২০১০ সালে পাবনা শহরে বেশ কবারই যেতে হয়েছে আমাকে । মূল কাজ ঈশ্বরদীতে থাকলেও জেলা সদরের ব্যবসায়ী ঘনিষ্ঠজন সেলিম ভাইয়ের নিমন্ত্রনেই পাবনায় যাতায়াত। এ হামিদ রোডে চায়ের আড্ডা চলছিল । এর ফাঁকে খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম । হঠাৎ সুচিত্রা সেনের ছবিতে চোখ আটকে গেল । ৬ এপ্রিল এই গুণী অভিনেত্রীর জন্মদিন উপলক্ষে একটি ছোট লেখা । আমি নড়েচড়ে বসলাম । সেলিম ভায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম অনেক কিছুইতো দেখালেন সুচিত্রা সেনের বাড়ি দেখবেন না ? হাতে তেমন কাজ না থাকায় আমার আবদারে সায় দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন । মোটর বাইক ছিল । আমরা দ্রুতই পৌঁছে গেলাম ।
পাবনা শহরের দিলালপুর (গোপালপুর) মহল্লায় হেমসাগর লেন । এখানেই সুচিত্রা সেনের পৈত্রিক বাড়ি ।
সেলিম ভাই যে বাড়িটি দেখিয়ে দিলেন সে বাড়ির সাইনবোর্ডে লেখা ইমাম গাযযালী ইন্সটিটিউট । সে কথায় পরে আসছি । আগে বাড়িটি দেখে নিই ।
পাঁচ কক্ষের একতলা পাকাবাড়ি । বেশ চওড়া বারান্দা । ভেতর বারান্দার পশ্চিমে ছাদে উঠার সিঁড়ি । আঙিনার উত্তর পাশে টিনশেড রান্নাঘর । বাড়ি জুড়ে অনেক রকম ফুল ফলের গাছ । এই বাড়িতেই বেড়ে উঠেছেন চলচ্চিত্র জগতের এই কিংবদন্তী । জন্মেছিলেন
সিরাজগঞ্জের এক গ্রামে নানাবাড়িতে । তাঁর লেখাপড়া শুরু এই পাবনার বাড়িতেই ।সুচিত্রার ডাক নাম ছিল রমা । বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছোট্ট রমাকে ভরতি করে দেন পাবনা মহাখালী পাঠশালায় । ওই পাঠশালাতেই চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন । পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন পাবনা বালিকা বিদ্যালয়ে ( বর্তমান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় )।
এই বাড়িতেই নবম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় ঢাকার জমিদার আদিনাথ সেনের ছেলে দিবানাথ সেনের সাথে সুচিত্রার বিয়ে হয় । ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ১৯৫১ সালের মাঝামাঝিতে সুচিত্রা সেনের বাবা করূনাময় দাসগুপ্ত স্বপরিবারে পাড়ি জমান কলকাতায়। এরপর থেকে বাড়িটিতে সরকারি বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বসবাস করতেন। পরবর্তিতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে এই বাড়িটি প্রথমে রাষ্ট্রীয় ও পরে ব্যাক্তিগত দখলদারিত্বে চলে যায় ।
গোপালপুর মৌজার এসএ-৯৯ খতিয়ানভুক্ত ৫৮৭-এসএ দাগের ০.২১২৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত সুচিত্রা সেনের এই পৈত্রিক ভিটা ১৯৮৭ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক সাইদুর রহমানের সহযোগিতায় জামায়াত নেতা মাওলানা আব্দুস সুবাহানসহ অন্যান্যরা একসনা লিজ নেয়। পরে এখানে তারা 'ইমাম গাযযালী ইনস্টিটিউট' নামে কিন্ডারগার্টেন স্কুল গড়ে তোলে।
বাড়িটি উদ্ধারের দাবিতে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ এবং কিছু রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় সুচিত্রা সেন স্মৃতি রক্ষা পরিষদ । তাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল হিসেবে সর্বশেষ ২০১১ সালের ২৬ জুলাই এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সুচিত্রা সেনের পৈত্রিক বাড়িটি সরকারের দখলে নেয়ার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে দলখকারীরা সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে হাইকোর্টে সে আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ প্রদান করেন আপিল বিভাগ। অবশেষে গত ২০১৪ সালের ৪ মে ইমাম গাযযালী ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষের লিভ টু আপিল খারিজ করে দিয়ে বাড়িটি সরকারের দখলে নিয়ে সেখানে সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা স্থাপনের নির্দেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।
বর্তমানে বাড়িটি জেলা প্রশাসনের অধীনে সিলগালা অবস্থায় আছে ।
যোগাযোগ--
ঢাকার শ্যামলী থেকে বাসযোগে সরাসরি পাবনা যাওয়া যায় । পাবনা এক্সপ্রেস ছাড়াও বেশ কয়েকটি বাস নিয়মিত ছেড়ে যায় । এছাড়া কমলাপুর থেকে খুলনা গামী যে কোন ট্রেনে ঈশ্বরদী জংশনে নেমে সেখান থেকে বাস বা সি এন জি চালিত অটোরিকশায় পাবনা শহরে যাওয়া যায় । শহরে নেমে রিকশায় দিলালপুর ।
আপনার মন্তব্য