আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

মুক্তিযুদ্ধে নারী নির্যাতনে পাকিস্তানি মানস

সাব্বির হোসাইন  

বাঙালির জাতীয় জীবনে শ্রেষ্ঠ অর্জন হলো, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালির জন্য স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র 'বাংলাদেশের' প্রতিষ্ঠা করা। এই অর্জনের জন্য বাঙালিকে দিতে হয়েছিল ভয়ংকর মূল্য; ত্রিশ লক্ষ শহীদ, পাঁচ লক্ষ নারীর উপর পাশবিক নির্যাতন, এক কোটি শরণার্থী, বাংলাদেশের অবকাঠামোর চূড়ান্ত ধ্বংস।

যুদ্ধ মাত্রই মানবসভ্যতার জন্য অভিশাপ। যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি লাঞ্ছিত, নির্যাতিত,অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদের নারী ও শিশু।

যুদ্ধে নারী নির্যাতনের কারণ হিসেবে সাধারণত চার’টি কারণ চিহ্নিত করা যায়-

১. আগ্রাসী বাহিনীর লালসা চরিতার্থ করার প্রবণতা।
২. বিজিত জনপদের প্রতি তীব্র ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ।
৩. কোন প্রথার অনুসরণ বা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি।
৪. এবং বিজিত জাতিকে হেয় করার উদ্দেশ্য।

১৯৭১ সালে পাকিস্তান অধিকৃত বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হয়নি; বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসের পরতে পরতে আছে পাকিস্তানিদের দ্বারা নিপীড়িত লক্ষ লক্ষ বাঙালি নারীর অশ্রু, আর্তনাদ ও ভয়ংকরতম বিভৎসতার শিকার হওয়ার দুর্ভাগ্য। একাত্তরে অধিকৃত-বাংলাদেশের সর্বত্র পাকিস্তানি সৈন্য ও দালালরা সর্বত্র ভয়াবহ বর্বরতা চালিয়েছিল; প্রতিদিনই শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়সের নিরস্ত্র হাজার হাজার বাঙালিকে হত্যা করা হতো, যৌনদাসী হিসেবে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো নারীদের। এই নারীরা ধর্ষণ, অঙ্গহানি, বিভৎস উপায়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলো।

পাকিস্তান সামরিক বাহিনী, বিহারি ও দালালদের সংঘটিত এই নারকীয়তার শিকার হয়েছে কমপক্ষে পাঁচ লক্ষ নারী। এবং এই ভয়ংকর দানবীয় কাজটি পাকিস্তান সামরিক বাহিনী, বিহারী ও দালালরা মাত্র নয় মাসে সংঘটিত করেছে। অপরাধ সংঘটনের স্বল্প সময় ও ভিক্টিমের লক্ষাধিক সংখ্যা থেকে নারী নির্যাতনের এই ভয়ংকর ঘটনাবলীর ব্যাপকতা ও বিভৎসতা স্পষ্টতই বুঝতে পারা যায়। পাকিস্তানি, বিহারি ও দালালদের পাশবিকতা হতে শিশুকন্যা হতে বৃদ্ধা কেউ রেহাই পায়নি।

মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারী: শিল্পী হাশেম খান

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত হতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী অধিকৃত-বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান) বাঙালি গণহত্যা ও নারী নিপীড়ন শুরু করে; সূচনা হয় মানব ইতিহাসের অন্যতম চরম বেদনাদায়ক মানবিক বিপর্যয়। বাঙালির অপরাধ ছিল, তারা সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করেছিলেন। পাকিস্তান (তৎকালীন পশ্চিম-পাকিস্তান) বাঙালিদের অধস্তন হিসেবে গণ্য করতো এবং বাঙালি কাউকে শাসনক্ষমতায় দেখতে চায়নি। ফলশ্রুতি, সত্তরের নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে নির্বাচিত হলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি। বরং পাকিস্তানিরা বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখতে পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম একটি জাতিগত নির্যাতন ও ধোলাইয়ের পরিকল্পনা করেছিল এবং সে অনুসারে ২৫ মার্চ, ১৯৭১ রাত হতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী অধিকৃত বাংলাদেশে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর ভয়াবহতম গণহত্যা ও জাতিগত নির্যাতন এবং নারীর বিরুদ্ধে নৃশংসতম যুদ্ধাপরাধ।

এই প্রসঙ্গে ১৯৭১ সালের ২৭ মে দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত সংখ্যায় একটি প্রতিবেদনে বলা হয়:

