মনিরুল ইসলাম | ০৬ জুন, ২০২০
“পাঁচ সিকের কলাই ক্ষেত কিনে কত যে রঙ বেরঙের ছাগল দেখলাম”— অনেকের মুখেই শৈশবে এমন কথা বহুবার শুনেছি। তখনকার দিনে এক টাকা পঁচিশ পয়সায় কলাই ক্ষেত কেনা যেত না। কিন্তু এক কালে নিশ্চয়ই পাওয়া যেত; কেননা, এক টাকায় আট মন চাল কিনত আমাদের পূর্ব পুরুষেরা। তাই বোধ করি পাঁচ সিকেতে কলাই ক্ষেতও কেনা-বেচা হতো। বাল্যবয়সে কথাটা শুনলেই চোখের সামনে দেখতে পেতাম, কলাই ক্ষেতে একদল সাদা, কালো, বাদামি, হলদে, লাল নানা রঙের ছাগল কলাই খাচ্ছে— সে এক সৌন্দর্য বটে! কিছুটা নাদান ছিলাম বলেই এই বাক্যটার মর্মার্থ বুঝতে আমার অনেকদিন লেগে যায়। বড়বেলায় বিদ্বজ্জনের মুখে শুনে আসছি যে, একটা আপ্তবাক্য নাকি আমেরিকানরা বলে থাকেন, “Every crisis is an opportunity to learn” কথাটি সত্যি তবে ব্যবহার করা হয় সাধারণত নিদানকালেই, সুসময়ে কেউ বোধহয় এই বাক্যটা আওড়ায় না।
বিজ্ঞাপন
অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়া Robert Herrick সাহেবের “Delight in Disorder” পড়ে কিছুটা মিল খোঁজার চেষ্টা করলেও বুঝেছি দু’টো মেলানো যুক্তি সিদ্ধ হবে না। মানসিক বয়স বাড়ার পর জানলাম Albert Einstein সাহেবই না-কি আমেরিকানদের ঋণী করে গেছেন, “..in the midst of every crisis, lies great opportunity.” শৈশবে বহুবার শোনা পাঁচ সিকের কলাই ক্ষেত আর রঙ-বেরঙের ছাগল দেখার মর্মার্থ মনে হয় ইদানীং হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি।
বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে গোটা বিশ্ব মহাসংকট কাল অতিক্রম করছে। মানবজাতির জন্য মহামারীর ইতিহাস নতুন কিছু নয়, কিন্তু বর্তমান মহামারী অতীতের যেকোনো মহামারীর তুলনায় খুবই কম সময়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। উন্নত দেশগুলো তো বটেই, জাতিসংঘ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা- সবাই এই মহামারী নিয়ে উদ্বিগ্ন। কেউ কেউ অতি উদ্বিগ্ন হয়ে বলছেন যে মানবজাতির অস্তিত্বই হুমকির মুখে। ‘বিশ্ব গ্রামের’ (Global Village) অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে। দু’মাসের অধিক সময় সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যতীত সীমিত আকারে প্রায় সব কিছু খুলে দেওয়া হয়েছে। দু’মাস সাধারণ ছুটি থাকার কারণে সংক্রমণ বিলম্বিত করা গেছে বটে কিন্তু প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। প্রতিদিনই সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার অব্যাহত আছে বিধায় আঞ্চলিক লকডাউনসহ অন্যান্য কিছু কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আলোচনা চালু আছে। আজকের হিসেব অনুযায়ী, সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনায় বিশ্বের ২১৫টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ ২০তম অবস্থানে রয়েছে। বৈশ্বিক পরিসংখ্যানে সর্বমোট সংক্রমণ সাতষট্টি লাখ পঁয়ত্রিশ হাজার একশত চুয়াত্তর এবং মৃতের সংখ্যা তিন লাখ তিরানব্বই হাজার সাতশত ষাট জন। বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হলেও এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে সর্বমোট ষাট হাজার তিনশত একানব্বই জন আর মারা গেছে ৮১১ জন।
