Sylhet Today 24 PRINT

শিকড়ের টানে প্রাণের গানে লন্ডনে শেষ হল সিলেট উৎসব

লন্ডন প্রতিনিধি |  ০৬ মার্চ, ২০১৮

শত শত মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। হল কর্তৃপক্ষ কাউকেই ভিতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। আয়োজকরাও অনেকটাই বিব্রত। হলের ভিতরে মানুষের স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। লন্ডনের বাঙালি পাড়ার কোন অনুষ্ঠানে এমন চিত্র শেষ কবে দেখা গেছে কেউ মনে করতে পারছেন না। অনেকেই অপেক্ষা করতে করতে শীতে কাবু হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। লন্ডন শহরজুড়ে কালকে ছিল এক ভিন্ন আমেজ। সিলেট উৎসবে মেতে উঠেছিলেন লন্ডনের বাঙালিরা।

বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্ট সেন্টারে বসেছিল মিলন মেলা। 'শিকড়ের টানে প্রাণের গানে এসো মাতি মিলন উৎসবে' এই স্লোগান নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ব্রিটেনের প্রথম সিলেট উৎসব।

জীবনের প্রয়োজনে, নোনা জল পাড়ি দিয়ে, নিজের শিকড় ছিঁড়ে, ভাগ্যান্বেষণে ঘর ছেড়ে ছিলেন সিলেটের মানুষ। বসতি গড়ে ছিলেন বিলেতে। লন্ডন থেকে অবস্থান গড়েছেন মূলধারায়। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন ব্রিটিশ বাংলাদেশিরা।

উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান আনসার আহামেদ উল্লাহ বলেন, পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস এখন ব্রিটেনে। যাদের ৯৫ ভাগের আদি নিবাস সিলেট অঞ্চলে। চতুর্থ প্রজন্মে এসে সেই শিকড়ের সাথে ক্রমশই বাঁধন ছেড়া হচ্ছে। জড়িয়ে পড়ছে উগ্রবাদে। সিলেট অঞ্চলের অসাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস সর্বজনবিদিত। সিলেটের বর্ণাঢ্য ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে মেলবন্ধন ঘটাতেই এমন আয়োজন।

হলের যেদিকেই কান পাতা যায়, শোনা যায় 'কিতা ভাইছাব ভালানি'। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে এমন আয়োজনের প্রয়োজনীয়তার কথাই বলছিলেন।  

লন্ডন সময় দুপুর আড়াইটায় সংক্ষিপ্ত র‍্যালি করে ব্রাডি আর্ট সেন্টারে ফিতা কেটে সিলেট উৎসবের উদ্বোধন করেন, ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার নাজমুল কাওনাইন, টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিলের স্পিকার সাবিনা আক্তার, বাংলাদেশ থেকে আগত সাবেক এমপি শফিকুর রহমান চৌধুরী।

এর পরপরই উৎসবে যোগ দেন ব্রিটিশ বাংলাদেশি প্রথম এমপি রোশনারা আলী, টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিলের নির্বাহী মেয়র জন বিগস। আগত বিশেষ অতিথি সহ উৎসবে আসা সবাইকে মিষ্টিমুখ করে বরণ করা হয়।

এমপি রোশনারা আলী তাঁর বক্তৃতায় সিলেটি হিসেবে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেন মন্তব্য করে বলেন, ৭ বছর বয়সে আমি এদেশে এসেছিলাম। লেখাপড়া শেষে রাজনীতি এরপর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপি হয়েছি, কিন্তু নিজের সিলেটি পরিচয় বিসর্জন দেইনি।

তিনি বলেন, জাহাজের খালাসী হয়ে আমাদের পূর্ব পুরুষরা পাড়ি দিয়েছিলেন যে ব্রিটেনে, সেই ব্রিটেন এখন আমাদেরও দেশ। ব্রিটেনে সিলেটি তথা বাংলাদেশীদের আজকের সমৃদ্ধ অবস্থানের জন্য পূর্ব প্রজন্মের দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা স্মরণ করে সিলেটি তথা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ এমপি বলেন, আমাদের পূর্ব প্রজন্মের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস আজ মাল্টিকালচারাল ব্রিটিশ সোসাইটির ইতিহাসের অংশ।

