Sylhet Today 24 PRINT

বুরুঙ্গা গণহত্যা দিবস উপলক্ষ্যে লন্ডনে আলোচনা সভা

নিউজ ডেস্ক |  ২৮ মে, ২০১৫

বাংলাদেশ জেনোসাইড আর্কাইভের উদ্যোগে লন্ডনে বালাগঞ্জের বুরুঙ্গা গণহত্যা দিবস উপলক্ষ্যে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

২৮ মে বৃহস্পতিবার লন্ডন সময় বিকেল ৫:৩০ ঘটিকার সময় ৫২ হানবুরি স্ট্রেট, লন্ডনে অনুষ্ঠিতব্য এ আলোচনা সভায় সবাইকে যথাসময়ে উপস্থিত থাকার জন্যে আয়োজকদের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, বালাগঞ্জের একটি রক্তভেজা বেদনাদায়ক স্মৃতির দিন ২৬ মে। ১৯৭১ সালের এই দিনে উপজেলার বুরুঙ্গা ইউনিয়নে পাকবাহিনী তাদের এদেশীয় দোসরদের সহযোগীতায় শান্তি কার্ড দেওয়ার নাম করে বর্তমান বুরুঙ্গা ইকবাল আহমদ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনেক লোককে জড়ো করে লাইনে দাঁড় করিয়ে নির্বিচারে গুলি চালায়। মৃত্যু নিশ্চিত করতে লুঠিয়ে পড়া দেহ গুলোর ওপর কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।

এই হত্যাযজ্ঞে অজ্ঞাতনামা ৭৮জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায় বলে জানা যায়। তবে শহীদদের সঠিক সংখ্যা নিয়ে মতবিরোধ দেখা গেছে। গুলি খেয়েও সেই হত্যাযজ্ঞ থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় কয়েক জন। সেই দিনের বেদনাদায়ক ও ভয়ার্ত স্মৃতিগুলো আজও তাদের মনে আগুন জ্বালায়। ২০১১ সালে গণকবর পরিদর্শন করে স্বাক্ষ্যগ্রহণ করে মানবতা বিরোধী অপরাধ দমন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দল।

গণহত্যার কাহিনী

২৫মে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা বুরুঙ্গায় প্রবেশ করলে চারদিকে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। এসময় স্থানীয় চেয়ারম্যান ইনজেদ আলী লোক মারফত এলাকাবাসীকে আশ্বস্ত করেন পাকবাহিনী কারো ক্ষতি করতে আসেনি। ঐদিন পাকবাহিনী ও তাদের দুসররা মিলে এলাকায় বৈঠক করে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয় পরদিন (২৬মে) শান্তি কমিটি গঠনের লক্ষ্যে সভা করা হবে । সভায় সকলকে শান্তি কার্ড দেয়া হবে। আরো সিদ্ধান্ত হয় সভায় সকলের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। সিদ্ধান্ত মোতাবেক স্বাধীনতাবিরোধীরা মিলে সভায় উপস্থিতির জন্য গ্রামে জোর প্রচারণা চালায়।

২৬ মে সকালে মৃত্যু ভয় নিয়েও অনেকে বিদ্যালয় মাঠে এসে উপস্থিত হয়। সকাল ৯টার দিকে রাজাকার আব্দুল আহাদ চৌধুরী (ছাদ মিয়া), ডা. আব্দুল খালিকসহ পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানী সেনা জীপে চড়ে বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ে (বর্তমান ইকবাল আহমদ হাই স্কুল এন্ড কলেজ) অবস্থান নেয়। প্রথমে তারা তাদের পূর্বকল্পিত নকশা অনুযায়ী সবার উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। এসময় পাক হানাদারদের একটি দল গ্রামে ঢুকে পুরুষদের মিটিং-এ আসার তাগিদ দিতে থাকে।

সকাল ১০ টায় বিদ্যালয় মাঠে সমবেত লোকদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানকে আলাদা করা হয়। এসময় পাক বাহিনী তাদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে কয়েকশ' মুসলমানকে কলেমা পড়িয়ে এবং পাকিস্তানের স্লোগান দিয়ে ছেড়ে দেয়। হিন্দুদের বিদ্যালয়ের অফিসকে ও অবশিষ্ট মুসলমানদের দক্ষিণ দিকের একটি শ্রেণী কে রাখা হয়। পাকবাহিনী তাদের জিম্মায় থাকা মুসলমাদের নির্দেশ করে ৪ জন করে হিন্দুকে এক সাথে বাঁধার জন্য। এসময় গ্রামের প্রাক্তন চেয়ারম্যান বাদশা মিয়া ক্যাপ্টেনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এটা ইসলাম বিরোধী কাজ। এখানে হিন্দুদের দাওয়াত করে আনা হয়েছে।

ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিন চেয়ারম্যানকে ধমক দিলে তিনি নিরব হয়ে যান। হিন্দুদের যে ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল; একটি জানালা শ্রী নিবাস চক্রবর্ত্তী কৌশলে খোলে ফেলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল জানালা দিয়ে পালিয়ে যাবেন, কিন্তু পারেননি। এক সময় ঐ খোলা জানালা দিয়ে বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রীতি রঞ্জন চৌধুরী ও রানু মালাকার নামের এক যুবক পালানোর উদ্দেশ্যে লাফ দিয়ে দৌড়াতে শুরু করেন।

এসময় পাক সেনারা তাদের উপর বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়ে। ভাগ্যক্রমে দু’জনই নিরাপদ দুরত্বে চলে যেতে সম হন। দুপুর ১২ টার দিকে পাক সেনারা প্রায় শতাধিক লোককে বাধা অবস্থায় বিদ্যালয়ের মাঠে এনে ৩টি এলএমজির সামনে লাইনে দাঁড় করায়। ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিন উপস্থিত সবাইকে মুজিব বাহিনীর দালাল আখ্যায়িত করে বলে- এখন তোমাদের কি করবো তোমরাই বলো!

