Sylhet Today 24 PRINT

সহনশীল রাজনীতির যোগ্যতম মানুষ কামরান

ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন  |  ১৬ জুন, ২০২০

পঁচাত্তর পরবর্তী কোন এক সময়।

আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের দিন। রাজনীতির কঠিন সময়। ছাত্র রাজনীতিতে তখন আমাদের গুরু ম আ মুক্তাদির। কপর্দকহীন বোহেমিয়ান মানুষ। সে সময়ের ঝাঁকড়া চুলে একটা ভাব নিয়ে দিন বদলের স্লোগান আমাদের কণ্ঠে। সকাল থেকেই আমাদের রাজনৈতিক পথ চলা শুরু হতো। প্রতিদিন কোন না কোন কাজ। কোন না কোন গণসংযোগ। বেলা বাড়ার সাথে সাথে একে অন্যের মুখ দেখি।

খিদে পেয়েছে। পকেটে টাকা নেই কারো।  

অবস্থানটা জিন্দাবাজারের কাছাকাছি হলে সিরাজ (রুপবান সিরাজ) ভাইর বাসায়। যেন কয়েক জনের খবার তৈরী হয়ে আছে। জিন্দাবাজারে না হলে, আমাদের গন্তব্য তখন শহরের ছড়ার পার এলাকার দিকে। ম আ মুক্তাদিরের বন্ধু গোলাম মওলা দারা, ফখরুল ইসলাম খান, সহ আমাদের রাজনৈতিক কিছু শুভানুধ্যায়ী ব্যবসায়ীরা থাকেন এলাকাটিতে। এসব বাসায় আমরা হানা দিতাম নেহায়েত উদরপূর্তির জন্য।

যতদূর মনে পড়ে এমন এক দুপুরে ম আ মুক্তাদির পরিচয় করে দেন সুদর্শন যুবক বদর উদ্দিন কামরানের সাথে। সিলেট পৌরসভার কাউন্সিলার হিসেবে তাঁর সাথে পরিচয় হলো। দেশের রাজনীতি তখন নানা বাঁকে যাচ্ছে। একাত্তরের পরাজিত লোকজন মুখোশ তুলে বেরিয়ে আসছে। তাদের সাথে সহঅবস্থান হয়ে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করে তৎকালীন জাসদের নেতাকর্মীদের অবস্থাও অনেকটা দিশেহারা। টের পাওয়া যাচ্ছিলো অনেককিছুই। তারপরও জাসদের ছাত্র সংগঠন শহরে খুবই সংগঠিত ও শক্তিশালী তখন।

আন্দোলনের তখন নানা ফ্রন্ট। রাজনীতিও খুব সরল পথে যাচ্ছিলো না। নগর কেন্দ্রিক নানা রাজনৈতিক কোলাহলে আমাদের জড়িয়ে যাওয়ার সময়। সিলেটের রাজনৈতিক ঐতিহ্যটাও আলাদা। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন যারা, তাদের আশেপাশে থেকেই একজন বাবরুল হোসেন বাবুল উঠে আসেন। মুক্তিযুদ্ধ ফেরত সুদর্শন বাবুল। দীর্ঘদেহী। চমৎকার বক্তৃতা করেন। আমাদের নিশ্চিত ধারণা ছিলো, বাবুলই হচ্ছেন সিলেটের পরবর্তী নেতা।

ছড়ার পারে আমাদের আনাগোনা অব্যাহত থাকে। জানতে পারি, কামরান মধ্যপ্রাচ্যে চলে গেছেন।

বিজ্ঞাপন



প্রবাসমুখীতা সিলেট অঞ্চলের জন্য ভালোর চেয়ে মন্দই মনে করেছি তখন। মেধাবী লোকজন বিদেশ চলে যাচ্ছে। রাজনীতির মাঠেও তখন বেশ কিছু আলোচিত লোকজন কেউ চলে গেছেন জার্মানিতে, কেউ চলে গেছেন লন্ডনে। রাজনৈতিক এসব সংগঠকরা কয়েক বছরের মধ্যেই বিস্মৃত হয়ে পড়ছেন। দ্রুত পরিবর্তনের রাজনীতিতে নতুন নতুন লোকের সমাবেশ ঘটছে। কিছুদিন প্রবাসে থাকার পর এসব সংগঠকদের কেউ কেউ ফিরেও আসেন। ততদিনে জল গড়িয়ে যায়। নিজেদের দলেই আর অবস্থান ধরে রাখতে পারেন না। এরমধ্যে দলীয় ঘরানার বাইরে কামরানকে কেউ মনে রেখেছিলেন কি না, আমার জানা নেই।
 
রাজনৈতিক আড্ডায় মাঝে মধ্যে প্রায় বিস্মৃত এক তরুণ সংগঠকের নাম হিসেবে আমরা বদর উদ্দিন কামরানকে নিয়ে আলোচনা করেছি কদাচিৎ।

এরমধ্যে বাবরুল হোসেন বাবুল আওয়ামী লীগ ছাড়লেন বা দলে টিকতে পারলেন না। রাজনীতিতে অন্য দলের লোকজনের সাথে নয়, নিজ দলের মধ্যে লড়াই করে টিকে থাকার সংগ্রামটা তখন আমাদের কাছে প্রকাশ্য হতে লাগলো। আজো অনেক সংগঠকদের বলতে শুনি, রাজনীতিতে অন্য দল নয়, নেতৃত্বের এগিয়ে যাওয়ার জন্য নিজ দলের লোকজনই প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সিলেটের শুধু আওয়ামী লীগ নয়, অন্য দলেরও বেশ কিছু নেতা প্রবাসী হলেন। কয়েক বছর পরে ফিরলেও দলেই আর আগের অবস্থানে ফিরে যেতে পারেননি। ব্যতিক্রম ছিলেন বদর উদ্দিন কামরান।
 
