Sylhet Today 24 PRINT

করোনা, হার্ড ইম্যুনিটি এবং বাংলাদেশ বাস্তবতা

মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর |  ১৯ মে, ২০২০

হার্ড ইম্যুনিটি বলতে 'শক্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা' বোঝায় না। ইংরেজিতে herd শব্দের অর্থ 'ভেড়ার পাল'। ভেড়ার পালের মতোন ছেড়ে দাও সবাইকে, যারা শক্ত-সামর্থ্য এবং প্রচণ্ড রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী তারাই প্রকৃতি এবং রোগজীবাণুর সাথে যুদ্ধ করে শেষটায় টিকে থাকবে। মোদ্দা কথা 'survival of the fittest' বা যোগ্যতমরাই শেষটায় টিকে থাকবে এটিই হার্ড ইম্যুনিটির মূলমন্ত্র।

বিজ্ঞাপন

কোন একটি সমাজে কোন ভাইরাস দ্বারা হার্ড ইম্যুনিটি পর্যায়ে যেতে হলে সেখানকার অন্তত ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষকে সংক্রমিত হতে হবে এবং এক পর্যায়ে ভাইরাস তেমনভাবে কাউকে সংক্রমণ করার সুযোগ পাবে না। হার্ড ইম্যুনিটি অর্জন করা যায় দুভাবে। প্রথমত ভ্যাকসিনেশন বা সেই ভাইরাসের প্রতিরোধী টিকা প্রদানের মাধ্যমে এবং দ্বিতীয়ত ভাইরাসটি দ্বারা সবাইকে সংক্রমিত হওয়ার আবহ সৃষ্টি করে দিয়ে। যেহেতু করোনার টিকা উদ্ভাবন এখনো সুদূর পরাহত, এ মুহূর্তে হার্ড ইম্যুনিটি অর্জন করতে চাইলে আমাদেরকে দ্বিতীয় পন্থাকেই বেছে নিতে হবে।

মহামারির এই ক্লান্তিলগ্নে পৃথিবীর সিংহভাগ দেশই করোনা নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মানছে না, কিংবা বলা যেতে পারে তাদের পক্ষে মানা সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা- করোনাকে পরাভূত করতে এবং প্রাণহানি কমাতে হলে করোনা টেস্টের হার বাড়িয়ে সংক্রমিত ব্যক্তিবর্গকে নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত সঙ্গনিরোধ করে রাখতে হবে এবং সেইসাথে দেশটিকে পুরোপুরি লকডাউনে রাখতে হবে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা মুষ্টিমেয় না হওয়া পর্যন্ত । কমিউনিস্ট দেশ ভিয়েতনাম, কিউবা, উত্তর কোরিয়া, চিন এবং কল্যাণকামী রাষ্ট্র নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনা মোতাবেক প্রতিরোধ কার্যক্রম চালিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যেই সাফল্য অর্জন করেছে। সৌদি আরবও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মোতাবেক কঠোর লক ডাউন তথা জনগণের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণরে জন্য সান্ধ্যআইন জারি করেছে। আশা করা যায় তারা অচিরেই এর সুফল পাবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের শীর্ষ পুঁজিবাদী দেশগুলো (যেমন যুক্তরাজ্য, জার্মান, ফ্রান্স, সুইডেন, স্পেন, ইতালি) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী চলছে না। এইসব দেশগুলো ইতোমধ্যেই করোনায় প্রাণনাশের সংখ্যা অসংখ্য হওয়া সত্ত্বেও লকডাউন তুলে দিয়ে হার্ড ইম্যুউনিটির পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। এ বিষয়ে তাদের যুক্তি, করোনার কারণে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতির চাকা থামিয়ে রাখলে পরবর্তীতে যে আর্থিক ধস নামবে তা সামাল দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। মূলত পুঁজিবাদী বিশ্বে রাষ্ট্রের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা কিংবা সম্পদ সঞ্চিত থাকে না যা দিয়ে দেশের জনগণকে খাদ্য নিরাপত্তা দেয়া সহ অপরাপর মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে মাসের পর মাস চালাতে পারবে। সত্যিকার অর্থে পুঁজিবাদী দেশগুলোতে টাকা বা সম্পদের প্রায় নব্বই ভাগের মালিক সংখ্যালঘু ধনিকশ্রেণি এবং মুনাফালোভী এই শ্রেণি জনকল্যাণে টাকা ব্যয়করণের কথা ভাবতে পারে না। অধিকন্তু লকডাউনের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদের যে 'লোকসান' হচ্ছে তা তারা মেনে নিতে পারছে না। বস্তুত এরাই সরকারগুলোকে বাধ্য করছে লকডাউন তুলে দিয়ে হার্ড ইম্যুনিটি নীতি গ্রহণ করতে।

উপমহাদেশের দেশগুলোতে এখন চলছে লুটেরা পুঁজিপতিদের আধিপত্য। লকডাউনের কারণে এই সব মুনাফালোভী লুটেরা পুঁজিবাদী গোষ্ঠী তাদের আপাত আর্থিক ক্ষতি যে কোন মূল্যেই পুষিয়ে নেওয়ার জন্য তৎপর। বাংলাদেশে পোশাক কারখানায় মালিকদের ভূমিকা আমার এ বক্তব্যের সাক্ষর বহন করে। করোনা সংক্রমণ যখন ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে সে মুহূর্তে পোশাক শ্রমিকদের জীবনের তোয়াক্কা না করে তারা সরকারকে কারখানাগুলো খুলে দিতে বাধ্য করেছে। শুধু তাই নয়, সরকার ঘোষিত 'সাধারণ ছুটি'-তে অনুপস্থিতির কারণে তাদের প্রাপ্য বেতনের একটি ভাগ তারা কর্তন করেছে। অধিকন্তু সরকারের প্রতিশ্রুতি শ্রমিকদের জন্য প্রদেয় আর্থিক প্রণোদনা আত্মসাৎ করার জন্য মালিকপক্ষ উদগ্রীব হয়ে রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

