Sylhet Today 24 PRINT

ক্যাম্পাস ও সংগঠন নিয়ে কিছু কথা

মো. আবু সাঈদ আকন্দ |  ২৩ জুন, ২০২০

গত ১৬ জুন মঙ্গলবার ‘দি ডেইলি স্টার’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে একটা মন্তব্যে বলেছিলাম, "শুরুতেই  জাতীয় চারনেতার একজন ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মনসুর আলীর ছেলে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিম ভাইকে নিয়ে মাহিরের বক্তব্যের নিন্দা জানাচ্ছি। এরপর যখন সে ভুল স্বীকার করেছে সেটাকেও সাধুবাদ জানাচ্ছি ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শিক্ষার্থীদেরকে ভুল-শুদ্ধের পার্থক্য শেখানো। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে কেউ কারও প্রতিপক্ষ নয়; সাংঘর্ষিক নয়। মামলা দেয় সাধারণত শত্রুপক্ষের একজন অপরজনের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বজনীন শিক্ষা দেয়ার কথা। এখানে এই শিক্ষা দেয়া হচ্ছে বলে মনে হয় না। বিশ্ব কেটে দিয়ে শুধু বিদ্যালয় লিখলেও বিষয়টা মামলা পর্যন্ত গড়ানোর কথা নয় কোনভাবেই। এই মামলা একটি বিষয় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ‌প্রশাসন শিক্ষার্থীদেরকে ভুল ধরিয়ে সঠিক শিক্ষাটা প্রদান করতে পুরোপুরি ব্যর্থ।

দেশের প্রচলিত আইনে ১৮ বছরের সবাই একই জাতীয় পরিচয়পত্র পাই আমরা যেখানে আমাদের অভিন্ন পরিচয় উল্লেখ থাকে; জাতীয়তা : বাংলাদেশি। এখানে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক বিষয়ে কোন তথ্যের উল্লেখ থাকে না।

একইভাবে যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্রেও শিক্ষার্থীর নাম, বিভাগ, রেজিঃ নম্বরের মত তথ্যই দেয়া থাকে। কার কি দল এসব বিষয়ে কোন তথ্য থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, গণমাধ্যম, প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনসহ অনেক কিছুর সাথেই নিজেকে যুক্ত করার অবারিত সুযোগ রয়েছে।

তাই ক্যাম্পাসে ভর্তির পর থেকে আমাদের পরিচয়ের প্রশ্ন উঠলে আমরা এই ক্যাম্পাসের ছাত্র এটাই সবার মনে রাখা উচিত; এরপর যার যার সাংগঠনিক পরিচয়।

আমরা দিক থিয়েটার, শিকড়, থিয়েটার সাস্টের প্রোগ্রাম দেখি, সাস্ট ডিবেটিং সোসাইটির ডিবেট উপভোগ করি, রিম, নোঙরের কনসার্টে যাই যে আয়োজনের পুরোটাই আমাদের জন্য। এখানে কোন ধর্ম, বর্ণ আর আদর্শের ভেদাভেদ নাই।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য মুখ্য পরিচয় বাদ দিয়ে গৌণ পরিচয়টা বেশি প্রচার করা হয়। আর ব্যক্তিটি যদি রাজনৈতিক সংগঠনের হয় তাহলে তো কথাই নেই। অবশ্য অন্যান্য সংগঠনের নাম সেভাবে সামনে আসে না সচরাচর। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ধরণের প্রচার বিরোধী। ব্যক্তি পরিচয় আর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। একটার দায়ভার অন্যটির উপর চাপানো অনুচিত। আর সমালোচনা যিনি করবেন, যার বিষয়ে করবেন ভাষাটা যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে মানানসই হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত সচেতন ভাইবোনদের কাছে আমার সবসময়ের প্রাণের দাবি এই আলাদা বিষয়গুলোকে আপনারা আলাদা করেই মূল্যায়ন করবেন।

বিজ্ঞাপন



অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মাহির চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রশাসনের মামলা সাস্টের ইতিহাসের অন্যতম নিকৃষ্ট ঘটনা। মাহির সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি সে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল চিন্তাধারারই একজন। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, প্রশাসন, রাজনীতি, সংস্কৃতি সব কিছু নিয়েই আমাদের ক্যাম্পাস। এখানে একটা অন্যটার সাংঘর্ষিক নয়; বরং পরিপূরক।

