মারূফ অমিত

৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪ ১৮:৪৭

বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম




হাওরের শহর সুনামগঞ্জে কালনীর তীরে বেড়ে উঠা একজন সঙ্গীত সাধক, নাম শাহ আব্দুল করিম। দীর্ঘকায় সাদাসিধে একজন মানুষ। বাংলাদেশ, বাঙালি ও বাউল গান ঘিরেই তার স্বপ্নগুলো। একতারা, দোতরা সারিন্দা নিয়ে তার স্বপ্নের কথা বলেছেন সুরে সুরে। সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার ধলআশ্রম গ্রামে ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন এই মহান সঙ্গীত সাধক। চলে যান ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তারিখে।
 




শাহ আবদুল করিমের গানের মূল উপকরণ হচ্ছে মানুষ। ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ,প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে যাচ্ছে সকল অন্যায়,অবিচার,কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরূদ্ধে। তিনি রচনা করেছেন গণসংগীত,বিচ্ছেদ, ধামাইল, জারি, সারি, ভক্তিগীতি,আল্লা স্মরণ,নবী স্মরণ, ওলি স্মরণ, পীর-মুর্শিদ স্মরণ, মনঃশিক্ষা, দেহতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, আঞ্চলিক, কেচ্ছা, পালা ও দেশের গান। দুঃখ, অভাব অনটন ছিল তার চির সাথী। হাজারো দুঃখে পোড় খাওয়া করিম এভাবেই বলেন- 'দুঃখ বলব কারে/মনের দুঃখ বলব কারে/বাঁচতে চাই বাঁচার উপায় নাই/দিনে দিনে দুঃখ বাড়ে',  শুধু দুঃখবোধ নিয়ে বসে থাকেননি করিম। বরং দুঃখ-নিরোধের সম্ভাব্য উপায়গুলোও চিহ্নিত করেছেন। 


বাউল আব্দুল করিম তার গানে নজর কাড়া শব্দ ঝঙ্কার ব্যবহার করেছেন।  সাধারণ মানুষের সংগ্রাম ও অধিকার চেতনাই তার গণসংগীত পর্যায়ভুক্ত গানের মূল বিষয়বস্তু ছিল। শোষকের অবিচার-অত্যাচার-অন্যায় ঘিরে করিমের প্রতিবাদী কণ্ঠ তাই হতদরিদ্র সাধারণ মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল।  গান গাওয়ার সূত্র ধরেই পরিচিত হন মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে।  বিচ্ছেদ রচনাতেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। তিনি বলেছেন- 'আমার বুকে আগুন বন্ধু/তোমার বুকে পানি/দুই দেশে দুইজনার বাস/কে নিভায় আগুনি রে/আর আমার দরদি নাই রে। তার এই কথা থেকে সহজেই বোধগম্য হয় বিরহকাতর ব্যক্তির যন্ত্রণার অভিব্যক্তি তিনি কতটুকুই না উপলব্ধি করতে পেরেছেন।   তাকে নিয়ে ড.মৃদুলকান্তি স্যার বলেছিলেন; " সীমার মাঝে থেকে অসীমের সন্ধান, দেহ থেকে দেহাতীতে, রূপ থেকে অরূপে যাওয়ার সাধনায় নিমগ্ন বাউল কবি। সেখানে প্রেম তার নিত্যসঙ্গী। প্রেমে মিলনের চেয়ে বিরহ-বেদনগাথা প্রেমকে মহিমান্বিত করে।' সাধক প্রেম সন্ধানীও ছিলেন বটে। 

তিনি বলেছেন; "বাঁকা তোমার মুখের হাসি দেখে মন হইল উদাসী রে।ভ্রমরের বর্ণ জিনি কালো মাথার কেশ শ্যামল বরণ রূপে পাগল করলা দেশ।আমি কালো তুমি ভালোভালো তোমার রূপের আলো" 
এ রকম অজস্র গানে তিনি তার প্রেয়সীর প্রেমের আরাধনা করেছেন। তার সাধন-ভজন পথের বিপুল বিস্তার ছিল দেহকেন্দ্রিক। তিনি লিখেছেন-'কোথা হতে আসে নৌকা কোথায় চলে যায়'   
 
 


শাহ আব্দুল করিম। একজন মানবপন্থি সংস্কৃতিসাধক।  অসাম্প্রদায়িক এই সঙ্গীত সাধক হিন্দু -মুসলামান,  জাত-কুল ভেদাভেদ ভুলে মানুষকে মানুষ হিসেবেই উপলব্ধি করার একপ্রভাবশালী দর্শন জন্ম দিয়ে গেছেন তার রচনা ও সুরের মাধ্যমে।   শাহ আবদুল করিমের অফুরান সুরভাণ্ডার থেকে আমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম উজ্জীবিত হবে। তার গানের অনুরণনে ভাসবে বাংলাদেশ তথা বাংলা ভাষাভাষীর সুরপিপাসু সহস্র কোটি মানুষ।  আফতাব সঙ্গীত (১৯৪৮), গণসঙ্গীত (১৯৫৭), কালনীর ঢেউ (১৯৮১), ধলমেলা (১৯৯০), ভাটির চিঠি (১৯৯৮), কালনীর কূলে (২০০১) ও শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র (২০০৯)  এই বই গুলো তার যথার্ত প্রমাণ।
 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত