Sylhet Today 24 PRINT

স্রোতের বিপরীতে দুই তরুণের বন্ধুত্বের গল্প ‘দোস্তজী’

সিনেমা পর্যালোচনা

রেজা ঘটক |  ২২ জানুয়ারী, ২০২২

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম ডোমকল। এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদী। পদ্মার ওপারে বাংলাদেশ। এই ডোমকল গ্রামের ৮-১০ বছরের দুই কিশোর শফি ও পলাশ। শফির পরিবার মুসলিম আর পলাশের পরিবার সনাতন ধর্মের। শফি আর পলাশ একই ক্লাসে পড়ে। পলাশ ছাত্র হিসেবে ভালো তবে শফি ছাত্র হিসেবে ফাঁকিবাজ কিন্তু বুদ্ধিতে তুখোড়।

শফির একটি বড় বোন আছে যে সবসময় শফিকে শাসন করে। শফির বাবা একজন গামছা বিক্রেতা আর মা ও বোন তাঁত বুনে গামছা বানায়। অন্যদিকে পলাশের একটি ছোট বোন আছে নাম জবা। পলাশের বাবা-মা ব্রাহ্মণ পরিবার হিসেবে শফিদের চেয়ে একটু সচ্ছল। পলাশদের বাড়িতে যে হাউজ টিউটর আসেন, তার কাছেই শফিও সন্ধ্যাবেলায় পড়তে যায়।

একই বাড়িতে উঠোনে একটি পাটখড়ির বেড়া। সেই বেড়ার দু'পাশে দুই সম্প্রদায়ের দুটি পরিবার সুখে শান্তিতে বসবাস। পলাশ আর শফি পরম্পরাকে 'দোস্তজী' সম্বোধন করে। তারা দু'জন আদতে হরি-আত্মা বন্ধু। শফি বোনের মাটির ব্যাংক থেকে পয়সা চুরি করে একটি ঘুড়ি কেনে। পলাশ মায়ের থেকে পয়সা নিয়ে কেনে সুতা। তারপর সেই ঘুড়ি পদ্মার পাড়ে ওড়াতে গিয়ে পলাশ অসতর্কতাবশত ঘুড়ি ভেঙ্গে ফেলে। তাই নিয়ে দুই দোস্তজীর বন্ধুত্বে ফাটল ধরে।

তারপর তারা একসাথে স্কুলে গেলেও কেউ কারো সাথে কথা বলে না। পলাশ আত্ম অপরাধবোধে ভুগতে ভুগতে একসময় শফিকে খুশি করতে স্কুলে যাবার বাসভাড়া বাঁচিয়ে হেঁটে স্কুলে যায়। আর সেই পয়সায় একই রঙের (নীল) ঘুড়ি কেনে। তারপর তারা আবার একত্রে ঘুড়ি ওড়াতে যায়। দু'জনের বন্ধুতা আবার যখন জোড়া লাগে, তখন ঘুড়ি ওড়ানো শেষে তারা নদীতে মাছ ধরতে যায়। আকাশে তখন প্রচণ্ড ঝড়। সেই ঝড়ের ভেতরে তীব্র বজ্রপাতের মধ্যে পলাশ নদীতে ডুবে মারা যায়। হঠাৎ দুই দোস্তজীর এই বিচ্ছেদ নিয়েই এগিয়ে চলে কাহিনী।

সময়টা তখন ১৯৮৯-৯০ থেকে ১৯৯২-৯৯। ভারতের উত্তর প্রদেশের হযরতবাল মসজিদ থেকে নবী মুহম্মদের (স.) চুল চুরিকে কেন্দ্র করে সারা ভারতের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে তখন উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বাবরী মসজিদ ভেঙে সেখানে রাম মন্দির নির্মিত হওয়ায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পালটা রাম মন্দিরের জায়গায় বাবরী মসজিদ নির্মাণের প্রচেষ্টা নিয়ে সারা উপমহাদেশেই তখন হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই উত্তেজনা ও দাঙ্গা বেঁধে যাবার মত পরিস্থিতি।

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী শফি ও পলাশের গ্রাম ডোমকল-এ তখন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেও এক ধরনের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ডোমকলে মুসলিম সম্প্রদায় 'ছোট বাবরী মসজিদ' বানানোর উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এমন একটি টালমাটাল রাজনৈতিক সময়ের মধ্যে দুই অবুঝ কিশোর গোটা দেশের সাম্প্রদায়িক বিষয়ের ঊর্ধ্বে তখন হরি-আত্মা বন্ধু, তাদের ভাষায় দোস্তজী। রাজনীতির কিছুই তাদের মধ্যে প্রবেশ করে না। কিন্তু উভয় পরিবারের মধ্যে সাম্প্রদায়িক আতংক তখন সুস্পষ্ট। ওই ঘটনার কয়েক বছর পর ভারতের মুম্বাই শহরে হোটেল তাজ-এ সন্ত্রাসী হামলা চালায় পাকিস্তান সমর্থনপুষ্ট মুসলিম মুজাহিদরা। এই সময়কালকে ভিত্তি করে দুই সম্প্রদায়ের দুই অবুঝ কিশোরের বন্ধুত্বের গল্প দেখান 'দোস্তজী' ছবিতে তরুণ মেধাবী নির্মাতা প্রসূন চ্যাটার্জী।

