Sylhet Today 24 PRINT

শরীরে ক্যান্সার, ব্রেন টিউমার নিয়েও জীবনের গল্প ফ্রেমবন্দি করতেন শাহনাজ

একুশ তাপাদার |  ১৬ আগস্ট, ২০১৬

নামে নয় কাজেই মানুষের আসল পরিচয়। সদ্য প্রয়াত আলোকচিত্রী শাহনাজ পারভিন বোধহয় এই বাক্যের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। নামে হয়ত অনেকেই তাঁকে চিনবে না, কিন্তু দেশের খোঁজখবর রাখেন আর ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এমন খুব কম লোকই পাওয়া যাবে যারা তাঁর ছবি দেখালে চিনবে না।

২০১১ সালের দিকে শাহনাজের শরীরের বাসা বাধে মরণব্যাধি ক্যান্সার তবে অসম্ভব প্রাণশক্তির জোরে সেই রোগ থেকে অনেকটাই সেরে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু ২০১৫ সালের দিকে ব্রেনে টিউমারের জন্ম নিলে আর আর কুলিয়ে উঠা হল না তাঁর। মাত্র ৩২ বছর বয়সে গত ১৪ আগস্ট না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন অসম্ভব গুণী এই আলোকচিত্রী।

শরীরে দুই মরণব্যাধিকে পরাজিত করে ফিরে আসার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তবে কারো কাছে হাত পাততে চাননি। ভারতে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার সময়  ক্যামেরা ও নিজের তোলা ছবি বিক্রি করার কথা ফটোগ্রাফি ক্লাবের বন্ধুদের  জানিয়েছিলেন শাহনাজ। বন্ধুরা তাঁর জন্য ফান্ড রাইজ করার প্রস্তাব দিলেও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তা।

শাহনাজ পারভিনের ফটোগ্রাফি জীবনের ঘনিষ্ট বন্ধু নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি (এনপিসি)'র সভাপতি জয় রায় চৌধুরী সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান তাঁর অনেক অজানা কথা।


রাজধানী ঢাকার মুগদার বাসিন্দা শাহনাজ ২০১৩ সালের দিকে নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি (এনপিসি)'র সদস্য হন। প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার এমআর হাসানের সাথে নারায়ণগঞ্জে এক ফটো আড্ডার মধ্য দিয়ে এনপিসি ও জয়দের সাথে সখ্যতার সূত্রপাত ঘটে তাঁর। এরপর 'ফটোওয়াক', 'ফটোআড্ডা' কোন কিছুই মিস করতেন না তিনি। প্রায় প্রতি শুক্রবারেই চলে যেতেন নারায়ণগঞ্জ।


জয় বলেন, "সাধারণত আমাদের অঞ্চলের মেয়েরা ওইভাবে সিরিয়াস ফটোগ্রাফিতে আসে না, কিন্তু শাহনাজ ছিল উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। সত্যিকারের ফটোগ্রাফি করতে যে সাহস, উদ্যম, জীবন দর্শন আর দেখার দৃষ্টিভঙ্গি দরকার তার সবই ছিল ওর মধ্যে। বাংলাদেশের অধিকাংশ ছেলে ফটোগ্রাফারদের মধ্যেও প্রতিভা ও দক্ষতার এমন সমন্বয় দেখা যায় না। "

জাকজমকপূর্ণ দুর্গোৎসব মুগ্ধ হয়ে দেখছে এক মাদ্রাসা ছাত্র- বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিখ্যাত সেই ছবি ব্যাপারে জয় রায় চৌধুরী বলেন, "এই ছবিটা নারায়ণগঞ্জেই তোলা। তখন শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জে একটা ফটো আউটিং ছিল।


ওই দিন শাহনাজ ছবিটি তোলে। আরো অনেক দারুণ সব ছবি তোলেছিল। সব প্রকাশ করেনি।"

তিনি বলেন, "অনেকেই হয়ত ছবিটা দেখে অবাক হয়েছে, এটাও কি সম্ভব? কিন্তু নারায়ণগঞ্জের সম্প্রীতির চিত্র আসলে এরকমই। যারা এখানে বাস করে তারা জানে। তবে শাহনাজের দেখার চোখ ছিল, পয়েন্ট অফ ভিউ ছিল তাই সম্প্রীতির দৃশ্যটি সে অসাধারণভাবে ফ্রেম বন্দি করতে পেরেছে"।

নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফিক ক্লাবের সভাপতি জয় রায় বলেন, "শাহনাজ খুব উৎফুল্ল ও মিশুক স্বভাবের মানুষ ছিল। আমরা শুরুতে তাঁর অসুখের কথা জানতাম না। আনন্দ ফুর্তির মাঝে হঠাৎ দেখতাম সে খুব চুপ হয়ে যেত। একদিন আবিষ্কার করলাম ভারি কিছু বহন করতে পারেনা সে। কারণ জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যেত।"

"একবার সেন্টমার্টিন ট্যুরের সময় তার অসুখের কথা জানতে পারি। সেবার সে আমাকে বলে, 'ভাইয়া আমার একটা সমস্যা আছে, আমার মাথা ঘুরায়,  মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যাই এজন্য ভারি জিনিস বহন করি না। আমার ক্যান্সার ছিল, ক্যামো দিয়ে সেরে উঠেছি।' "

"আগে কেন এ কথা বলেনি জিজ্ঞেস করায় বলল, 'আমি অসুস্থ জানলে যদি আমাকে ট্যুরে না নেয়া হয় তাই বলতাম না।'

"অসম্ভব প্রাণশক্তি আর পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখা ও সেসব ফ্রেমবন্দি করার ব্যাকুলতা থেকে ও রোগের কথা লুকিয়ে রেখেছিল।"  যোগ করেন জয়।

এমনকি ২০১৫ সালে ভারতে চিকিৎসার জন্য গিয়েও ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন শাহনাজ। কলকাতার ফটোগ্রাফির বন্ধুদের সাথে সেবার সেখানকার হোলি উৎসবের দারুণ সব ছবি তুলেছিলেন তিনি। মানুষের প্রেম, উৎসব আর মেলবন্ধন তাকে ভীষণ টানত।


২০১৫ সালের মাঝামাঝির দিকে শাহনাজের ব্রেনে টিউমার ধরা পড়ে। ক্যান্সার থেকে সেরে উঠলেও এই ব্রেইন টিউমারই শেষ করে দেয় তাঁকে- আক্ষেপ করে বলেন জয়।

তখন ভারতে যাওয়ার জন্য নিজের দামি ক্যামেরার সব সেটআপ বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। তবে এনপিসি ক্লাবের বন্ধুরা সহযোগিতার কিছু অর্থ তুলে তাঁর হাতে দিয়ে ক্যামেরা বিক্রি করতে দেননি। তখন খুব ভেঙ্গে পড়েছিলেন শাহনাজ।

তাঁর জন্য ফান্ড রাইজ করার প্রস্তাব দিয়েছিল এনপিসি। কিন্তু তাতে রাজী হননি শাহনাজ। কারো কাছে হাত পাততে তাঁর ভীষণ আপত্তি ছিল। পরে নিজের তোলা কিছু ছবি বিক্রির চিন্তা করেছিলেন কিন্তু মরণব্যাধি সেই সময় আর তাঁকে দেয়নি।

এ বছরের শুরুর দিকে দ্বিতীয়বার ভারত থেকে চিকিৎসা করিয়ে এসে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। হঠাৎ করে কমে যায় তাঁর এক্টিভিটি। ফেসবুক ও ফ্লিকারে ছবি পোস্ট করা বন্ধ করে দেন। মৃত্যুর আগের ১৫ দিন কোমায় চলে গিয়েছিলেন।


আর কোন আশা না দেখে ১৪ আগস্টের ৩/৪ দিন আগে হাসপাতাল থেকেও তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়।

জয় রায় বলেন, ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত তাঁর কাছে ছিলাম, ওটাই শেষ দেখা। রাত ১০ টায় শুনি শাহনাজ আর নেই। পরদিন ঢাকার মুগদা কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয় তাঁর।

তবে বন্ধুদের কাছে তিনি বিগত নন। তারা বিশ্বাস করেন, "জীবন মরনের সীমানা ছাড়ায়ে" কোথাও বা তিনি আছেন। আছে তাঁর কাজ, চিরস্থায়ী হবার মত আলোকচিত্র।

আগামী ১৯ আগস্ট সন্ধায় নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে দেশি-বিদেশী আলোকচিত্রীদের প্রদর্শনীর আয়োজন করবে এনপিসি। সেখানে শাহনাজের অপ্রকাশিত কিছু ছবি প্রদর্শিত হবে। আয়োজনটিও উৎসর্গ করা হয়েছে শাহনাজের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। ওই প্রর্দশনীতে সবাইকে উপস্থিত থাকার আহবান জানানো হয়েছে সংগঠনটির পক্ষ থেকে।

এ সংক্রান্ত অন্য খবর- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিখ্যাত সেই ছবির আলোকচিত্রী শাহনাজ পারভিন আর নেই

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.