প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আলমগীর নিষাদ | ২০ জুলাই, ২০১৭
আল মাহমুদের চোখের সামনে প্রথম মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে। কিন্তু ইসলাম বলতে তিনি চোখের সামনে জামায়াত-এর ইসলামকে দেখতে পান। এটা বাঙালি মুসলমানের জন্য একটা বড় ট্রাজেডি। চল্লিশ বছর পর ঠিক একই গোমরাহি ঘটে ফরহাদ মজহারের ক্ষেত্রে। তিনিও বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ধরতে গিয়ে জামায়াতে ইসলামীর রাষ্ট্রপ্রকল্পে আটকা পড়েন।
আল মাহমুদ যদি সুফি অথবা দেওবন্দি ওরফে কওমি মাদরাসাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সমাজের ইসলামকেও গ্রহণ করতেন তাহলে হয়তো বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলাম প্রশ্নের এই জটিলতা ও ফাঁদ তৈরি হতো না। বহু আগে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, 'নীল নদের পানি যেমন নীল নয়, জামায়াতে ইসলামও ইসলাম নয়।' কিন্তু আল মাহমুদের সেই আমল ছিল না। তিনি রাজনৈতিকভাবে অশিক্ষিতই ছিলেন। ফলে আল মাহমুদের নবুয়াতপ্রাপ্তির পরে ইসলাম প্রশ্ন এদেশে খোলাসা হয় না, আরও ঘোলাটে হয়। এর ধারাবাহিকতা থেকে কিনা জানি না, বাঙালি মুসলমানের রাষ্ট্রপ্রকল্পের সাধনায় ফরহাদ মজহারকেও জামায়াতের রাষ্ট্রবীক্ষণকে গ্রহণ করতে দেখা যায়। আল মাহমুদের ইসলাম ছিল সরাসরি জামায়াত-এর ইসলাম। আর ফরহাদ মজহারের জামায়াত-এর ইসলামগ্রহণ হলো রাজনৈতিক প্রকল্পগত ঐক্যের।
এ ভূখণ্ডে ফরহাদ মজহার এবং সলিমুল্লাহ খান মডার্ন জার্নি থেকে আসা প্রথম জুটি, যারা সচেতনভাবে ইসলামের মুখোমুখি হওয়ার রাজনৈতিক তাগিদ অনুভব করেন। তারা ঔপনিবেশিক সেকুলার সমাজের সাথে বাংলাদেশের জাতীয় সমাজের দ্বন্দ্বের রাজনৈতিক পাঠনির্মাণকে অনেকদূর এগিয়ে দেন। পরবর্তী ঘটনা, সলিমুল্লাহ খান ইসলাম আবিষ্কার করেও জাতীয় চেতনা বিসর্জন দিতে রাজি হন নাই, কিন্তু ফরহাদ মজহার জাতীয় চেতনার সেকুলার লম্ফন দেখে মুক্তিযুদ্ধকেও বর্জন করতে রাজি হন। যে কারণে দেওবন্দ-পছন্দ ফরহাদ মজহারও আল মাহমুদের গরল থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারেন নাই। তিনিও আল মাহমুদের মতো বাংলাদেশকে জামায়াত-এর ‘ইসলামে’র ভুবনেই এগিয়ে দেন।
জামায়াত নির্মূল ও বিএনপি দমন করে ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা হিসেবে ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ প্রমোট করে। জবাবে জামায়াত-বিএনপিও গণজাগরণ মঞ্চকে ইসলামবিদ্বেষীদের উত্থান হিসাবে প্রমাণের প্রকল্প হাতে নেয়। ঔপনিবেশিক সেকুলার সমাজের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জাতীয় সমাজের স্পিরিটকে কাজে লাগিয়ে তারা হেফাজতে ইসলামকে এর মুখোমুখি দাঁড় করায়। আমারদেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ছিলেন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মহাপরিচালক, ফরহাদ মজহার ছিলেন এর অধস্তন অংশীদার। এদেশে ফরহাদ মজহারের সর্বশেষ ঐতিহাসিক ভূমিকা হলো- হেফাজতে ইসলামকে জামায়াতে ইসলামীর ঘরে ঢুকানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা।
২.
এসব সংকটের শুরু একাত্তরে। ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার কারণে ইসলামপন্থী রাজনীতি এদেশে দারুণভাবে নৈতিক বৈধতা হারায়। পরবর্তীকালে ইসলামি সমাজের নেতারাও জামায়াতের সঙ্গে তাদের ব্যবধানকে স্পষ্ট করতে সচেষ্ট হয়নি। বরং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ইসলামি চেতনার দূরত্বকে তারা নানাভাবে উৎসাহিত করেছে। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ‘ভূমিকা’ই এদেশের ইসলামি সমাজের রাজনৈতিক অভিমত হিসাবে ফিক্সটড হয়ে যায়। এটাই বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতির ঐতিহাসিক সংকট। ফলে মুক্তিযুদ্ধের ভিতরের সেকুলার প্রবণতা সমূহ পরবর্তীকালে এর প্রধান উপাচার হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের চেহারা দেখতে হয়ে পড়ে একমাত্রার, সেকুলার প্রকল্প।
দ্বিতীয়ত সংকটটি হলো, মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের সমাজকাঠামো পুনর্গঠনে সফল হয়নি। স্বাধীনতার পরেও পুরোনো সমাজ বলবত থাকে। কারণ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক অনুশীলনের ঘাটতির কথা বলেছেন অনেকে।
আহমদ ছফা বলেছেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পায়ে হেঁটে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিয়েছিল।‘ সলিমুল্লাহ খান এর নাম দিয়েছেন ‘বেহাত বিপ্লব’। অর্থাৎ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতার আগেই বেহাত হয়ে যায়। কেবল ক্ষমতার হাত বদল হয়; ব্যুরোক্র্যাসি ও ক্ষমতা বিন্যাসের কোনো পরিবর্তন হয় না। উপরন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শাসক সম্প্রদায়ের ক্ষমতার দর্শন হয়। মুক্তিযুদ্ধ হয়ে ওঠে শহুরে আর্ট-কালচারের উপাদান।
এসব সংকটের সুবিধা পুরোমাত্রায় গ্রহণ করে জামায়াত। মুক্তিযুদ্ধের সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতার ফোঁকর দিয়ে ইসলামি রাজনীতির পতাকা নিয়ে তারা আবার নিজেদের সংগঠিত করে।
মুক্তিযুদ্ধের সাথে ইসলামি রাজনীতির আজকের যে দূরত্ব, বাংলাদেশকে এমন পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে জামায়াতে ইসলামী। একাত্তরের পরাজিত জামায়াত লেজকাটা শেয়ালের মতোই বাঙালি মুসলমানের মহা সিন্ধুর কল্লোলিত রাষ্ট্রবাসনার লেজ কেটে দেয়। ফলে অসতর্ক হলে আমরা পরিণত হয়েছি জামায়াতের গর্দভ শিকারে।
গত পঁয়তাল্লিশ বছরে এদেশে ইসলামি দর্শন চর্চাকারীদের বড় অংশই এই ফাঁদে পতিত হয়েছেন। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য- আমাদের প্রধান কবি আল মাহমুদ আর প্রধান বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার, দুজনেই শেষ কর্মযোগে জামায়াতে ইসলামীর পারপাস সার্ভ করেছেন।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য