পুঁজিপতি তথা ধনিকশ্রেণি ভাবছে হার্ড ইম্যুনিটিতে তারা বেঁচে যাবে যেহেতু তারা দেহের ইম্যুনিটি বাড়াতে যথাযথ পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে পারে, ব্যয়বহুল পিপিই ব্যবহার করতে পারবে, এবং একান্তই যদি সংক্রমিত হয়ে পড়ে তাহলে তারা অর্থের জোরে উচ্চতর চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠবে। এ প্রসঙ্গে ভারতের স্বনামধন্য লেখক ও সোশ্যাল এক্টিভিস্ট অরুন্ধতীর রায় বলেছেন হার্ড ইম্যুনিটির মূলমন্ত্র 'survival of the fittest'-কে ধনিক শ্রেণিরা ' survival of the richest' করে তুলবে।

তবে বাংলাদেশের করোনা সংক্রমণ এবং এর প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করলে অরুন্ধতীর আশংকা কতোটুকু সত্য হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এদেশে এখন পর্যন্ত করোনায় কিংবা করোনার লক্ষণ নিয়ে যারা মারা গেছেন তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত শ্রেণিরই অন্তর্গত। আনুপাতিকহারে নিম্নবিত্ত তথা গরীব মানুষ যারা পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়ার সুযোগ কম পায় তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার কথা। এ বিবেচনায় দেশে সংখ্যাগুরু নিম্নবিত্তের মানুষদের মৃত্যুর হার অনেক বেশি হওয়ায় কথা ছিল। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্নতর। তাৎক্ষণিক পরিসংখ্যানে প্রতীয়মান হয় যে সংখ্যা অনুপাতে করোনা কিংবা করোনা লক্ষণে নিম্নবিত্তের মৃত্যুর হার ততো বেশি নয়। এর কার্যকারণ সম্ভবত জীবিকার কারণে দৈনন্দিন জীবনে এদের কায়িকশ্রমে অংশগ্রহণ, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির সহায়ক। এছাড়া খেটেখাওয়া মানুষেরা প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকায় তাদের দেহে এক ধরণের প্রাকৃতিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা জন্ম নেয় যা তাদের করোনা প্রতিরোধে সাহায্য করছে। তবে একথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে নিম্নবিত্তদের পক্ষে সঙ্গতকারণে করোনা আক্রমণ রোধে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা সম্ভব হবে না, তারা করোনায় সংক্রমিত হবে অনেক বেশি, তবে সহজে কাবু হবে না তাদের প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণেই। একই সাথে এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন, এদের মাঝেই করোনা সংক্রমিত হবে উচ্চহারে এবং কার্যত এরা করোনার বাহক হয়ে অন্যদেরকে সংক্রমিত করবে।

বিজ্ঞাপন

ব্যতিক্রমকে নিয়মের ব্যত্যয় হিশেবে বিবেচনা করলে মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত শ্রেণির জনগোষ্ঠীকে কায়িক শ্রম করতে হয় না এবং এদের বেশিরভাগই যথাযথ শরীর চর্চা করে থাকে না। এছাড়া কার্যক্ষেত্রে এবং বাসস্থানে এই দুই শ্রেণির মানুষের বেশিরভাগ প্রকৃতির খোলামেলা আবহাওয়ায় থাকার সুযোগ পায় না, বরং বেশিরভাগ সময়ই এরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বদ্ধঘরে সময় অতিবাহিত করে। এর ফলশ্রুতিতে এই দুই শ্রেণির লোকের প্রাকৃতিক ইম্যুনিটি জন্ম নেয়ার সুযোগ ঘটে না। তাই করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের শারীরিক অবনতি এবং মৃত্যুর আশঙ্কা অনেক বেশি হবে বলে ধারণা করা যায়। আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, বয়স্কলোক, যাদের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা খুবই কম এবং যারা ইতোমধ্যেই নানা ঘাতকরোগে আক্রান্ত (যেমন ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, কিডনিব্যাধি ইত্যাদি) করোনায় আক্রান্ত হলে এদের মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

উপমহাদেশে এবং বিশেষ করে বাংলাদেশে হার্ড ইম্যুনিটি প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক। বিশেষজ্ঞদের অভিমত উপমহাদেশে সংক্রমিত করোনা চীন, আমেরিকা, কিংবা ইউরোপ থেকে ভিন্নতর। মিউটেশেনের কারণে এদের জিনগত পরিবর্তনে মানবদেহে এরা তুলনামূলক মারাত্মক আঘাত কম হানবে। তাই যদিও জাতিসংঘের গোপন নথিতে বাংলাদেশে কনভিড-১৯ তে ২০ লাখ লোক মারা যাবে বলে আশংকা করা হয়েছে, বাস্তবে এই সংখ্যা হয়তো অনেক কম হবে। আমার ধারণা এই সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।

মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর: কবি ও প্রাবন্ধিক, পেশায় কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.