Sylhet Today 24 PRINT

ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার মোহাম্মদ নাসিম

মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা |  ১৩ জুন, ২০২০

চলে গেলেন সংগ্রামী জননেতা মোহাম্মদ নাসিম। ক্রান্তিকালে বেড়ে ওঠা আজীবন সংগ্রামী এই মানুষটিকে চলমান এক বৈশ্বিক ক্রান্তিকালে চির বিদায় নিতে হয়েছে। সংগ্রামমুখর জীবনে বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত, ষড়যন্ত্র আর অনিশ্চয়তা মোকাবিলা করেই জাতীয় রাজনীতিতে নিজের অবস্থান সুসংহত করেছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়ামের তিনি সদস্য। ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র। নানাবিধ শারীরিক জটিলতায় দীর্ঘদিন থেকে তিনি ভুগছিলেন। তবুও থেমে থাকেননি আত্মপ্রত্যয়ী এই জননেতা। করোনা সংকট দেখা দেওয়ার পর ছুটে গিয়েছেন অসহায় মানুষের পাশে। অসুস্থতার জন্য বার দিন পূর্বে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর শরীরে যখন করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে তখন চিকিৎসকগণ প্লাজমা থেরাপি দেন। কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেন তিনি। পরবর্তীতে ব্রেন স্ট্রোক করায় অপারেশন করতে হয়। গভীর কোমায় চলে যান। চিকিৎসকদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে দৃঢ়চেতা এই মানুষটিকে। ইতি ঘটলো এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের। পরিসমাপ্তি ঘটলো এক রাজনৈতিক ঐতিহ্যের।

জাতীয় চারনেতার অন্যতম এম মনসুর আলীর সন্তান, মোহাম্মদ নাসিম উত্তরাধিকার হিসেবে নয় নিজ যোগ্যতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে। ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্তি। ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতার পর যুবলীগ গঠিত হলে তিনি যুবলীগে যোগ দেন। পালন করেন প্রেসিডিয়াম সদস্যের দায়িত্ব। মূলত পঁচাত্তরের পরই মোহাম্মদ নাসিমের সংগ্রামী জীবনের বিকাশ। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও ৩ নভেম্বর জেল হত্যাকাণ্ডের পর অন্যদের সঙ্গে তিনিও জড়ো হয়েছিলেন টাঙ্গাইলে।ভারতে আশ্রয় নিয়ে অন্যদের সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন প্রতিরোধ যুদ্ধে। অসম সাহসী, তেজি এই মানুষটি আজ জীবনযুদ্ধে পরাজিত।

বিজ্ঞাপন

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল হয়েই কারাগারে ঘাতকের বুলেটে প্রাণ দিয়েছিলেন বাবা মনসুর আলী। তেমনি বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থা ভাজন থেকেই বিদায় নিলেন জননেতা মোহাম্মদ নাসিম। ওয়ান ইলেভেনের সময় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তিনি। সে সময় নির্যাতনের শিকার হয়ে দলের অনেক নেতা দলের সভাপতির বিরুদ্ধে নানা কথা বলেছিলেন। কিন্তু মোহাম্মদ নাসিমকে নির্যাতন, নিপীড়ন করেও বঙ্গবন্ধুকন্যার বিরুদ্ধে কিছু বলাতে পারেনি তখনকার কুশীলবরা।