রোশনারা বলেন, ব্রিটেনের মূলধারার রাজনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আমাদের প্রজন্মের অবস্থান পূর্ব প্রজন্মের দীর্ঘ ত্যাগ-তিতিক্ষারই ফসল। এই সংগ্রামী পূর্ব প্রজন্মকে অবশ্যই আমাদের স্মরণ করতে হবে। সিলেট উৎসব সেই সুযোগই করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি বলেন, এমন সুযোগ করে দেয়ার জন্য আমি ধন্যবাদ জানাই সিলেট উৎসব কমিটিকে।

হাই কমিশনার নাজমুল কাওনাইন তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ব্রিটেনে বাঙালী কমিউনিটির আজকের সুদৃঢ় অবস্থানের পেছনে পূর্ব প্রজন্মের সিলেটিদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের বিভিন্ন দুর্যোগ দু:সময়ে ব্রিটেন প্রবাসী সিলেটিদের ভূমিকা রাষ্ট্রও স্বীকার করে এমনটি জানিয়ে হাই কমিশনার বলেন, দেশের প্রতিনিধি হিসেবে এটি জানাতেই আমি আজ সিলেট উৎসবে এসেছি।

টাওয়ার হ্যামলেটস বারার নির্বাহী মেয়র জন বিগস উৎসবে আগত সিলেটিদের স্বাগত জানিয়ে বলেন, সিলেটিরা একটি পরিশ্রমী জনগোষ্ঠী। পূর্ব প্রজন্ম ব্রিটেনের মাটিতে তাদের বসতির যে ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন, দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তারা সেই ভিত্তিকে মজবুত থেকে মজবুততর করেছেন। টাওয়ার হ্যামলেটসের উন্নয়নে সিলেটিদের অবদান আমাদের স্থানীয় ইতিহাসের অংশ।

সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে, জুয়েল রাজের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বিশেষ প্রকাশনা। সংগঠনের সেক্রেটারি আহাদ চৌধুরী বাবু, মুনিরা পারভীন, সৈয়দা সায়মা আহামেদ ও জয়া কোরেশী দিনভর তাদের ইংরেজি, বাংলা ও সিলেটি উপস্থাপনায় মাতিয়ে রেখেছিলেন আগত অতিথিদের।

গৌরী চৌধুরীর নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উন্মাতাল ছিল পুরো ব্রাডি আর্ট সেন্টার। সিলেট অঞ্চলের গীতিকবিদের গান দিয়েই সাজানো হয়েছিল পুরো অনুষ্ঠান। ছিল হারিয়ে যাওয়া বিয়ের গীত, পুঁথি সহ নানা রকম আয়োজন। সিলেটের মণিপুরি পোশাক নিয়ে সাঈদা চৌধুরীর ফ্যাশন শো দৃষ্টি কেড়েছিল সকলের। নতুন প্রজন্মের শিশুদের জন্য সিলেটের ঐতিহ্যবাহী খাবার, পিঠা, কমলালেবু, জারা লেবু, আনারস, শীতল পাটি, সাতকড়ার প্রদর্শনীর ও ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। অতিথিদের জন্য দিনভর রাখা হয়েছিল পান-সুপারির ব্যবস্থা।

দেশে যেমন সিলেটকে বলা হয় দ্বিতীয় লন্ডন, তেমনি পূর্ব লন্ডনকে বলা হয় দ্বিতীয় সিলেট। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে সেই প্রচলিত ধারণাকেই সফল করলেন আয়োজকগণ। সংগঠনের কো- চেয়ারম্যান জামাল খান যখন অনুষ্ঠানের সমাপণী বক্তব্য রাখছিলেন তখন ও হলভর্তি মানুষ চিৎকার করছিল, অইতো অইতো...।

আগামীতে আরও বিশাল আকারে আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সমাপ্ত হয় অনুষ্ঠান। স্মৃতিকাতরতা আর সিলেটের মাটির পরশ নিয়ে ঘরে ফিরে যান সহস্রাধিক মানুষ।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.