করোনা মহামারীকে কেন্দ্র করে আমাদের জীবন ধারায় ইতোমধ্যেই বড় পরিবর্তন এসেছে। গত তিন মাসে অধিকাংশ মানুষ ঘরে থেকেছে এবং থাকছে। অখণ্ড অবসরে মানুষের অনেক ধরণের নেতিবাচক পরিবর্তন হলেও বহু সংখ্যক মানুষের ইতিবাচক গুণগুলো ও প্রকাশ পেয়েছে। ফরাসী বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে প্যারিস এবং লন্ডনের অবস্থা নিয়ে Charles Dickens কর্তৃক লেখা উপন্যাসের প্রারম্ভিক কথাগুলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে বোধহয় অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যায়— “It was the best of times, it was the worst of times, it was the age of wisdom, it was the age of foolishness, it was the epoch of belief, it was the epoch of incredulity, it was the season of light, it was the season of darkness, it was the spring of hope, it was the winter of despair, we had everything before us, we had nothing before us, we were all going direct to Heaven, we were all going direct the other way- in short, the period was so far like the present period..” (A Tale of Two Cities)। করোনা সংকটে নিপতিত বাংলাদেশসহ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে Dickens এর কথাগুলো খুবই মানানসই। করোনাকালে ঘরে আবদ্ধ মানুষের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ধর্মের অনুশীলনের পাশাপাশি মানুষের মানবিক গুণাবলীর প্রকাশ ও দেখা যাচ্ছে, আবার এই সংকটের সময়ও কিছু মানুষের উগ্র লোভ-লালসা ও প্রকট আকার ধারণ করেছে।
গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে দেখা যাচ্ছে যে বিজ্ঞান চর্চা বিশেষ করে চিকিৎসা বিদ্যায় অনেকেই পারদর্শী হয়ে উঠছেন। ফেসবুক এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এত বেশি করোনা প্রতিরোধ, নানারকম চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ওষুধের নাম পাচ্ছি যে কোনটা নেবো আর কোনটা নেবোনা স্থির করাই কঠিন— ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থা। কোন কোন সময় ‘সংকলিত’, ‘সংগৃহীত’ কিংবা ‘কপি’ আবার কখনো বা বিভিন্ন জানা অজানা ডাক্তার কিংবা বিশেষজ্ঞের নামেও নানারকম পরামর্শ চালিয়ে দেওয়া যাচ্ছে অনায়াসেই। গরম পানি থেরাপি, কিটনাশক ছিটানো, থানকুনি পাতা, কালি জিরা, মধু, আদা, লবঙ্গ, লেবু, ভিটামিন সি, জিঙ্ক, আর দোয়া, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবজ তো আছেই। আবার হোমিওপ্যাথি বিশেষ করে আর্সিনক এ্যালবাম আর এলোপ্যাথি তো আছেই। হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, রেমডিসিভির, আইভারমেকটিন, ফাভিপিরাভীর- কি নেই করোনা চিকিৎসায়।
বিজ্ঞাপন
সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘চাচা কাহিনী’ অনেকেই হয়তো পড়েছেন। এই বইয়ে ‘বেঁচে থাকো সর্দি কাশি’ নামে একটা প্রবন্ধ আছে। লেখকের জার্মানিতে সর্দি আক্রান্ত হওয়ার পর সদ্য পরিচিত নামকরা ডাক্তারের কাছে যাবেন সিদ্ধান্ত নেন— “যদিও জানি ডাক্তার করবে কচু, কারণ জর্মন ভাষাতেই প্রবাদ আছে ‘ওষুধ খেলে সর্দি সারে সাত দিনে, না খেলে এক সপ্তায়’।” সৈয়দ সাহেব এই বিশ্বাস নিয়েই পরিচিত ডাক্তারের কাছে যান। ডাক্তার সাহেবও নানা রসিকতার পর রোগীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আরেকটা তত্ত্বকথা এই বেলা শিখে নিন। যে ব্যামোর দেখবেন সাতান্ন রকমের ওষুধ, বুঝে নেবেন সে ব্যামো ওষুধে সারে না।” করোনাতো এক প্রকার ফ্লুই, জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথা যার অন্যতম প্রধান উপসর্গ। গরম পানি থেরাপি, ভিটামিন, জিঙ্ক কিংবা আর্সেনিক এ্যালবাম খাওয়ার পরেও অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছে, আবার বাজারে প্রচলিত-অপ্রচলিত ওষুধ খেয়েও অনেকের যেমন উন্নতি হচ্ছে আবার তার চেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ কোন ওষুধ ছাড়াই ভাল হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার আক্রান্ত হওয়ার আগেই প্রচলিত ওষুধগুলো খেয়ে ফেলছেন। অনেকে আবার কোন কিছুতেই কিছু হবে না কিছু হবে না, যা হবার তাই হবে বলে চূড়ান্ত মতামত দিচ্ছেন। আসলে এখন পর্যন্ত কোন ভ্যাকসিনের অনুপস্থিতি এবং করোনা চিকিৎসায় পরীক্ষিত কোন সুনির্দিষ্ট ওষুধ না থাকার কারণে এতসব বিষয় আলোচনা বাজারে চালু আছে।