দেশ ও দলের ক্রান্তিলগ্নে তিনি গণমানুষের রাজনীতিতে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। গভীর সংকটকালীন সময়ে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন। দায়িত্ব পান যুব সম্পাদকের। পরে ১৯৮৭ সালের সম্মেলনে দলের প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন।১৯৯২ সালে সম্মেলনের পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯৭ সালে সম্মেলনের পরও একই দায়িত্বে বহাল থাকেন। তিনিই আওয়ামী লীগের সর্বশেষ একক সাংগঠনিক সম্পাদক। সারাদেশব্যপী জোরালো সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে তখনই পেয়ে যান জাতীয় নেতার স্বীকৃতি। ২০০২ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের পর দলের কার্যনির্বাহী কমিটির এক নম্বর সদস্য নির্বাচিত হন। সদস্য হয়েও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে দীর্ঘদিন দাপটের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১২ সালে সম্মেলনে তিনি দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মনোনীত হন। এরপর থেকে টানা তিন মেয়াদে তিনি দলের সর্বোচ্চ এই নীতি নির্ধারণী ফোরামে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। কর্মীবান্ধব নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত। বিভিন্ন সময়ে দল অন্তপ্রাণ এই মানুষটির সান্নিধ্যে দেখেছি কর্মীদের প্রতি গভীর আন্তরিকতা।

১৯৮৬ সালে তিনি প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি জাতীয় সংসদে হুইপ, বিরোধী দলীয় চিফ হুইপেরও দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে রাজপথে আন্দোলনে প্রথম সারির নেতা ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। পুলিশের অমানুষিক নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি রাজপথ ছেড়ে যাননি। কর্মীদের রক্ষা করতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন সময় পুলিশের লাঠির আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছিলেন। ২১ গ্রেনেড হামলায়ও তিনি আহত হয়েছিলেন। ওয়ান ইলেভেনের সময় কারাগারে থাকা অবস্থায় নিপীড়নের মুখে বড় ধরনের স্ট্রোক হয়েছিল। প্রচণ্ড প্রাণশক্তির অধিকারী মোহাম্মদ নাসিম বার বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। কিন্তু এবার আর শেষ রক্ষা হলো না। হাজারো নেতাকর্মীদের শোক সাগরে ভাসিয়ে তিনি চিরতরে চলে গেলেন। সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগছে সিরাজগঞ্জের মানুষদের জন্য। তিনি ছিলেন সিরাজগঞ্জ তথা পাবনার অবিসংবাদিত নেতা। পাঁচবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নাসিমকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের সুযোগ পাচ্ছেন না। নির্ভরতার প্রতীক প্রিয় নেতাকে হারিয়ে নেতাকর্মীরা শোকে আচ্ছন্ন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। একই সঙ্গে তাঁকে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়েরও অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরও দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর তাঁকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি খাদ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র হিসেবে দল ও জোটের অনেক অভ্যন্তরীণ সংকট সামাল দিয়েছেন বিচক্ষণতার সঙ্গে।

বড় অসময়ে চলে গেলেন মোহাম্মদ নাসিম। অনেকেই তাঁর বিরুদ্ধে নানা কথা বলছেন। তির্যক মন্তব্য করছেন। অথচ একবারও ভাবছেন না মোহাম্মদ নাসিম শুধু অর্থ বিত্তের রাজনীতি করলে অনেক আগেই মন্ত্রী হতে পারতেন। বিত্ত বৈভবের মালিক হতে পারতেন। একটি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কাঠামো একজন ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে না।

গভীর সংবেদনশীল, ব্যক্তিত্ববান এই মানুষটি হয়তো প্রথাগত ভালো মানুষ ছিলেন না। তিনি গুছিয়ে মিথ্যা বলতে জানতেন না। শঠতা, কপটতা ছিল তাঁর চরিত্র বিরুদ্ধ। তাঁর বিশ্বাস, দুর্বলতা ও সরলতার সুযোগ অনেকেই নিয়েছেন। তাঁকে অনেক বিতর্কিত করেছেন অথবা তিনিও নিজের অজান্তে বিতর্কে জড়িয়েছেন।

এখন তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে। সফলতা, ব্যর্থতা নিয়ে মানুষ। কিন্তু মোহাম্মদ নাসিম যে একজন প্রকৃতঅর্থে সংগ্রামী জননেতা। আদর্শিক যোদ্ধা। যেখানেই থাকুন, শান্তিতে থাকুন। বিনম্র শ্রদ্ধা, হে সংগ্রামী জননেতা।

মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা: সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.