প্রসূন চ্যাটার্জী'র ডেব্যু ফিচার চলচ্চিত্র 'দোস্তজী'। ইতোমধ্যে গ্রিসের ২৪তম অলিম্পিয়া চলচ্চিত্র উৎসবে 'দোস্তজী' 'বেস্ট চাইল্ড পারফরম্যান্স (মেল) বিভাগে' সেরা পুরস্কার জিতেছে শফি চরিত্রের অভিনেতা কিশোর আরিফ শেখ (১৩)। আরিফের বাবা পেশায় একজন ইটভাটার কর্মী। মা একজন গৃহিণী। কিন্তু স্বপ্নপূরণের ইচ্ছের তো কোনও সীমান্ত নেই। দেশ-কালের বাঁধন মানে না খুদে স্বপ্ন। মানুষের প্রতিভাকে কখনও আটকে রাখা যায় না। স্থান-কাল-সময় পেরিয়ে ঠিক সে নিজের জায়গা করে নেয় সমাজে। বাস্তবেও মিলল তেমন উদাহরণ। গ্রিসের মাটিতে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গের তস্য গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তান আরিফ শেখ।

ছোট থেকেই অভিনয় করার শখ খুদে আরিফের। বয়স তখন মাত্র ৯ বছর। পরিবারে আরিফই প্রথম যে স্কুলে গেছে। অত্যন্ত দরিদ্র একটি পরিবারে আরিফের জন্ম। কোনও রকমের সংসার চলে তাঁদের। তরুণ নির্মাতা প্রসূন চ্যাটার্জীর ডেব্যু ফিল্মে অভিনয় করার সুযোগ পায় এই কিশোর আরিফ শেখ। ‘দোস্তজী’ ছবিতে শফি (শফিকুল) চরিত্রে অভিনয় করার জন্য আরিফ জিতে নেয় ২৪তম অলিম্পিয়া চলচ্চিত্র উৎসবে বেস্ট চাইল্ড পারফরম্যান্স (মেল) বিভাগে সেরা পুরস্কার।

তরুণ নির্মাতা প্রসূনের 'দোস্তজী' চলচ্চিত্রটি ইতোমধ্যে ২০২১ সালের বেস্ট ইন্ডিয়ান ফিল্ম লিস্টে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর আগে গত নভেম্বর মাসে বিএফআই লন্ডন ফেস্টিভালে 'দোস্তজী' ছবিটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয়। আগামী ২৮ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সুইডেনে অনুষ্ঠিত সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস ফিল্ম ফেস্টিভাল নামে খ্যাত 'গুটেবর্গ ফিল্ম ফেস্টিভাল'-এ 'দোস্তজী'র নর্ডিক প্রিমিয়ার হবে বলে নির্মাতা প্রসূন আমাকে জানিয়েছেন।

২০ জানুয়ারি প্রসূনের সাথে 'দোস্তজী' নিয়ে আমার যখন আড্ডা হয়, তখন প্রসূন জানান যে, সিনেমাটি বানাতে ৭ বছর লেগেছে। ছবিটির অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন তুহিন বিশ্বাস। সম্পাদনায় দারুণ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন সুজয় দত্ত রায় ও শান্তনু মুখার্জী। নান্দনিক সাউন্ড ডিজাইন করেছেন প্রসূন চ্যাটার্জী ও রোহিত সেনগুপ্ত। অপূর্ব ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করেছেন সাত্যকি ব্যানার্জী। এককথায় 'দোস্তজী' একটি অসাধারণ চলচ্চিত্র। দেখার মত একটি সিনেমা। আমার খুব ভালো লেগেছে।

১৮ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে ২০তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে 'দোস্তজী'র প্রথম শো অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমি ওই শো'টি মিস করেছি। আমাদের আড্ডায় প্রসূন ২১ তারিখে দ্বিতীয় শো'র কথা বলায় পাবলিক লাইব্রেরি অডিটোরিয়ামে প্রসূনের সাথেই সিনেমাটি দেখার কথা ছিল। কিন্তু ২১ তারিখ দুপুরে প্রসূনের কোভিড পজিটিভ হওয়ায় প্রসূনকে ছাড়াই 'দোস্তজী' দেখলাম। যদিও প্রসূনের জন্য খারাপ লেগেছে। কিন্তু সিনেমাটি দেখে আমি দারুণভাবে মুগ্ধ। প্রসূন তুমি দ্রুত সুস্থ হয়ে আমার সাথে আরেক দফা আড্ডার জন্য প্রস্তুত হও।

তরুণ নির্মাতা প্রসূনকে আমার প্রাণঢালা অভিনন্দন। 'দোস্তজী' টিমকে আমার শুভেচ্ছা। বাংলা সিনেমার জয় হোক। জয় হোক পলাশ-শফি দোস্তজীর।

Film: Dostojee (Two Friends)
Director: Prasun Chatterjee, Length: 112 Min. India

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.