অনলাইনে ক্লাস বর্জন ইস্যুতে সক্রিয় থাকায় ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে প্রক্টরের প্রত্যক্ষ মদদে নিজ বিভাগের ছাত্রের উপর এই মামলা এটাই স্বাক্ষ্য দেয় যে, কোন শিক্ষার্থীই তার কাছে নিরাপদ নয়। জনাব জহির উদ্দিনকে প্রশাসনিক দায়িত্ব দিয়ে বরং বানরের হাতে কুড়াল তুলে দেয়া হয়েছে। তাই তাকে সরিয়ে প্রকৃত অভিভাবক সমতূল্য কাউকে প্রক্টরের দায়িত্বে বসানো উচিত যিনি সন্তান ভেবে সবাইকে বুকে আগলে রাখবেন। দমন-পীড়ন নীতি কখনও একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ হতে পারে না। প্রশাসনের এই নীতি প্রগতিশীল, মুক্ত সংস্কৃতি, মুক্তচিন্তা বিকাশের পথে চরম অন্তরায়। বিগত সময়ের আরও কিছু ঘটনায় প্রশাসনের এই নগ্নতা বারবার উঠে এসেছে। তাই ক্যাম্পাসের একজন সাবেক ছাত্র হিসেবে, প্রগতির পতাকাবাহী সংগঠনের একজন কর্মি হিসেবে এই নগ্নতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং মাহিরের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার দ্রুত প্রত্যাহার দাবি করছি।

নিজের সংগঠন নিয়ে যেটুকু না বললেই নয়; আমি আত্নসমালোচনার পক্ষে। হাজারটা দোষ আমার। তবে যে কাউকে দেখে শেখার মানসিকতা আছে, ভুল স্বীকার করার সৎ সাহস আছে। আজ ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের যতটুকু সমালোচনা এর সবচেয়ে বড় কারণ যদি সাবলীল ভাষায় বলি তা হচ্ছে দূর্বল নেতৃত্ব। আমাদের জেলা ইউনিটগুলোর নেতৃত্ব নির্বাচনের সিস্টেমে কিছু সমস্যা আছে। শুধুমাত্র এই একটা ভুলের কারণেই মৌলবাদী শক্তির হাতে আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলার ইস্যু তুলে দেই আমরা। ছাত্রলীগের ব্যাপ্তি, দায়িত্ব, কাজের পরিধি সবই আলাদা।

দুঃখজনক হলেও সত্য ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গ সংগঠন, সহযোগী সংগঠনে এখন পার্টটাইম রাজনীতিবিদেরই সংখ্যাধিক্য। এরা দলের সুদিন দেখে আসে। আবার দূর্দিন থেকে চুপচাপ সরে যায়। এদের আগমনী গান সকলের দৃষ্টিগোচর হলেও প্রস্থানটা হয় অতি সঙ্গোপনে। এসেই তারা শর্টকাটে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। আর সমস্যার শুরুটা এখান থেকেই। কারণ সফলতার কোন শর্টকাট রাস্তা নেই। ধৈর্য্য, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই এগুলো অর্জন করতে হয়। কারণ রাজনীতি পৃথিবীর সবচেয়ে ধীর গতির দীর্ঘ প্রক্রিয়া।

আওয়ামী লীগ সরকার তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায়। প্রথম মেয়াদ থেকে শুরু করে এই তৃতীয় মেয়াদ পর্যন্ত জ্যামিতিক হারে দলটির নেতাকর্মী, সমর্থক বেড়েই চলেছে। কে কার চেয়ে কত বড় আওয়ামী লীগার এই প্রমাণ দিতেই ব্যস্ত সবাই। আদর্শ চর্চার নাম করে এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে স্বজ্ঞানে-অজ্ঞানে দলের বারোটা বাজাচ্ছেন একেকজন। এই বিতর্কিত ব্যক্তিবর্গ কথায় কথায় দলীয় প্রধানের নাম বিক্রি করে। কারণ তাদের ব্যক্তিগত অর্জন শূণ্যের ঘরে। অতি ধূর্ত এই নব্য রাজনীতিবিদদের বাচনভঙ্গি, রুচিবোধ, নীতি-আদর্শ, সংগঠনে অবদান কোনটাই একজন নিরপেক্ষ সাধারণ মানুষকে আওয়ামী লীগের প্রতি ইতিবাচক ধারণা জন্মাতে অনুপ্রাণিত করতে পারে না।

