার ও তা নিয়ে অত্যন্ত উত্তপ্ত প্রতিক্রিয়া দিয়ে আজ না হয় কিছু ছদ্ম উত্তেজনা তৈরি করা গেলো; কিন্তু কাল যখন একই পদ্ধতিতে ভারতের সঙ্গে সম্ভাব্য ক্রিকেট ম্যাচ সামনে রেখে আরেকটি "ফেইকনিউজ" দিয়ে ছদ্ম উত্তেজনা সৃষ্টি করবে একই বা একই চরিত্রের হলুদ ওয়েব পোর্টাল; তখন সেই ফেইক নিউজকে নৈতিকতা দিয়ে মোকাবেলা করার নৈতিক সামর্থ্য হারিয়ে ফেললেন ইমরান খান বিষয়ক ফেইক নিউজে উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া জানানো ব্যক্তিবর্গ।
ফেইক নিউজকে শেয়ার না করা এবং ফেইক নিউজের সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করাই শিক্ষিত-সচেতন-অগ্রসর মানুষের সূচক। ফেইক নিউজ বিশ্বাস করা মানে "চাঁদে সাঈদীকে দেখা গেছে" এরকম গুজব বিশ্বাস করে তাতে প্রতিক্রিয়া জানানো। একটি জাতি সাংস্কৃতিকভাবে কতটা আলোকিত বা অন্ধকারে; তা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে গুজবপ্রিয়তা ও গুজব নির্ভর ফাঁপা জীবন যাপন করা না করার সক্ষমতার মাঝে।
পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী যেমন তাদের একটা জেনারেশনকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু করেছে, বাংলাদেশও কী সেই একই পথের পথিক হচ্ছে!
প্রকারান্তরে পাকিস্তানী প্রেতাত্মা বাংলাদেশ বহন করে চলেছে, নিজেদের অজান্তেই; কুরাজনীতি-গুজব-অপরাধ অস্বীকার প্রবণতা-অপরাধের যৌক্তিকতা দেয়া এবং গলাবাজি নির্ভর ঘৃণার চাষাবাদে নির্মম বাস্তবতা আড়াল করার প্রাত্যহিক জীবন চর্চায়।
এই অপসংস্কৃতি চর্চা বন্ধ করা জরুরি, এটা ভুল পথ, জাতির আত্মহননের পথ।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য