Sylhet Today 24 PRINT

‘স্লোগানের’ ব্যাগে সাতচল্লিশের গণভোট

জাকির আজিজ |  ১২ এপ্রিল, ২০১৬

কাগজের ব্যাগ সবার হাতে হাতে, ওখানে কী লেখা থাকে, না থাকে এ নিয়ে কারও কোন চিন্তা নেই। কিন্তু সেখানে যদি থাকে সামাজিক, রাজনৈতিক সচেতনতার ইতিবাচক বার্তা, কিংবা ইতিহাসকে তুলে আনার কিছু সেক্ষেত্রে তা প্রশংসিত হতেই পারে।

তেমনই এক প্রশংসনীয় কাজের ধারাবাহিকতায় পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান "স্লোগান" এবার নিয়ে এসেছে ৪৭-এর ঐতিহাসিক রেফারেন্ডাম তথা গণভোটকে।

এর আগে "স্লোগান" সিলেটের ঐতিহ্যবাহী আলী আমজদের ঘড়িঘরের ১৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ও দখলে-দূষণে বিপন্ন হওয়া সুরমা নদী নিয়ে ‘নদী বাঁচাও’ আহ্বানে এবং  ‘পোশাকশ্রমিক হত্যা বন্ধ কর’ স্লোগানে গাঢ় খয়েরি রঙের কাগজের ব্যাগ তৈরি করেছিল। এবার নিয়ে এসেছে গণভোটকে। আর এসব কাজ পরম মমতায় করছেন অরূপ দাশ, যিনি সিলেটের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অরূপ বাউল নামে পরিচিত। আর প্রচার করে যাচ্ছেন স্লোগানের কর্ণধার উজ্জ্বল চক্রবর্তী, যিনি নিজেও একজন সংস্কৃতি কর্মী।

গত রোববার (১০ এপ্রিল) স্লোগানের রাজা ম্যানশনস্থ  ঠিকানায় ঐতিহাসিক গণভোট সম্পর্কিত এ ব্যাগের উদ্বোধন করেন ব্রটিশ বিরোধী আন্দোলনের কর্মী সত্যেন্দ্র মোহন চক্রবর্তী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সিলেটের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিসহ অনেকেই উপস্থিত থেকে স্লোগানের এ উদ্যোগের প্রশংসা করেন।

সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে ইতিহাস ঐতিহ্যকে মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে দেওয়া সম্পর্কে  উজ্জ্বল চক্রবর্তী বলেন, ব্যবসা মানেই টাকাপয়সার লেনদেন প্রচলিত এ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে সামাজিক, রাজনৈতিক বক্তব্য ও ইতিহাস ঐতিহ্যকে তুলে আনতে চেয়েছি আমরা। আমরা বিশ্বাস করি ইতিহাস কেবল কেতাবে থাকা বিষয় নয়, আমাদের শেকড়ের ঠিকানা- আর সেদিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আমাদের এ উদ্যোগ।

সাতচল্লিশের গণভোটের ব্যাগের ডিজাইনার অরূপ বাউল বলেন, আমাদের এ উদ্যোগের মাধ্যমে যদি মানুষ ইতিহাস সম্পর্কে আরও একটু সচেতন হয় তবে মনে হবে পরিশ্রম সার্থক।

উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাই ঐতিহাসিক গণভোটের মাধ্যমে সিলেট অঞ্চল আসাম থেকে বাংলায় যুক্ত হয়। ওই গণভোটের অনেক পূর্ব থেকেই সিলেটকে বাংলার সাথে যুক্ত করার আন্দোলন চলে আসে। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে গণভোটের আয়োজন করা হয় এবং অভিন্ন সংস্কৃতির কারণে সিলেট অঞ্চলের জনগণ আসাম ত্যাগ করে বাংলায় চলে আসে। তবে সিলেট অঞ্চলের শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি ও বদরপুরের মত এলাকা রয়ে যায় আসামেই।

বিভিন্ন কারণে গণভোটের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারতবর্ষকে ২টি রাষ্ট্রে বিভক্ত করে স্বাধীনতা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিলে প্রস্তাবিত দুটি রাষ্ট্রের এলাকা ও সীমানা নিয়ে বিরাট জটিলতার সৃষ্টি হয়।

দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভক্তির যে ফর্মুলা সেই অনুযায়ী মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলো পাকিস্তানে এবং হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলো ভারতের সাথে যুক্ত রাখার জন্য মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস দাবি পেশ করে। মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবি অনুযায়ী সমগ্র আসাম, বাংলা পূর্ব পাকিস্তানে পড়ার প্রস্তাব ছিল। সমগ্র ভারতবর্ষে বেশকিছু এলাকা নিয়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মতবিরোধ চলে আসলে ওই সমস্ত এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের পছন্দমত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবি ন্যায় সঙ্গত বিধায় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সম্মতিক্রমে ১৯৪৭ সালের ৩ জুন পাঞ্জাব ও বাংলার জন্য ২টি বাউন্ডারি কমিশন গঠন করেন তৎকালীন লর্ড মাউন্টব্যাটেন।

সেই কমিশনের সিদ্ধান্ত ছিল সিলেট জেলার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে এবং বাংলার জন্য গঠিত কমিশনই আসাম প্রদেশের সীমা নির্ধারণে কাজ করবে।

সিলেট জেলার অনুষ্ঠিতব্য গণভোটের ফলাফল যদি সিলেটকে পূর্ব বাংলার সঙ্গে একত্রিভূক্ত করার পক্ষে যায় তবে বাংলার জন্য গঠিত সীমানা কমিশন সিলেট জেলা ও তৎসম্প্রতি জেলা সমূহের সীমানা চিহ্নিত করে ওইসব এলাকার ভারত বা পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

নির্বাচনী প্রচার শুরু হলে সমগ্র জেলায় উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। নির্বাচনী প্রচারে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ নেতাদের এক বিরাট দল সিলেটে আসেন। নেতাদের মধ্যে মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মৌলানা আকরাম খান, পীর বাদশা মিয়া, এইচএম ইস্পাহানি, ইউসুফ আলী চৌধুরী, আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, ফজলুর রহমান কাদের চৌধুরী, শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখযোগ্য।

কিন্তু ৬ ও ৭ জুলাইর গণভোটে সিলেট পূর্ব বাংলার জনগণ রায় প্রদান করে। সামান্য ও বিচ্ছিন্ন সহিংসতার ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবেই গণভোট সম্পন্ন হয়। ভোটারদের শতকরা উপস্থিতি ছিল ৭৮.৩ শতাংশ। মোট ভোট প্রয়োগ করে ৫ লাখ ৪৭ হাজার ৫২ জন। পূর্ব বাংলার পক্ষে ভোট দেয় ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬১৯ জন এবং আসামের পক্ষে ভোট পায় ১ লাখ ৮৯ হাজার ১৮৪ জন।

সেই সময় সমগ্র সিলেট জেলার লোকসংখ্যা ছিল ৩১ লাখ ১৬ হাজার ৬০২ জন। এর মধ্যে ভোটার সংখ্যা ছিল মাত্র ৫ লাখ ৪৭ হাজার ৫২৩ জন। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ১৭.৫৬৫ শতাংশ। এর কারণ হল যারা জমির খাজনা বা অন্য কোন প্রকার কর প্রদান করতেন কেবল তাদেরই ভোট দেয়ার অধিকার ছিল।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.