প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রাজেশ পাল | ০৮ আগস্ট, ২০১৭
আজ খুব দুঃখ আর বেদনাক্রান্ত মন নিয়ে লিখতে বসলাম দুলাইন। কেউ হয়তো রাগে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে, কেউ হয়তো পাত্তাই দেবেনা। তবু কিছু "অরণ্যে রোদন" আজ করছি বিবেকের তাগিদেই। কারণ আজ থেকে প্রায় ১০ টি বছর আগে আমি ছিলাম এই সংগঠনের একজন জানবাজ কর্মী। বড় বেশী ভালোবাসার সংগঠন ছিল আমার, আছে আজও।
উপদেশ দিচ্ছিনা, দেয়ার মতো যোগ্যতাও আমার নেই, শুধু এক অগ্রজ হিসেবে অনুজদের সাথে দুটি মনের কথাই শেয়ার করছি মাত্র। আর আমার এখন আর কোন প্রকার দলীয় পদ নেই, তাই নেই বহিষ্কারের ভয়ও। হয়তো সেই কারণেই দুটো কথা বলার সৎ-সাহসটুকু দেখাচ্ছি।
ছবিতে যার রক্তাক্ত শরীরটা দেখতে পাচ্ছ, সেও তোমার আমার আরেক ভাই, সহযোদ্ধা। সোমবার সিলেটে শামীম আর আসিফ নামে আমাদের এই দুই ভাইকে কুপিয়ে হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়েছে ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা "নারায়ে তাকবীর" স্লোগান দিয়ে। এই মূহুর্তে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে তারা।
কিন্তু অনলাইনে শুনশান নীরবতা। নেই কোন প্রতিবাদ। বরং মনে মনে আনন্দিতও কেউ কেউ। আর এর জন্য দায়ী তোমাদেরই একটি অংশ, যেটির কারণে প্রতিনিয়ত সংবাদ শিরোনাম হতে হয় পুরো সংগঠনটিকে। রোববার বিশ্বজিতের রক্তাক্ত ভাইরাল ছবিতে ভরপুর নিউজফিড দেখার পরে তোমাদের ভাইদের রক্তাক্ত ছবি দেখে যদি অনুকম্পা না জাগে অন্যদের মনে, তার জন্য তাদের কি খুব বেশী অভিযুক্ত করতে পারবে তোমরা?
ছাত্রলীগ আর ছাত্রদল এই দুটি সংগঠনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, এদের মাদার সংগঠনগুলো যখনই রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তখনই ব্যাপকহারে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঘটে যে দেশের জনসংখ্যাও সম্ভবত সে হারে বাড়ে না।
মতাদর্শ নয়, কেবলমাত্র কালনিমির লংকাভাগের জন্যই এদের আগমন। এরা জোয়ারের মতোই আসে, আর ভাটার মতোই হারিয়ে যায়। দুঃসময়ে এদের আর খুঁজে পাওয়া যায়না। আর খুঁজে পেলেও দেখা যায়, তারা তখন প্রতিপক্ষ দলের বিশাল বিশাল কেউকেটা হয়ে বসে গেছে ততদিনে। অথচ একদিন তোমাদের সাথে থেকেই অপকর্মের পরে অপকর্ম করে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে সংগঠনের মান সম্মান। আর তোমাদের মাঝে যারা "নির্বোধ" আছো এখনো, "সুবোধ"-দের দাপটের কাছে তোমরা তখন নিতান্তই অসহায়।
আমার স্কুল জীবনে আমাদের পাড়ায় ছাত্রলীগের দুটি অংশ সক্রিয় ছিল। একটি "জাতীয় ছাত্রলীগ" অপরটি "বাংলাদেশ ছাত্রলীগ", পরে তারা একীভূত হয়ে যায়। সেসময় পাড়ার বড় ভাইদের দেখতাম কর্মী সংগ্রহ, রাত জেগে পোস্টার লেখা আর দেয়ালে দেয়ালে সাঁটিয়ে দেয়ার সেকি আগ্রহ! শিশু মনে অবাক বিস্ময়ে কান পেতে শুনতাম তাঁদের গগনবিদারী স্লোগান।
এরশাদের পতনের পরে দেখেছি তাদের জয়োল্লাস পিতার সাথে ঘুরে ঘুরে। কলেজ জীবন থেকেই পুরোপুরি সক্রিয় হই সংগঠনে। কিন্তু পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরে। তখন লীগ সরকারের বিদায় হয়েছে। শত শত ছাত্রলীগ কর্মী কোথায় যেন হারিয়ে গেলো মূহুর্তেই। তখন সবে আইন বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম। কিন্তু সেসময়ও সুবোধদের পাশাপাশি কিছু নির্বোধ জুটে গিয়েছিলো কেমন করে যেন!
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অবরোধ করেছি, মিছিল করেছি, স্লোগান তুলে আকাশ কাঁপিয়েছি, ট্রেন বাস আটকে দিয়েছি, সংঘর্ষ করেছি, কেউ কেউ হাতিয়ারও ধরেছি। কিন্তু এই অভিযোগ কেউ করতে পারেনি যে মামুর দোকানে ফাউ খেয়ে বিল দিইনি বা সিগারেট কিনে দাম দিইনি বা চাঁদাবাজি করে বিলাসবহুল লাইফ লিড করেছি। কেন্দ্রীয় নেতারা পর্যন্ত প্রশংসা করতেন আমাদের ইউনিটটির।
আর আজ যখন প্রতিনিয়ত নিউজ হেডলাইন হতে দেখি ছাত্রলীগকে বিভিন্ন চরম বিতর্কিত ইস্যুতে, তখন আসলেই বুক ফেটে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। আপন মনে প্রশ্ন জাগে, এইকি আমাদের ফেলে আসা প্রথম যৌবনের ভালোবাসার ছাত্রলীগ?
এবারের সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার পরে যেদিন শুনতে পাই শিবিরের দুর্গ ছবিতে শিবিরের কমিটি নেই! সেদিনই কেন জানি খটকা লাগে। এতোগুলো শিবির তাহলে কি হাওয়া হয়ে গেলো রাতারাতি? উত্তর পেলাম মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে আমার স্নেহের ছোট ভাই দিয়াজের মৃত্যু সংবাদের মধ্য দিয়ে। বুঝতে পারলাম, শিবির মোটেই হাওয়া হয়নি, স্রেফ ছাত্রলীগ হয়ে গেছে। আর ছাত্রলীগ সেজেই মেতে উঠেছে ছাত্রলীগের অর্ধশতাব্দী ধরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা সকল অর্জন ধুলোয় মিশিয়ে দেয়ার প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে। যেমনটি ঘটেছিল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ক্ষেত্রেও। আর শুধু চবি নয়, সারা দেশের প্রতিটি ইউনিটেই আজ "হাইব্রিড"-দের জয়জয়কার। "বাইবর্ন"-রা উপেক্ষিত শূদ্র মাত্র।
শুরু করেছিলাম সিলেটে দুইজনের হাতপায়ের রগ কাটার পরে অস্বাভাবিক নীরবতা নিয়ে। কিন্তু এতো নতুন কিছু নয়। ছাত্রলীগের কর্মী হওয়াটা যে সুশীল জ্ঞানী গুণীদের চোখে ছাত্রশিবিরের কর্মী হওয়ার চেয়েও বড় অপরাধ। এই সংগঠনের ১৭ হাজার কর্মী যে জীবন দিয়েছেন একাত্তরের সম্মুখ সমরে, এরাই যে গড়ে তুলেছিলেন "স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস" যা প্রথম দাবী তুলেছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের, তার কোন মূল্য নেই এনাদের কাছে। মূল্য নেই স্বাধীনতার পর হতে আজ পর্যন্ত খুন হয়ে যাওয়া বকুল, আইয়ুব, তবারক, এনাম, মনসুর, শহীদ, আলী মর্তুজা চৌধুরীর মতে হাজার হাজার কর্মীর জীবনেরও।
কারণ, "ওরা যে ছাত্রলীগ"! "ব্রাহ্মণ সমাজে অচ্ছুৎ শূদ্রের দল"; আর দলের কেন্দ্র থেকেই যখন "নদভী, রিজিয়ারা" জায়েজ হয়ে যায়, বঙ্গবন্ধুর সরাসরি বিরোধীরাও হয়ে বসেন বিশাল বিশাল কেউকেটা, তখন আর দুঃখ করার মতোও তেমন কিছুই থাকেনা। এভাবেই আরও "বাইবর্ন"দের হাতপায়ের রগ কাটা পড়তে থাকবে, আর সুশীল প্লাস হাইব্রিডরা আনন্দের সাথে টেনে ফেলবেন দু-পেগ বেশী। আর "বর্ন এনিমিরা" সুযোগ বুঝে হেনে যাবে করাল ছোবল।
আর এভাবেই একদিন হারিয়ে যাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার "লাস্ট লাইন অফ ডিফেন্স"; ফলাফল সকলেরই জানা!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য