প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ১৪ জুলাই, ২০১৭
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে পত্রিকায় অভিমত কলাম লেখার অভিযোগে বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়া হয়েছে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে আরেকজন শিক্ষক বিতর্কিত ৫৭ ধারায় মামলা করেছেন। এই দুটি ঘটনা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটতে পারে; এটা কল্পনাতীত।
বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটি যে প্রশস্ত চিন্তা বিকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত; তা থেকে এই দুটি ঘটনা একেবারেই পেছন দিকে সংকীর্ণ পথে হাঁটা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মুক্তচিন্তার চর্চা করবেন; বা যে কোন মতবিরোধের সমাধান করবেন সংলাপের মাধ্যমে; এটা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতির একেবারেই গোড়ার কথা।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা এই পেশাটিকে বেছে নেন মুক্তভাবনা চর্চার লক্ষ্যে। যুগের পর যুগ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা পত্রিকায় অভিমত কলাম লিখছেন। কিন্তু একটি কলাম লেখার অপরাধে কোন শিক্ষককে বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়ার ঘটনা স্মরণকালের ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। শিক্ষক যদি মুক্তভাবে তার মতামত প্রকাশ করতে না পারেন; তবে সে বিশ্ববিদ্যালয় অচলায়তনে পরিণত হয়।
অভিমত কলামের জবাব অভিমত কলামের মাধ্যমে দেয়ার শিক্ষা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেবার কথা; সেখানে অভিমত কলামের জবাবে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোটা একে কারাগারে পরিণত করে।
যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকার নেই; ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ছাত্র-ছাত্রীরা হাতপায়ে অদৃশ্য শেকল বাঁধা শিক্ষকের কাছে কিছু তো শিখতেই পারবে না; বরং ছাত্র-ছাত্রীদের মনোজগতে সেই নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের ভীতি, সেলফ সেন্সরশিপ এমনভাবে ঢুকে পড়বে যে প্রতিদিন তাদের হাত- পা জড়িয়ে যাবে অদৃশ্য শেকলে।
আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি ক্লোজড গ্রুপে একজন শিক্ষক আরেকজন শিক্ষকের সমালোচনা করায়; সেইসব স্ক্রিনশট থানায় জমা দিয়ে ৫৭ ধারায় অভিযোগ দায়ের-এর ঘটনা শুধু বালখিল্য আচরণই নয়; এতে মনোবৈকল্যের লক্ষণও উপস্থিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একজন শিক্ষক আরেকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে কালো ৫৭ ধারায় অভিযোগ দায়ের করেছে; এই খবরটি পৃথিবীর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছে স্বাভাবিক খবর বলে মনে হবে না।
বিশ্ববিদ্যালয় সংলাপের আদর্শ কেন্দ্র; মানব-সভ্যতাকে যে কোন সংকট সমাধানে সংলাপের শিক্ষাটা বিশ্ববিদ্যালয়ই দেয়। সেখানে সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক কালো ৫৭ ধারায় মামলা করলে বিস্মিত হতে হয়; এরকম শিক্ষক মত-প্রকাশের স্বাধীনতার শিক্ষা তার হবু সাংবাদিক ছাত্রদের কীভাবে দেবেন! এরকম সাংস্কৃতিক মনোজগত নিয়ে একজন শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা শিক্ষা দিয়ে চলেছেন; এটি বিস্ময়কর ব্যাপার।
সামগ্রিকভাবেই আজকের সমাজে অস্থিরতা বেড়েছে; মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে; সাংস্কৃতিক মানের অবনতি ঘটেছে; তার অভিঘাত বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পড়াটাও অস্বাভাবিক নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত শিক্ষক মনীষী হুমায়ুন আজাদ আশংকা করেছিলেন, একদিন হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা রমনা থানার দারোগা হতে চাইবেন। তার আশংকা সত্যি হয়েছে; বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই থানা খুলে দারোগাগিরি করার চেষ্টা কিছু শিক্ষক যে করছেন; তা দৃশ্যত স্পষ্ট।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগে অন্তত দুজন অগ্রসর চিন্তার শিক্ষককে অপসারণের ষড়যন্ত্র চোখে পড়েছিলো। তাদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও "অশ্লীল" শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারের আজগুবি অভিযোগ আনা হয়েছিলো। আরেকজন প্রবীণ শিক্ষকের বিরুদ্ধে পরীক্ষার ফলাফল দেরিতে জমা দেবার কথিত অভিযোগ উত্থাপন করে খবর পত্রিকায় ছাপিয়ে তাকে অপদস্থ করার হীনচেষ্টাও চোখে পড়েছে।
যারা এইসব ভিলেজ পলিটিক্স করতে চান; তারা শিক্ষকতা না করে গ্রামে গিয়ে পঞ্চায়েত প্রধান হয়ে ফতোয়া ও দোররা মারার কাজগুলো করলেই পারেন। একজন শিক্ষককে অভিমত কলাম লেখার অভিযোগে যারা তাকে বাধ্যতামূলক ছুটি দ্রুততার সঙ্গে দিয়েছেন; তাদেরও পেশাচয়ন ভুল হয়েছে। এরা সামরিক ও বেসামরিক আমলা হলে প্রতিদিনই বাধ্যতামূলক ছুটি দেবার উদগ্র বাসনা পূরণ করতে পারতেন। আর যে শিক্ষক আরেকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করেছেন; উনি গ্রামে ফিরে গিয়ে মামলাবাজির পেশায় ফিরে যেতে পারেন। পার্টির মাস্তান হবার আগ্রহ কারো থাকলে সরাসরি মাস্তান হিসেবেই আবির্ভূত হওয়া উচিত; শিক্ষক পরিচয়ের আড়ালে মাস্তান আত্মপরিচয় লালন করে তো লাভ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক তার বিরুদ্ধে কোন অভিমত কলাম লিখলে কোন শিক্ষককে বাধ্যতামূলক ছুটি দেবেন না; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উনার সমালোচনা করলে ৫৭ ধারায় মামলা করার কথা উনার কল্পনাতেও আসবে না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বজনীন সংস্কৃতিই হচ্ছে মুক্তভাবনার চর্চা। ভাবতে অবাক লাগে উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকত্বে থাকার সময় কী করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এতো আদিম-অনগ্রসর কালোচর্চা কিছু শিক্ষক করে যেতে পারেন।
আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের শ্রদ্ধাভাজন অনেক শিক্ষকের দূরদর্শিতার অভাবে কিছু অযোগ্য মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। আমাদের সৌভাগ্য আমাদের অনেক শিক্ষকের দূরদর্শিতার কারণে কিছু যোগ্য মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। এই যোগ্য মানুষেরা অযোগ্য মানুষদের হিংস্রতার শিকার হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যোগ্য মানুষ শূন্য করার কালো সক্রিয়তা দৃশ্যমান।
সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অযোগ্য শিক্ষকদের ভিলেজ-পলিটিক্সে বিশ্বের বিদ্যা যেন লয় প্রাপ্ত না হয়; সে বিষয়ে এক্ষুণি সচেতন হতে হবে। ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে অশুভ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে। শুভকে বাঁচাতে হবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য