সিলেটে আওয়ামী লীগের তখন বেশ দুর্দিনই চলছিলো। ৮৩ সালের পৌর নির্বাচনে সা’দত খান ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি থেকে আসা এডভোকেট আ ফ ম কামাল সিলেট শহরের স্থানীয় লোক। রাজনীতিতে নিজেই দাঁড়ালেন শহরভিত্তিক নানা ক্লাব, সংগঠনকে সংগঠিত করে। মিছিল সমাবেশে এগিয়ে থাকা বাম দলগুলো নাগরিক কমিটি গঠন করলেন। প্রার্থী করা হলো শহরের তখনকার শ্রদ্ধ্বেয় নাম এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমেদ পিপিকে। একই নির্বাচনে স্বতন্ত্র পার্থী হলেন ইফতেখার হোসেন শামীম। ইফতেখার হোসেন শামীমকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই আমরা আগে জানতাম। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তাঁর কোন সংশ্লিষ্টতা ছিলো না। যদিও বিয়ে করেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মশুদ চৌধুরীর মেয়ে নাজনীন চৌধুরীকে। এ সূত্র ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত প্রভাবশালীদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিলো। সেবারের পৌর নির্বাচনে আ ফ ম কামাল বেশ ভালো ভোটে নির্বাচিত হয়ে নাগরিক সিলেটের এক জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠলেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী নির্বাচনে হারলেন বেশ ভালোভাবেই। যদিও সিলেট শহরে আওয়ামীলীগের ভোট ব্যাংক ছিলো, যা আজো আছে।

আওয়ামী লীগে স্থানীয় নেতৃত্ব তখন বেশ শূন্যতা। প্রবীণ নেতাদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা আছে। আওয়ামী লীগের এসব নেতাদের সৎ, উদারনৈতিক নেতা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতাও ছিলো প্রশ্নাতীত। তারপরও সাংগঠনিক কোলাহলে বেশ দুর্বল দেখা যায় শহর কেন্দ্রিক রাজনীতিতে। এরমধ্যেই ইফতেখার হোসেন শামীম আওয়ামী লীগে যোগ দেন বেশ ঘটা করে। খুব দ্রুতই শামীম আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠলেন। একদম শহরের কেন্দ্রস্থলে তাঁর বাসাটি তখনকার ১৫ দল, পাঁচ দল সহ মুক্তিযোদ্ধের সপক্ষের রাজনৈতিক নেতা কর্মিদের আস্তানা হয়ে উঠলো।

একজন দক্ষ সংগঠক হলেও ভোটের রাজনীতিতে ইফতেখার হোসেন শামীম কখনো ভাল করতে পারেননি। পৌর নির্বাচনে, উপজেলা নির্বাচনে হেরেছেন। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলই এসবের জন্য বেশ দায়ী বলে আজো মনে করা হয়। অথচ এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, ঘাতক দালালদের আন্দোলনে ইফেতেখার হোসেন শামীমই আওয়ামী লীগের একজন উজ্জ্বল নেতা হিসেবে উঠে আসছিলেন।

বদর উদ্দিন কামরান প্রবাসে থাকার কারণে আওয়ামী লীগের নিত্যদিনকার কোন্দল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। যখন প্রবাস থেকে ফিরে এলেন, আওয়ামী লীগের মধ্যে এমন একজনকেই যেন খোঁজা হচ্ছিলো। নিজের যোগ্যতায় তিনি দলে যেমন শক্ত অবস্থান নিতে পেরেছিলেন, তেমনই জনতার প্রিয়ভাজনও হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। শহরের স্থানীয় লোক ছিলেন। একদম তরুণ বয়সে পৌরসভার কাউন্সিলর ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে সবাইকে নিয়ে চলার চমৎকার গুণ ছিলো তাঁর। সিলেটের সহনশীল রাজনীতির যোগ্যতম মানুষ হয়ে উঠছিলেন। আমাদের রাজনীতির চলমান বাস্তবতায় এমন মানুষও এখন বিরল।  

সিলেট, শহর থেকে নগর হয়েছে। পৌরসভা থেকে সিটি কর্পোরেশন হয়েছে। এ নগরীর উপর দিয়ে অনেক দখল গেছে। যাচ্ছে। সবই দূর থেকে শুনেছি। প্রবাসে থেকেও দেশকে আমরা ছাড়তে পারি না। শহরটি আমাদের যৌবনের নানা স্মৃতিতে জেগে উঠে। সময়ের কোলাহলের মানুষ বদর উদ্দিন কামরানকে নিয়ে অনেকেই লেখবেন, বলবেন।
শুধুই মনে হচ্ছে, সুরমা পারের চেনা মানুষগুলো সব চলে যাচ্ছেন। বদলে যাচ্ছে নগরীর জনারণ্য।

দেশ ছাড়ার দিন বিমান বন্দরেই দেখা বদর উদ্দিন কামরানের সাথে। শেষ করমর্দনে সদা বিনয়ী কামরান বলেছিলেন- আমাদের একা রেখে চলে যাচ্ছেন?
বলেছিলাম, আবার দেখা হবে!
না, আর দেখা হয়নি। হবেও না!

ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন : প্রবাসী সাংবাদিক।

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.