“রাত বা দিনের যেকোন সময় গ্রামগুলো ঘিরে ফেলা হয়, ভীত গ্রামবাসী যেখানে পারছে পালিয়ে যাচ্ছে; যেখানে পাওয়া যাচ্ছে, তাদের হত্যা করা হচ্ছে। নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, মেয়েদের ব্যারাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, নিরীহ-নিরস্ত্র কৃষকদের নৃশংসভাবে প্রহার করা হচ্ছে, বেয়নেট চার্জ করা হচ্ছে।”

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিরুদ্ধে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সংঘটিত ভয়াবহ গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের স্বীকারোক্তি পাওয়া যায় পাকিস্তানি জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের কথায়; তিনি বলেছেন:

“.....সব দেশে মানুষ শেষ আশ্রয় হিসেবে সেনাবাহিনীর কাছে যায়। আর পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী দেখে মানুষ পালিয়ে গেছে।”

অধিকৃত-বাংলাদেশের সর্বত্র পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে বাঙালির বিরুদ্ধে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, সম্পত্তি বিনষ্ট ও লুটপাটের মত ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধ সংঘটন করেছিল। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী অধিকৃত-বাংলাদেশে তাদের দালালদের নিয়ে রাজাকার, আল-বদর, মুজাহিদ বাহিনী নামে কয়েকটি আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করে এবং পূর্ব-পাকিস্তানে বসবাসরত বিহারি জনগোষ্ঠী নিয়ে গঠন করা হয় আল-শামস নামে একটি আধা-সামরিক বাহিনী। দালাল ও বিহারিদের নিয়ে গঠিত এসব আধা-সামরিক বাহিনী পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সাথে সক্রিয়ভাবে বাঙালি গণহত্যা ও নারী নিপীড়নে অংশগ্রহণ করেছিল।

বীরাঙ্গনা ১৯৭১ : হামিদুর রহমান

পাকিস্তান সামরিক বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় (২৫ মার্চ, ১৯৭১ – ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১) অধিকৃত-বাংলাদেশের নারীদের উপর ভয়াবহতম অত্যাচার, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ অপরাধ করেছিল। এই নয় মাস মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত হয়েছিল এই জনপদ। গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন পাড়া-এলাকায় গিয়ে হঠাৎ আক্রমণ করতো পাকিস্তানি ও তাদের দালালরা; পুরুষদের গুলি, বেয়নেট চার্জ, কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করতো, শিশুদের দেয়ালে, মাটিতে আছড়ে মেরে, পা দু’দিকে টেনে চিরে দু’ভাগ করে হত্যা করতো, কিছু নারীদের ঘটনাস্থলেই ধর্ষণ করে হত্যা করা হতো, গণধর্ষণে অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাদের কাউকে কাউকে ছেড়ে দেয়া হতো, বাকিদের যৌনদাসী বন্দী করা হতো। যৌনদাসী হিসেবে এই বন্দী নারীরা মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। এইসব বন্দী নারীদের সাথে যতধরণের পাশবিকতা করা সম্ভব ছিল, তার সবটুকুই করেছিল পাকিস্তানিরা। মুক্তিযুদ্ধের সময় কমপক্ষে পাঁচ লক্ষ নারী পাকিস্তান সামরিক বাহিনী, বিহারী ও তাদের দালালদের হাতে নিপীড়িত হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সামরিক বাহিনী, বিহারি ও দালাল কর্তৃক বাঙালি নারীর উপর এই ধরণের ব্যাপক ও বিভৎস পাশবিক নির্যাতন চালানোর পিছনে তিনটি কারণকে চিহ্নিত করা যায়-

১. বাঙালি জাতির প্রতি তীব্র ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ এবং বাঙালি জাতিকে হেয় করার উদ্দেশ্যে।
২. সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি।
৩. লালসা চরিতার্থ করা।

বাঙালি জাতির প্রতি তীব্র ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ এবং বাঙালি জাতিকে হেয় করার উদ্দেশ্যে:

জিন্নাহ’র দ্বিজাতি তত্ত্বের মাধ্যমে ৪৭’এ ভারত উপমহাদেশে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়- ভারত ও পাকিস্তান। মাঝখানে ভারতকে রেখে পূর্ব-পশ্চিমে পাকিস্তানের দুটি বিচ্ছিন্ন অংশ, যা বর্তমানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু হতে পাকিস্তানিরা বাঙালীদের অধস্তন হিসেবে গণ্য করে এসেছে, সবজায়গায় বাঙালির অবস্থান দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মত। তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণী, বেসামরিক প্রশাসন, সামরিক প্রশাসন, সচিবালয়, বাজেট, রাষ্ট্র উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর দিকে নজর দিলে এটি স্পষ্ট যে, রাষ্ট্রের আচরণগত দিক হতে, বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। এছাড়া, রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গ, শিক্ষানীতি, সত্তরের নির্বাচনের মত ঘটনাগুলোর দিকে তাকালে পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে বাঙালির অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যায়। সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় তথা সবকিছুতেই পাকিস্তান বাঙালিদের হীন, নিচ জ্ঞান করতো। তৎকালীন পাকিস্তানে বাঙালির প্রতি ঘৃণার বিষয়টি লুকোচুরির কিছু ছিল না, এটি খুবই সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল যে, পাকিস্তান রাষ্ট্র বাঙালিদের ঘৃণা করে, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক ভাবে, পশ্চিম-পাকিস্তানিদের অধস্তন ভাবতো।

মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারী: শিল্পী হাশেম খান

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় অধিকৃত বাংলাদেশে বাঙালির বিরুদ্ধে পাকিস্তান কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের ব্যাপকতা ও বিভৎসতা হতে বাঙালির প্রতি পাকিস্তানিদের তীব্র জাতিগত ঘৃণা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে।

বাঙালি জাতির প্রতি ঘৃণা প্রকাশের একটি মাধ্যম হিসেবে ‘পরিকল্পিতভাবে’ মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিকে গণহত্যা ও বাঙালি নারীদের নির্যাতন করা হয়েছিল।

পাকিস্তানিদের এই ভয়ংকর পরিকল্পনার আঁচ করতে আমরা ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটিকে বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এম. আর. মজুমদারের দেয়া একটি সাক্ষাৎকারের একটি অংশ উল্লেখ করছি। জনাব মজুমদার জানাচ্ছেন, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বা ১৯৭১ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের একটি চিঠি পান, যাতে বলা হয়:

“নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের করে শেখ মুজিব ছয় দফা বাস্তবায়ন করলে পাকিস্তান আর্মিতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের আধিপত্য ক্ষুণ্ণ হবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হবে।.....তাই, পাকিস্তান আর্মি শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে দিতে পারে না।”

বাঙালিদের দাবিয়ে রাখতে পাকিস্তানিরা গণহত্যা ও গণধর্ষণের মত বড় এবং ভয়ংকর পরিকল্পনা করছে, তা সিদ্দিক সালিকের লেখা “Witness to Surrender” বইতে উল্লেখকৃত একটি ঘটনা থেকে বুঝা যায়। সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, একজন পাকিস্তানি জেনারেল গভর্নর হাউজে এসে বলেছিলেন:

“চিন্তা করবেন না, কৃষাঙ্গ বেজন্মাকে (বঙ্গবন্ধু) আমাদের (পশ্চিম-পাকিস্তান) শাসক হতে দেবো না”

বাঙালি জাতির প্রতি পাকিস্তানিদের তীব্র ঘৃণার বহিঃপ্রকাশের উদাহরণ হিসেবে অপারেশন সার্চলাইটের মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজার একটি মন্তব্য উল্লেখ করা যায়; ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখে তিনি জেনারেল নিয়াজীর উপস্থিতিতে বলেছিলেন:

“ম্যায় ইস হারামজাদে কওম কি নাসাল বদল দুঙ্গা, ইয়ে হামকো কেয়া সমঝতি হ্যায়” [আমি এই বেজন্মা জাতির (বাঙালি) চেহারা বদল করে দেবো, এরা (বাঙালিরা) আমাদের (পাকিস্তান) কি ভাবে?]

বাঙালিকে অবিশুদ্ধ ও নিচু জাত মনে করতো পাকিস্তানিরা; বাঙালির প্রতি তারা পোষণ করতো তীব্র ঘৃণা। ধর্ষণের মধ্য দিয়ে বাঙালি নারীদের গর্ভে পাকিস্তানি সন্তান জন্মদানের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে বিশুদ্ধ ও উন্নত করার বিকৃত চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় নিয়াজীর কন্ঠে:

"বাঙালির রক্তে পাঞ্জাবীর রক্ত মিশিয়ে তাদের জাত উন্নত করে দাও।"

দুই পাকিস্তানি সেনা অফিসার পরস্পরকে পাঠানো চিঠিতে ‘বাঙালি নারীদের ধর্ষণ ও এর মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে হেয় করার’ বিষয়টি নিয়ে লিখেছে:

“প্রিয় বন্ধু ইকরাম (সেনা অফিসার ইকরাম),
.....বাঙালি বাঘিনীদের পোষ মানাতে হবে, যেন তাদের মাধ্যমে সন্তান উৎপাদনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত (বিশুদ্ধ) প্রজন্মের জন্ম হবে, যারা প্রকৃত মুসলমান ও পাকিস্তানি হবে।.....
-মেজর আফজাল খান সাকিব”

সিলেটের সালুটিকরে পাকিস্তানি ক্যাম্পের দেয়ালে পাকিস্তানি সৈন্যদের আঁকা ছবি, যা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, বাঙালি জাতির প্রতি তীব্র ঘৃণা ও বাঙালি জাতিকে হেয় করার জন্য পাকিস্তানি সৈন্য ও দালালরা একাত্তরে বাঙালি নারী নির্যাতন করেছিল।

সিলেটের সালুটিকরে পাকিস্তানি ক্যাম্পের দেয়ালে পাকিস্তানি সৈন্যদের আঁকা ছবি। ছবি সংগ্রহ কৃতজ্ঞতা: আরিফ রহমান

বাঙালি জাতিকে জাতিগত ধোলাই তথা হেয় করার জন্য পাকিস্তানিরা চেয়েছিল যতবেশি সংখ্যক পারা যায় বাঙালি নারীর গর্ভে পাকিস্তানি ঔরসজাত সন্তানের জন্ম দেয়া। তাই দেখা যায়, সব বয়সের বাঙালি নারীদের পাকিস্তানিরা ধর্ষণ করলেও, তাদের মাঝে সন্তানধারণে সক্ষম বয়সের নারীরা বেশি; এরা অধিকাংশই গণধর্ষণ শিকার হয়েছে এবং যৌনদাসী হিসেবে বন্দী নারীদের মাঝে এদের সংখ্যায় বেশি।

ধর্ষিতার বয়স সম্পর্কে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্ট জানিয়েছে:

“.....পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্যাপক ধর্ষণ চালিয়েছে প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও কমবয়সী মেয়েদের উপর।”

বাঙালি জাতির প্রতি তীব্র ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ এবং বাঙালি জাতিকে হেয় করার হাতিয়ার হিসেবে পাকিস্তানিরা বাঙালি নারীদের ধর্ষণ করেছিল; এপ্রসঙ্গে বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রথম কানাডীয় রাষ্ট্রদূত জেমস বার্টেলম্যান তাঁর বই ‘On Six Continents: A Life in Canada’s Foreign Service 1966-2002’-এ লিখেছেন:

“পাকিস্তানের পরিকল্পিত বাঙালি দমননীতির কারণে হাজার হাজার বাঙালি নারী নির্যাতিত হয়েছেন, যেমনটি বসনিয়ায় সার্বরা করেছিল, যাতে নির্যাতিত নারী গর্ভধারণ করেন।”

পাকিস্তানি মেজর জেনারেল গোলাম ওমর বাঙালি জাতিকে ঘৃণা করা প্রসঙ্গে বলেছেন:

“বাঙালিদের আমরা হেয় চোখে দেখতাম...”

একই প্রসঙ্গে পাকিস্তানিদের সাবেক পরিকল্পনা কমিশন সচিব কামার-উল-ইসলাম বলেন:

“.....পশ্চিম পাকিস্তানরে যারা সেনাবাহিনীতে ছিল এবং সিভিল সার্ভিসে এসেছিল,তারাও পূর্ব পাকিস্তানকে খাটো করে দেখত। নিজেদের সুপিরিয়র ভাবত।”

মানুষ হিসেবে এই বিষয়টির উল্লেখ করা মানসিকভাবে কষ্টদায়ক বিষয় যে, একটি জাতিকে শোষণ করার জন্য, তাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও অবজ্ঞা পোষণ করার কারণে ওই জাতির প্রাপ্য অধিকারকে দাবিয়ে রাখার জন্য হাতিয়ার হিসেবে সেই জাতির গণহত্যা ও নারীদের গণধর্ষণ করা হয়; যেন জাতিটির জাতিগত সামষ্টিক মনস্তাত্ত্বিক দৃঢ়তা ভেঙে যায়। পাকিস্তান একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি জাতির সাথে ঠিক একই কাজটিই করেছিল।

বাঙালি জাতিকে শোষণ করার জন্য, বাঙালি জাতির মনস্তাত্ত্বিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেবার জন্য, হেয় করার জন্য বাঙালি জাতির প্রতি তীব্র ঘৃণা বহিঃপ্রকাশ হিসেবে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী, বিহারি ও দালালরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় নৃশংসতা, পাশবিকতা, বর্বরতার সাথে বাঙালি নারীদের নির্যাতন করেছিল; মানবইতিহাসে এমন ভয়ংকর ঘটনা খুবই কম আছে।

সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি:
পাকিস্তানিরা পূর্ব-পাকিস্তানকে অমুসলমানের দেশ ভাবতো। বাঙালি মুসলমানকে হিন্দুয়ানি আচার পালনকারী নিচু জাতের অবিশুদ্ধ মুসলমান ভাবতো পাকিস্তানীরা এবং বাঙালি হিন্দুদের মনে করতো ভারতের চর ও পাকিস্তানের আজন্মশত্রু।

পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে একাত্তরে ওরা বাংলাদেশে ধর্মযুদ্ধ করছিল, তাই তাদের কাছে এই অঞ্চলের অধিকৃত অংশের অমুসলিম নারীরা যুদ্ধলুট (War Booty)। যুদ্ধের সময় যুদ্ধলুট হিসেবে বন্দী হওয়া নারীদের সাথে তাদের অসম্মতিতে সঙ্গম মানে ধর্ষণ করা, তাদের যৌনদাসী হিসেবে বন্দী করে রাখাকে পাকিস্তানিরা বৈধ মনে করতো। এবং মুসলিম বাঙালিদের যেহেতু ওরা অবিশুদ্ধ মুসলমান ও ইসলামের শত্রু ভাবতো, তাই পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে এসব অবিশুদ্ধ মুসলমান বাঙালি নারীরাও যুদ্ধলুট, এদের ধর্ষণ করা বৈধ।

ভয়াবহ এই মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের পিছনে যুক্তি হিসেবে পাকিস্তানিরা ও তাদের দালালরা ধর্মকে যুক্তি হিসেবে দেখিয়েছিল; অর্থাৎ, এই ভারতীয় উপমহাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলমানদের রাষ্ট্র তথা পাকিস্তান সমুন্নত রাখার জন্য লড়াই, তথা ধর্মযুদ্ধ।

এই যুদ্ধের একপক্ষ পাকিস্তান নিজেদের ভাবতো ধর্মের জন্য লড়াইকারী তথা ধর্মযোদ্ধা আর প্রতিপক্ষ বাঙালি তাদের কাছে ছিল- হিন্দুয়ানি অমুসলিম শক্তি।

পাকিস্তানি ও তাদের দালালদের এই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ হিসেবে ৩১ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়’র উল্লেখ করা যায়:

“স্রষ্টা ও অখণ্ড পাকিস্তানের নামে পশ্চিম-পাকিস্তানি প্রাধান্যের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির উপর নির্মম সেনা আক্রমণ চালিয়েছে...”

পাকিস্তানি ও তাদের দালালদের এই মনস্তত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধী আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের লেখা একটি লেখায়, যা ১৯৭১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর জামাতে ইসলামীর মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রামের উপ-সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়েছিল:

"...এ আন্দোলন (মুক্তিযুদ্ধ) মুক্তির নয়। হিন্দুদের গোলাম বানাবার আন্দোলন এবং এখান থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের খতম করে এটাকে স্পেন বানাবার আন্দোলন।.....ইসলাম ও পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য পাক সেনাবাহিনীর সহযোগিতা করে যারা অপরাধ করেছে তাদেরকে যে তারা কোন অবস্থাতেই ক্ষমা করবে না এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা। সুতরাং বেঈমানদের হাতে ইসলাম ও পাকিস্তানের জন্যে মরতে হলে এভাবে মরার চাইতে আল্লার সৈনিক অর্থাৎ পবিত্র কোরআনের ভাষায় হিজবুল্লা হয়েই মরা সবচাইতে উত্তম।.....ইসলামের দাবীদার এদেশের লোকদের স্মরণ রাখতে হবে যে, যে কোনো কারণেই হোক তারা যদি এখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সরকার ও পাক সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগিতা করে এদেশকে রক্ষার জন্য প্রতিটি ঘরকে শত্রুদের বিরুদ্ধে দুর্ভেদ্য প্রাচীর হিসাবে গড়ে না তোলেন তা হলে যেমন বঙ্গোপসাগরেও তাদের স্থান হবে না, তেমনি কোরআনের উল্লেখিত নির্দেশ অনুযায়ী ইমানী দিক থেকেও তারা আশংকামুক্ত হতে পারবেন না।.....তাদের জিজ্ঞেস করতে চাই যে, তারা যেসব আশংকা করে বর্তমান সশস্ত্র দুশমন ও হিন্দুস্তানি অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছেন না, তাদের এ নীরবতা কি শেষ পর্যন্ত তাদের জান মালকে রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছে বা হচ্ছে?.....অনেকের প্রস্তাব ছিল, রাজাকার বাহিনীর হাতে রাইফেলের সাথে সাথে অন্যান্য ভারী অস্ত্র দেওয়া উচিত। সরকার সে প্রস্তাবেও সাড়া দিয়েছেন। রাজাকার বাহিনীর হাতে ভারী অস্ত্র-শস্ত্রও দেওয়া হয়েছে। এ দেশের খাঁটি পাকিস্তানী ইসলামপন্থী নাগরিকদের জন্যে এভাবে দেশ ও ইসলাম প্রীতির প্রমাণ দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের ও অমূল্য সুযোগের সামগ্রিকভাবে সদ-ব্যবহার করা উচিত।"

পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ইসলামের শত্রু মনে করতো; ভাবতো একাত্তরে ওরা অধিকৃত-বাংলাদেশে ধর্মযুদ্ধ করছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি পত্রিকা ‘ডন’-এ প্রকাশিত পাকিস্তানি কিছু বিজ্ঞাপনে।

ছবিসূত্র: 1971 'Jihad': Print ads from West Pakistan – Dawn - DEC 16, 2015.

একাত্তরে বাঙালি নারী নির্যাতনের কারণ হিসেবে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বক্তব্যেও উঠে এসেছিল। এপ্রসঙ্গে আমরা ডা. ডেভিসের অভিজ্ঞতা দেখতে পারি। একাত্তরে নির্যাতিত নারীদের চিকিৎসা সেবা দিতে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক ডা. জিওফ্রে ডেভিস বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি সে সময় বাংলাদেশে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বন্দী কিছু পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সাথে কথা বলেছিলেন; তারা এইরকম ব্যাপক ও বিভৎসভাবে বাঙালি নারী নির্যাতনের কারণ হিসেবে বলেছিল:

“আমাদের উপর টিক্কা খানের আদেশ ছিল- একজন ভালো মুসলমান শুধুমাত্র তার পিতার সাথে যুদ্ধ করবে না। তাই আমাদের করণীয় হচ্ছে, যত বেশী সম্ভব বাঙালী মেয়েদের গর্ভবতী করা যায়।”

পূর্বে উল্লেখিত পাকিস্তান বাহিনীর দুই সামরিক অফিসারের চিঠিতেও আমরা একই রকম কথা দেখেছি, সেখানেও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বাঙালি নারী ধর্ষণের উল্লেখ রয়েছে।

‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে’ পাকিস্তান ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই বলে বিবেচনা করতো এবং ভাবতো, তারা অধিকৃত-বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম রক্ষার স্বার্থে ধর্মযুদ্ধ করছে। পাকিস্তানিদের কাছে ‘ধর্মযুদ্ধে অধিকৃত-অঞ্চলের অমুসলিম নারীরা যুদ্ধলুট অর্থাৎ এদের ধর্ষণ করা বৈধ’। বাঙালি মুসলমানদেরও শুদ্ধ মুসলমান হিসেবে গণ্য করতো না পাকিস্তানিরা এবং ভাবতো এরাও ইসলামের শত্রু; তাই এদের নারীরাও যুদ্ধলুট। এটি সুস্পষ্ট যে, একাত্তরে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সময় অধিকৃত-বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী, বিহারি ও দালালরা ব্যাপক ও বিভৎস নারী নির্যাতন অপরাধ সংঘটন করেছিল; তার মূল একটি কারণ হলো- পাকিস্তানিদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি।

লালসা চরিতার্থ করা:
যুদ্ধ হলো একটি জনপদের সবচেয়ে অনিরাপদ সময়। এই সময়টিতে সুযোগসন্ধানীরা ব্যস্ত হয়ে যায় তাদের লালসা চরিতার্থ করতে। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তান তথা বাংলাদেশকে পশ্চিম-পাকিস্তান অধিকৃত করে। এই অধিকৃত-বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণের উপর সেই রাত হতে পরবর্তী নয় মাস তথা ২৬৭ দিন পাকিস্তান সামরিক বাহিনী, বিহারি ও দালালরা মানব ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা ও নারী নির্যাতন করেছে। বাঙালি জাতির উপর এই নির্যাতন করার তৃতীয় উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল- লালসা চরিতার্থ করা। পাকিস্তানি ও তাদের দালালরা অধিকৃত-বাংলাদেশের জিম্মি নিরীহ জনগণকে যতভাবে নির্যাতন করা সম্ভব ছিল, তার সবগুলো উপায়েই নির্যাতন করেছিল। অধিকৃত-বাংলাদেশের নারীদের উপর পাকিস্তানি ও তাদের দালালরা ব্যাপকতা ও বিভৎসতার সাথে তাদের লালসা চরিতার্থ করেছিল। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, শিশু থেকে বৃদ্ধা- সর্বশ্রেণী ও বয়সের নারী পাকিস্তানিদের লালসার শিকার হয়েছিল।