বিজ্ঞান বিশেষ করে চিকিৎসা বিদ্যায় আমি একেবারেই নাদান, খুবই কম জানি। তবে গত তিনমাসে আপনাদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুনে আমার মোটা মাথায় করোনা সম্পর্কে কিছু মোটা দাগের কথা বুঝতে পেরেছি। করোনা একটা ভাইরাসজনিত রোগ যা ভয়ঙ্কর রকম ছোঁয়াচে এবং মানুষ থেকেই মানুষে ছড়ায়। কাজেই মানুষ থেকে দূরে থাকা অর্থাৎ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার চেয়ে করোনা প্রতিরোধের আর কোন ভাল বিকল্প বিশ্বের সামনে নাই। মানুষ থেকে দূরে থাকতে হলে ঘরে থাকাই সর্বাপেক্ষা কার্যকর উপায়, কিন্তু তাতো সব সময় সম্ভব নয়। বেঁচে থাকতে হলে নানা প্রয়োজনে আমাদের বাইরে তো যেতেই হয়, তাই, বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। আর কোন অবস্থাতেই অপরিষ্কার হাতে নাক, মুখ কিংবা চোখ স্পর্শ করা যাবে না। আপনি যখন বাইরে যাবেন কিংবা অন্য মানুষের মধ্যে যাবেন, আপনি ধরেই নেবেন যে আপনি ছাড়া বাকি সবাই করোনা ভাইরাস বহন করছে এবং ভাইরাসগুলো আপনার দেহে প্রবেশের পথ খুঁজছে। চোখ, মুখ ও নাক ঢাকা থাকায় প্রবেশ করতে পারছে না, মাস্কের আশেপাশে ঘুর ঘুর করছে, কাজেই কোন অবস্থাতেই মাস্ক থুতনিতে নামানো চলবে না।
সবকিছুর পরেও করোনা আক্রান্ত হতেই পারেন ধরে নিয়ে তা মোকাবিলার প্রস্তুতির জন্য আপনাকে সুস্থ অর্থাৎ স্বাস্থ্যবান থাকতে হবে। এক্ষেত্রে সুস্থতা নিয়ে নানা কথাবার্তা থাকলেও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বাক্যটা মনে রাখলে বোধহয় সুবিধে হবে, “রোগের অভাবের নাম স্বাস্থ্য নয়, স্বাস্থ্য হচ্ছে বিকাশের একটি অবস্থা।” আর WHO এর দেওয়া সংজ্ঞা হলো-স্বাস্থ্য হলো “a state of complete physical, mental and social well-being and not merely the absence of disease or infirmity.” রবীন্দ্রনাথ কিংবা WHO এর দেওয়া সংজ্ঞায় সুস্থ ব্যক্তিগণের করোনা চিকিৎসায় কোন ওষুধের প্রয়োজন নাই। কাজেই করোনায় আক্রান্ত হলে ভীত কিংবা অধৈর্য হওয়া চলবে না। কেননা, ‘Patient’ মানেই যার যার ধৈর্য আছে, ভোগান্তির মুখেও যে ধৈর্য ধারণ করে। করোনায় বিচলিত না হয়ে ধৈর্য ধারণ করলে আল্লাহর সাহায্যও পাওয়া যাবে, রোগের উপশম হবে। পবিত্র কোরআন শরিফে আছে, “আল্লাহ্ ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন” (সূরা আল-ইমরান-১৪৬), “তোমরা ধৈর্য ধারণ কর; নিশ্চয় আল্লাহ্ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন” (সূরা আল-আনফাল-৪৬), “...অর্থ-সংকটে, দুঃখ-কষ্টে ও সংগ্রামে-সংকটে ধৈর্য ধারণ করবে” (সূরা আল-বাকারাহ্-১৭৭)।
আতঙ্কিত হবেন না, সামাজিক দূরত্ব মানবেন, ধৈর্য ধারণ করবেন, স্বাস্থ্যবিধি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবেন— সবই ঠিক আছে, কিন্তু কতদিন? আমি বিশ্বাস করি, আর বেশি দিন নয়। গতকালই অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন নিয়ে সরকার প্রধানদের কনফারেন্স হয়েছে। ইতোমধ্যেই ব্রাজিলে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে, সুখবর আসছে, আসতেই হবে। আমি আশাবাদী, সংকট যতই গভীর হয়, সমাধান ততই কাছাকাছি এসে যায়, রাত যতটা গভীর হয়, সূর্যাস্ত ততই ঘনিয়ে আসে। শেষ করবো রোমান্টিক কবি Shelley কে দিয়ে- “...If Winter comes, can Spring be far behind?”
সুতরাং
“বুকের গভীরে আছে প্রত্যয়,
আমরা করবো জয় একদিন!!!”
মনিরুল ইসলাম: অতিরিক্ত কমিশনার, ডিএমপি।