বিপরীতক্রমে তাদের অশালীন কর্মকান্ডের ফলে দলের প্রতি সাধারণ ভোটারদের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়। মতের অমিল হওয়ার কারণে এরা যখন খুশি, যাকে খুশি, যেভাবে খুশি শিবির ট্যাগ দিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে প্রকৃত শিবির যারা তারা আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এই যত্রতত্র ট্যাগ দেয়ার ফলে সংগঠন এবং নেতা-কর্মি সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। এতে দীর্ঘমেয়াদে দল ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কথায় কথায় জাতির পিতা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নাম বিক্রির কারণে আমাদের আবেগ-শ্রদ্ধার মূল জায়গা এই দুই জনের প্রতিও মানুষের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। রাজনীতিতে করতে ব্যক্তি ইমেজ অত্যাবশ্যক।নেতা হিসেবে কাউকে পছন্দ হলে ঐ নেতার দল এ,বি,জি, যাই হোক না কেন মানুষ পছন্দের ব্যক্তির পেছনেই দাঁড়ায়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ছাত্ররাজনীতি থেকে শুরু করে মূল দল পর্যন্ত এটাই চলে।

তাই পার্টটাইম ভাইদের প্রতি বিনীত অনুরোধ আপনারা গরু মোটাতাজাকরণের মত শর্টকাট সিস্টেম পরিহার করে নেতা সুলভ চরিত্র গঠন করুন। তাহলেই আমাদের মত অল্প জ্ঞানের সাধারণ মানুষজন আপনার পেছনে স্বাচ্ছন্দে দাঁড়াতে পারবো। ভুলে গেলে চলবে না রাজনীতির নামে কারও ভীতির কারণ হয়ে দলের ক্ষতি করার মেন্ডেড আমাদের কাউকেই দল দেয়নি। আর অতি উৎসাহী রাজনীতি যেকোন দলের জন্য কখনই শুভকর নহে।

ক্যাম্পাসের যেকোন ইস্যুতে রাজনৈতিক কথা বলতে হবে এমন কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। সাস্টে আনুমানিক ৮/৯ হাজার শিক্ষার্থী আছে যাদের মধ্যে সব দল মিলিয়ে সক্রিয় রাজনীতিবিদ খুব বেশি হলে ৮০০-৯০০ হবে। এরমানে মেজোরিটি সরাসরি রাজনীতি করে না। কিন্তু তারাও কোন না কোন আদর্শ লালন করে। আমরা সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করে কোন বিষয়ে মন্তব্য করলে সেটা দলের জন্য কতটুকু ইতিবাচক/নেতিবাচত প্রভাব ফেলবে তা অবশ্যই ভাবতে হবে। অতি আওয়ামী লীগার সাজতে গিয়ে সবার কাছে দল যেন বিতর্কিত না হয় এই বিষয়ে আমাদের অবশ্যই সচেতন থাকা উচিত। সংগঠনের নাম করে ক্যাম্পাসের এ টু জেড প্রতিটি বিষয়ে সাবেকদের উপদেশ দেয়াটাও একটু বেমানান। ১০ বছর আগের ক্যাম্পাস আর ১০ বছর পরের ক্যাম্পাস প্রেক্ষাপট কখনই এক হবেনা। সাবেকদের নিকট বর্তমানরা কোন বিষয়ে পরামর্শ চাইলে আমরা অংশগ্রহণ করতে পারি অন্যথায় দূরে থাকাই শ্রেয়।

পরিশেষে বলতে চাই সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহনে নিজেদের ভুল-ত্রুটি একপাশে রেখে সারা দেশে গর্ব করার মত পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসার এই অনন্য টান যুগযুগ টিকে থাকুক আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত প্রতিটি সাস্টিয়ানের প্রাণে।

মো. আবু সাঈদ আকন্দ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী, সাবেক সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ।
 

টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
[email protected] ☎ ৮৮ ০১৭ ১৪৩৪ ৯৩৯৩
৭/ডি-১ (৭ম তলা), ব্লু ওয়াটার শপিং সিটি,
জিন্দাবাজার, সিলেট - ৩১০০, বাংলাদেশ।
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.