তখন রাজাকার আব্দুল আহাদ চৌধুরী (ছাদ মিয়া) ও আব্দুল খালিক ক্যাপ্টেনকে উদ্দেশ্য করে বলে, এরা সকল মুজিবের সমর্থক, এদের বাঁচিয়ে রাখা উচিত নয়। তখন ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিনের সামান্য ইশারায় এলএমজিগুলো এক সাথে গর্জে উঠে। মুহূর্তেই রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠে সবুজ মাঠ, নিস্তেজ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সবগুলো দেহ। পাক বাহিনী গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি। মৃত্যু নিশ্চিত করতে বুরুঙ্গা বাজার থেকে ২টিন কেরোসিন এনে লুটিয়ে পড়া দেহগুলোর ওপর ঢেলে আগুন দেয়। তৎকালীন সিলেট জর্জ কোর্টের উকিল রাম রঞ্জন ভট্টাচার্য্যকে একটি চেয়ারে বসিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। এসময় তাকে ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি পেছন দিক থেকে গুলি করে হত্যা করে।

মানুষের অত্মচিৎকারে চারিদিক যখন প্রকম্পিত রাজাকার আব্দুল আহাদ চৌধুরী (ছাদ মিয়া), আব্দুল খালিকসহ আট-দশজন পাকিস্তানী তাবেদার তখন সমস্ত গ্রামে লুটপাট ও নারী নির্যাতনে মগ্ন হয়। পাক বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে একাধিক গুলি খেয়েও ভাগ্যক্রমে কয়েকজন বেঁচে থাকা কয়েকজন এসময় পালিয়ে যেতে সম হয়।

সমস্ত দিন-রাত পোঁড়া, অর্ধপোঁড়া লাশ গুলি একই জায়গায় পড়ে রইলো। পরদিন সকালে আবার কিছু পাকিস্তানী সৈন্য বুরুঙ্গায় এসে স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছ থেকে কিছু লোক চেয়ে নিয়ে মৃত দেহ গুলোকে বুুরুঙ্গা স্কুলের পাশে (বর্তমান গণকবরে) একটি গর্ত খুঁড়ে মাটি চাঁপা দেয়।

গণহত্যায় যারা শহিদ হয়েছেন
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে বুরুঙ্গা গণহত্যায় এডভোকেট রাম রঞ্জন ভট্টাচায্য, শিক সমরজিত চক্রবর্ত্তী, নিকুঞ্জ বিহারী চক্রবর্ত্তী, নিত্য রঞ্জন চক্রবর্ত্তী, বিশ্বতোষ চক্রবর্ত্তী, দূর্গাপদ আচার্য, যোগেশ চন্দ্র দেব, রজনী কান্ত দেব, যতীন্দ্র কান্ত দেব, রেবতি মোহন দত্ত, রনজিৎ দেব, গজেন্দ্র কুমার সেন, সুখময় বৈদ্য, হরিচরণ বৈদ্য, দ্বিগেন্দ্র বৈদ্য, সুধির বৈদ্য, কিরণ দাস, নীরদ দাস, নীর দাস, রমন চন্দ্র দাস, অশ্বিনী কুমার দাস, সুনিল মালাকার, খতর মালাকার, চিত্তরঞ্জন মালাকার, ছাওধন শব্দকর, রবীন্দ্র শব্দকর, প্রল্লাদ শব্দকর, ময়না ধন শব্দকর, বেনু শব্দকর, দুলাল শব্দকর, বিহারী নম., সদয় নম., অয় নম., সদয় নম., মহেন্দ্র নম., হরি কুমার নম., পরেশ নম., দ্বারিকা নম., সরধন নম., সূর্য্যরাম নম., রাজেন্দ্র ধর, রাখাল ধর, শ্যামা ধর, গণেশ ধর, গঙ্গেশ ধর, সীতেশ চন্দ্র দেব, অভিমণ্যু দেব, নিরঞ্জন দাস, যতীন্দ্র দেব, গোপেশ দেব, আনন্দ চন্দ্র দেব, শ্যাম চরণ দেব, বিহারী চন্দ্র দেব, ধীরেন্দ্র চন্দ্র দেব, সুনীল চন্দ্র দাস, গঙ্গেশ চন্দ্র দেব, বিনয় চন্দ্র দেব, রমেশ চন্দ্র দেব, সুনিল চন্দ্র দাস, অশ্বিনী কুমার দাস, ব্রজেন্দ্র কুমার দাস, পিয়ারী নমঃ, নন্দ লাল পাল, বাসিরাম নমঃ, পুলিন চন্দ্র দাস, কিরন চন্দ্র বৈদ্য, নীর রাম বৈদ্য, নীরদ বৈদ্য, শচীন্দ্র কুমার দেব ও দয়াল রাম বৈদ্যসহ ৭৮ জন শহীদ হয়েছেন। তবে শহীদের সংখ্যা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে বলে জানা যায়।

হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়াদের বক্তব্য

শ্রী নিবাস চক্রবর্ত্তীর বলেন, পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দালালরা শান্তি কমিটি গঠন এবং শান্তি কার্ড দেয়ার নাম করে প্রায় ৭৮ জন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমার চোখের সামনে আমার পিতা ও ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। আমি পিছনের সারিতে ছিলাম গুলি খাওয়ার পর আহতবস্থায় মরার ভান করে পড়ে রয়েছিলাম। তাই ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছি। আজও সেই বেদনাদায়ক ও ভয়ানক স্মৃতি আমাকে তাড়া করে।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.