পাকিস্তানি বিগ্রেডিয়ার জেনারেল সিদ্দিকী তার ‘ইস্ট পাকিস্তান: দ্য এন্ড গেইম’ বইতে লে. জেনারেল নিয়াজীর একটি উক্তি উল্লেখ করেছেন, যাতে পাকিস্তানিদের লালসার শিকার হিসেবে বাঙালি নারী নির্যাতনের স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে:

“আপনি এরূপ আশা করতে পারেন না যে, সৈন্যরা থাকবে, যুদ্ধ করবে এবং মৃত্যুবরণ করবে পূর্ব-পাকিস্তানে আর যৌনচাহিদা নিবারণ করতে যাবে ঝিলামে।”

নিয়াজী পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান ছিল, অর্থাৎ অধিকৃত-বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও এর অনুগত বিহারি ও দালালদের নিয়ে গঠিত আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কার্যক্রম তার দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। যখন নিয়াজী নিজেই পাকিস্তানিদের লালসা চরিতার্থে বাঙালি নারী নির্যাতনকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করার চেষ্টা করে, তখন ৯০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ও ৬০ হাজার বিহারি ও দালালদের নিয়ে গঠিত আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তাদের লালসা চরিতার্থে অধিকৃত-বাংলাদেশের নারীদের উপর কি ভয়াবহ, বিভৎস, পাশবিক, নারকীয় নির্যাতন করেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে পাকিস্তান বাহিনীকে সহযোগিতা ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল শান্তি কমিটি; এটি অধিকৃত বাংলাদেশে একদম তৃণমূল পর্যায়ে গড়ে তোলা দালাল সংগঠন। বাঙালি গণহত্যা ও নারী নির্যাতনে পাকিস্তান বাহিনীর সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল শান্তি কমিটির সদস্যরা। এর প্রমাণ হিসেবে ১৯৭১ সালের ২৮ মে তারিখে লিখিত শান্তিকমিটির একজন সদস্যের চিঠির কথা বলা যেতে পারে; কীর্তিপাশার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আজহার মিয়াকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন ঝালকাঠির শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছলিমুদ্দিন মিয়া। চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধাদের 'শয়তান' ও স্বাধীনতাকামীদের 'ইন্ডিয়ান দালাল' হিসেবে সম্বোধন করা হয়, স্বাধীনতাকামীদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যেতে বলা হয়। চিঠিতে বাঙালি নারীকে 'মাল' বলে সম্বোধন করা হয় এবং পাকিস্তানি ও দালালদের লালসা চরিতার্থ করার জন্য ক্যাম্পে প্রতিদিন বাঙালি নারীদের ধরে আনার কথা বলা হয়।

ছবিসূত্র: মুক্তিযুদ্ধের ছিন্ন দলিল - মুনতাসীর মামুন

পাকিস্তানিরা ও তাদের দালালরা একাত্তরে বাঙালি গণহত্যা ও বাঙালি নারী নির্যাতন করার উদ্দেশ্য ছিল- যাতে জাতি হিসেবে বাঙালির মেরুদণ্ড ভেঙে যায়, যেন কখনো পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায় যেতে না পারে। বস্তুত: ভারত উপমহাদেশে মুসলমানের বাসভূমি হিসেবে সম-অধিকার নিয়ে বর্তমান ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তান’ নিয়ে ৪৭’এ ‘তৎকালীন পাকিস্তান’ রাষ্ট্রের জন্ম হলেও পাকিস্তানিরা বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক ও অধস্তন হিসেবে বিবেচনা করতো; আর তাই সত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় পাকিস্তানিরা মেনে নিতে পারেনি, তারা বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার বদলে বাঙালি জাতিকে চিরদিনের জন্য নিশ্চুপ করে দিতে চেয়েছিল; তাদের পরিকল্পনা ছিল ব্যাপক নির্যাতনের মাধ্যমে বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের স্পৃহা ও জাতি হিসেবে স্বাতন্ত্র্যবোধকে চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করা। তাই, পাকিস্তানিরা ‘বাঙালি সমস্যা’ চূড়ান্ত সমাধান হিসেবে বাঙালি জাতির উপর গণহত্যা ও ব্যাপক নারী নির্যাতনের চালানোর পরিকল্পনা করেছিল এবং তা সংঘটিত করেছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বক্তব্য থেকে বাঙালি নির্যাতনের পরিকল্পনার ইঙ্গিত পাওয়া যায় এবং পাকিস্তানি বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের বই ও বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত স্বীকারোক্তিতে একাত্তরে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী, বিহারি ও দালালদের দ্বারা বাঙালি গণহত্যা ও ব্যাপক নারী নির্যাতন সংঘটনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।

ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণা করে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা তৈরি করেছে এবং একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পাদনের জন্য বর্তমানে চলমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশানের উপস্থাপিত প্রমাণাদি হতে পাকিস্তানি ও তাদের দালালদের সংঘটিত বাঙালি গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের নারকীয় চেহারা, বিভৎসতা ও ব্যাপকতা স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারা যায়। বাস্তবতা হলো- বাঙালি জাতি নয় মাসের স্বল্প সময়ে স্বাধীনতা অর্জন করলেও, তার ত্যাগের পরিমাণ অনেক বেশি। পুরো বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল পাকিস্তানিরা; ত্রিশ লক্ষের অধিক বাঙালিকে হত্যা করেছিল, কম করে পাঁচ লক্ষ বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করেছিল, পুরো দেশের অবকাঠামো ও এই জনপদের স্বাভাবিকত্ব ধ্বংস করেছিল। নারীর বিরুদ্ধে মানবইতিহাসের জঘন্যতম নৃশংসতার নজির পাকিস্তানিরা সংঘটন করেছিল বাঙালি নারীর উপর। বর্তমানে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার হচ্ছে, ইতোমধ্যে কিছু রায়ও কার্যকর হয়েছে। পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার কথা উঠেছে এবং প্রক্রিয়া চলছে। একাত্তরে পাকিস্তানি ও তাদের দালালরা বাঙালি জাতির উপর যে ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছিল, গণহত্যা ও ব্যাপক নারী নির্যাতন করেছিল, তার বিচার হতেই হবে; যদি তা না হয়, তবে তা হবে- মানবতার পরাজয়।

তথ্য সহায়িকা:

  • Nine Months to Freedom – The Story of Bangladesh (1972) – Documentary.
  • একাত্তরের যুদ্ধশিশু – অবিদিত ইতিহাস – বই।
  • আমি বীরাঙ্গনা বলছি – নীলিমা ইব্রাহিম – বই।
  • যুদ্ধ ও নারী – ডা. এম. এ. হাসান – বই।
  • একাত্তরের গণহত্যা, নির্যাতন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার – শাহরিয়ার কবির – বই।
  • আমরা যুদ্ধশিশু – সুরমা জাহিদ – বই।
  • প্রসঙ্গ: ১৯৭১; মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ – ডা. এম. এ. হাসান – বই।
  • বীরাঙ্গনা কথা – অপূর্ব শর্মা - বই।
  • বীরাঙ্গনা ১৯৭১ - মুনতাসীর মামুন - বই।
  • যুদ্ধাপরাধী মুজাহিদের বিচার: রায়ের পূর্ণ বিবরণ – ফরিদ আহমেদ, দেব প্রসাদ দেবু, সাব্বির হোসাইন – অনুবাদ বই।
  • এই সংগ্রামে আমিও আদিবাসী বীরাঙ্গনা – সুরমা জাহিদ - বই।
  • মুক্তিযুদ্ধের ছিন্ন দলিল - মুনতাসীর মামুন - বই।
  • ত্রিশ লক্ষ শহিদ বাহুল্য নাকি বাস্তবতা - আরিফ রহমান - বই।
  • সেই সব পাকিস্তানী – মুনতাসীর মামুন – বই।
  • পাকিস্তানীদের দৃষ্টিতে একাত্তর – মুনতাসীর মামুন – বই।
  • We Owe an apology to Bangladesh – Edited by Ahmed Salim – Book.
  • 1971 'Jihad': Print ads from West Pakistan – Dawn - DEC 16, 2015 – Newspaper.
  • বহির্বিশ্বে গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – সুরমা জাহিদ - বই।
  • ১৯৭১: গণহত্যা ও নির্যাতন - মুনতাসীর মামুন - বই।

সাব্বির হোসাইন, প্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