সনেট দেব চৌধুরী, শ্রীমঙ্গল সংবাদদাতা

১৯ জানুয়ারি, ২০১৫ ১০:০৯

হারিয়ে যাওয়া লোকজ সংস্কৃতির খোজে রামকৃষ্ণ সরকার

গীতি কবিতা সংগ্রহের কাজ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে করে যাচ্ছেন শ্রীমঙ্গলের রামকৃষ্ণ সরকার

‘হিরার ময়না পাখিরে আমার সোনার ময়না পাখি, আমি ডাকি বন্ধু বন্ধু শুইয়া রইছ নাকি’ গুন গুন করে এই গানটি গেয়ে ছুটে চলা শহর থেকে গ্রাম গঞ্জে। ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তবুও ছুটে চলা শেষ হয়না গ্রাম্য মেঠো পথে রামকৃষ্ণ সরকারের। লক্ষ্য একটাই সিলেট অঞ্চলে লোকজ সংস্কৃতির একটি বড় অংশ ধামাইল নৃত্য ও গীত’কে বাঁচিয়ে রাখা। তাই লুপ্তপ্রায় এসব গীতি কবিতা সংগ্রহের কাজ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে করে যাচ্ছেন শ্রীমঙ্গলের রামকৃষ্ণ সরকার। এ পর্যন্ত তিনি সংগ্রহ করেছেন প্রায় ৪ শতাধিক ধামাইলসহ অন্যান্য লোকজ গান। তার সংগ্রহ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে “সিলেটি ধামাইল গীত” নামক ধামাইল গানের একটি বই। এভাবেই লুপ্তপ্রায় সিলেটি ধামাইল নৃত্যগীতকে সারা দেশে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি আপন মনে করে চলেছেন রামকৃষ্ণ সরকার।

১৯৭১ সালের ১৯ জানুয়ারী মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার রুস্তমপুর গ্রামে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম রামকৃষ্ণ সরকারের। পরিবারের বড় সন্তান তিনি। জীবনের শুরু থেকেই দরিদ্রতার সাথে লড়াই করে বেড়ে উঠা তাঁর। তাই পড়ালেখায় আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। স্থানীয় আছিদউল্লা উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীতেই ইতি টানেন শিক্ষা জীবনের। কাজ করতেন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। তখন থেকেই সিলেটি ধামাইলসহ অন্যান্য লোকজ গানের উপর আকৃষ্ট হয়ে পড়েন তিনি। তাই কোন প্রতিষ্ঠানেই চাকরী জীবন আর স্থায়ী হয়নি।

রামকৃষ্ণ সরকার জানালেন, যেখানে লোকগানের আসর, সেখানেই ছুটেছেন। শাহ আবদুল করিম, রাধারমণ দত্ত, হাসন রাজা, দীন ভবানন্দসহ বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের এসব লোককবির গান তাঁর মনে গেঁথে আছে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিভিন্ন জনের কণ্ঠে গান শুনেছি। প্রচলিত সুর শুনে ধামাইল গানের সুর আয়ত্ত করেছি। প্রাচীন মহিলা ও গ্রামীন শিল্পীদের কাছ থেকে ধামাইল গান, বাউল, কীর্তনসহ যে গানগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, সে রকম লুপ্তপ্রায় চার শতাধিক গান সংগ্রহ করেছি। গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- জলে গিয়াছিলাম সই, এগো কালা কাজলের পাখি দেইখ্যা আইলাম অই/ আমার বন্ধু দয়াময়, তোমারে দেখিবার মনে লয়/ অউত্ব যারায় গিয়ারে বন্ধু, অউত্ব যারায় গিয়া, ওরে সইত্য করি কওরে বন্ধু আইবায়নি ফিরিয়া/ রাধা বলে শ্যামের বাঁশী কোন বনে বাঁজিলো গো সই, বাঁশীর সুরে গৃহে কেমন করে রই।


তিন কন্যা সন্তান আর স্ত্রী শুক্লা সরকারকে নিয়ে পাঁচ জনের সংসার রামকৃষ্ণ সরকারের। বর্তমানে রামকৃষ্ণ শ্রীমঙ্গলের উপাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আব্দুস শহীদ কলেজে অফিস সহায়ক পদে চাকরী করছেন। সংসারে অভাব অনটন থাকা সত্বেও মেয়েদের পড়ালেখা খুব কষ্টে চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তবুও লুপ্তপ্রায় সিলেটি ধামাইল নৃত্যগীত সংগ্রহ এবং এর প্রচার করা থেকে একটুও পিছপা হননি। রামকৃষ্ণ সরকারের দুঃখ সিলেট অঞ্চলে লোকজ সংস্কৃতির একটি বড় অংশ এই ধামাইল নৃত্যগীত’কে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার কিংবা কোন প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসেনি। এমনকি তাদের দরজায় বার বার ধর্না দিয়েও কোন সহযোগীতা পাওয়া যায়নি। শুধু পাওয়া গেছে আশার বাণী!

এ ব্যাপারে সিলেট অঞ্চলের ধামাইল সংগঠক ও সংগ্রাহক রামকৃষ্ণ সরকার বলেন, ধামাইল নৃত্যগীতের অবস্থা খুবই করুন এবং মৃতপ্রায়। আমি যখন ধামাইল নৃত্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করি তখন অনেক নারী ধামাইল শিল্পী সংগঠনের সদস্য ছিল। বর্তমানে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে শিল্পী কমে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের আগ্রহ। নতুন করে সৃর্ষ্টি হচ্ছে না কোন শিল্পী। যার ফলে লুপ্তপ্রায় প্রাচীণ এই নৃত্যগীত এখন মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়ে আছে।
এই মৃতপ্রায় লোকজ সংস্কৃতিকে বাচিঁয়ে রাখতে আশার আলো না দেখিয়ে দ্রুত সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়কে এগিয়ে আশার আহবান জানান রামকৃষ্ণ সরকার।

যেখানে পদপদবী, ব্যাক্তিস্বার্থ আর আত্মপ্রচারে পরিপূর্ণ, শেষ প্রান্তে পৌছাতে পারলে হয়তো আলো দেখা যেতেও পারে। কিন্তু সে আর কজন রামকৃষ্ণের ভাগ্যে জোটে। আমরা হয়তো একদিন দেখতে পাবো ধামাইল আস্তে আস্তে হাল ফ্যাশনের সড়কে উঠেছে, মিডিয়ার নজর পরেছে। জাতীয়ভাবে অনুষ্ঠানাদিতে ডাক পরছে। এখন অনেক মহিলারা আগ্রহী হচ্ছেন ধামাইলনৃত্য দলে যোগ দেওয়ার জন্য। সেদিন আর বেশি দূরে নয় টিভিতে ধামাইলের আলাদা অনুষ্ঠান হবে, ধামাইল প্রশিক্ষণ একাডেমী হবে, ধামাইল ছাড়া গায়ে হলুদের কনে মঞ্চে বসবেন না, ধামাইল প্রশিক্ষক, সংগঠক, শিল্পী ও গবেষকদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে। কোন দুস্থ ধামাইল শিল্পীর সাহায্যর্থে চ্যারিটি শো হবে। রামকৃষ্ণ তুমি ততো দিন এ পথেই থেকো পা দুটো শক্ত করে, নিভৃত পল্লীগ্রামের কোন উঠোনের কোনে বসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ো না, আমরা সেদিনের অপেক্ষায় রইলাম। 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত